নিউজ ডেস্ক:
সম্প্রতি বরগুনায় নারী ঘটিত সম্পর্কের জের ধরে প্রকাশ্যেই কুপিয়ে হত্যা করা হয় রিফাত শরীফ নামের এক যুবককে। প্রকাশ্যে দিবালোকে এই কুপিয়ে হত্যা করার কারণে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। এই ঘটনার পর আইন শৃঙ্খলা বাহিনী বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে। ইতোমধ্যেই হামলার প্রধান আসামী সাব্বির আহমেদ ওরফে নয়ন বন্ড পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়েছেন। এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এই ঘটনায় বেশ আলোচনা সমালোচনা হলেও রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়েশা আক্তার মিন্নিকে অনেকেই মানসিকভাবে সহযোগিতা করেছেন। তবে ঘটনার তদন্তে রিফাতের স্ত্রী মিন্নিকে নিয়ে কিছু ঘটনা উঠে এসেছে। নিম্নে সম্পূর্ণ ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরা হলো—
তথ্য মতে, খুনি নয়ন এলাকায় বিভিন্ন অপরাধ ও অপকর্ম সংঘটিত করার লক্ষ্যে ফেসবুক মেসেঞ্জারে ‘কিলিং স্কোয়াড ০০৭’ নামে একটি গ্রুপ খুলেছিলো। মূলত হত্যাকান্ডের পূর্বের দিন এ গ্রুপের বার্তায় দেয়া হয় রিফাত শরীফকে হত্যার নির্দেশনা।
জানা গেছে, ঘাতক নয়ন বন্ড বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র জেমস বন্ডের নামের সঙ্গে মিলিয়ে তার সন্ত্রাসী গ্রুপের নাম রাখে ‘০০৭’। এমনকি নিজের নামও ওই গোয়েন্দা চরিত্র অনুযায়ী ‘নয়ন বন্ড’ রাখে। একাধিক সূত্রের তথ্য মতে, রিফাত শরীফকে হত্যার মিশন ঠিকঠাক মতো সম্পন্ন করতে ঘটনার আগের দিন সকাল থেকেই ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে খুনের নানা ছক কষে নয়ন বন্ড। কোথায়, কীভাবে হত্যা করা হবে, কিলিং মিশনে থাকা সদস্যদের কার কী ভূমিকা থাকবে, তা ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে জানিয়ে দেয় নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজী।
সে তথ্যানুযায়ী ঘাতক রিফাত ফরাজী ঘটনার আগের দিন রাত ৮টার দিকে ০০৭ গ্রুপের সদস্যদের সরকারি কলেজের সামনে থাকার নির্দেশ দেয়। ‘মুহাম্মদ’ ও ‘সাগর’ নামের দুজন ওই ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে জানতে চায়-তাদের কোথায় ও কখন থাকতে হবে। জবাবে রিফাত ফরাজী ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে ‘দা’-এর একটি ছবি দিয়ে তাদের বলে-পারলে এইটা নিয়া থাইকো।
তখন ‘মুহাম্মাদ’ জবাব দিয়ে জানায়, ‘দা’ নিয়ে হাজির থাকবে সে। সে অনুযায়ী কিলিং স্কোয়াডের সদস্যরা ঘটনার দিন সকাল ৯টার মধ্যেই বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে হাজির হয়। এর পর তারা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে রিফাত শরীফকে হত্যা করে পালিয়ে যায়। চিকিৎসাধীন রিফাতের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর নয়ন তার গ্রুপের মাধ্যমে হত্যা মিশনে অংশ নেওয়া সবাইকে গ্রেপ্তার এড়াতে সতর্ক থাকতে নির্দেশ দেয়।
এই ঘটনায় রিফাতকে কোপানোর সময় তার স্ত্রী মিন্নি একাধিকবার রিফাতকে বাঁচানোর চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারেনি বলে হত্যাকান্ড পরবর্তী সময়ে বেশ ভাইরাল হয় এবং মিন্নি প্রতিবাদী নারী হিসেবে আলোচিত হয়। তবে এই ঘটনার স্বাভাবিকবাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে রিফাতকে কোপানোর সময় মিন্নিকে কেন কোনো আঘাত করা হয়নি। এমনকি আসামীদের সাথে মিন্নির হাতাহাতি করার সময় মিন্নির হাত থেকে তার ভ্যানিটি ব্যাগ পড়ে গেলেও আসামীদের একজন তার ব্যাগ তুলে দেয় এবং কোপানোর পর স্বামীর সাথে হাসপাতালে না গিয়ে রিক্সাযোগে স্বাভাবিকভাবে মিন্নির চলে যাওয়ার দৃশ্য পরবর্তীতে সন্দেহের উদ্রেক করে।
এছাড়াও রিফাত হত্যায় ভাইরাল হওয়া দ্বিতীয় ভিডিওটিতে মিন্নির আচরণ দেখে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ভিডিওতে দেখা যায় কলেজ গেটে একাধিকজন রিফাতকে মারধর করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, অথচ মিন্নি স্বাভাবিকভাবে তাদের পিছু পিছু হাঁটছেন। এসময় মিন্নির চলাফেরা বা আচরণে কোন ধরণের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ফুটে ওঠেনি বিধায় জনমনে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে।
মিন্নির সঙ্গে রিফাত শরীফের সম্পর্ক বেশ পুরানো। স্কুল পর্যায় থেকেই মিন্নির সাথে রিফাতের সম্পর্ক ছিলো। কলেজে উঠার পর জুয়েল নামে একজনের সঙ্গে মিন্নি প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন। পরে জুয়েলের সঙ্গেও তার সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়। এরপর থেকে রিফাতের সঙ্গে মিন্নির সম্পর্ক চলতে থাকে। মিন্নি পাশাপাশি নয়ন বন্ডের সঙ্গেও সখ্যতা গড়ে তোলে। এলাকায় প্রভাব বিস্তার ও নানা খারাপ কাজে লিপ্ত থাকায় নয়নের প্রতি আকৃষ্ট হয় মিন্নি। এক পর্যায়ে পারিবারিক অমতে নয়ন বন্ডকে বিয়ে করেন মিন্নি। নয়ন মাদকাসক্ত থাকায় একপর্যায়ে মিন্নিও মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে পারিবারিক চাপে মিন্নির সাথে নয়নের ডিভোর্স হয়ে যায়। এরপর চলতি বছরের ২৬ এপ্রিল প্রাক্তন প্রেমিক রিফাতকে বিয়ে করেন মিন্নি। মূলত এরপর থেকেই রিফাতের সাথে নয়নের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। দ্বন্দ্বের জের ধরে ২৬ জুন রিফাতকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে নয়ন ও তার সহযোগীরা।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো হত্যাকারীরা রিফাতকে এলোপাতাড়িভাবে কোপ দিলেও মিন্নিকে একটিও আঘাত করেনি। কেন আঘাত করেনি, সেটি নিয়েও শুরু হয়েছে গুঞ্জন। এছাড়া হত্যা পরবর্তীতে ‘Minni Shorif’ নামক ফেসবুক আইডি থেকে নয়ন বন্ডকে পাঠানো ‘Sorry Jan’ লেখা ম্যাসেজ, হত্যাকাণ্ডের দিন মিন্নির কলেজে আগমন, কলেজ গেট থেকে রিফাত শরীফকে কিল ঘুষি দিতে দিতে নিয়ে যাওয়ার সময়ে তার বাধা না দেয়া ও নির্বিকার ভঙ্গিতে আস্তে আস্তে নয়ন বন্ডের পিছনে পিছনে হেঁটে যাওয়া, পরবর্তীতে ঘাতকদের তুলে দেয়া হাত ব্যাগটি গ্রহণ করে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঘটনাস্থল থেকে চলে আসা, নয়ন বন্ডের সঙ্গে ঘটনার আগের দিন ও পরেরদিন মোবাইলে কথোপকথন হত্যাকাণ্ডে মিন্নির জড়িত থাকার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয়।
এদিকে পুলিশ মিন্নির সাথে একাধিকবার ঘটনার ব্যাপারে কথা বলতে চাইলে মিন্নি পুলিশের সাথে কথা বলেননি। স্বামীকে হত্যা করার পরও কাঁদতেও দেখা যায়নি মিন্নিকে। রিফাতকে যখন মারতে মারতে নয়ন ও তার সহযোগীরা সামনে নিয়ে যাচ্ছিলো তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই পেছন পেছন হেঁটে যাচ্ছিলো মিন্নি। রিফাতকে বাঁচাতে পর্যন্ত আসেননি তিনি। কুপিয়ে আহত করার পর স্থানীয়রা রিফাতকে যখন হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলো তখন মিন্নি হাসপাতালে না যেয়ে খুনি রিফাতের সামনে দিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে রিক্সায় উঠে নিজ বাড়িতে চলে আসে। এরূপ বেশ কয়েকটি ঘটনার দিকে দৃষ্টিপাত করলে এই ঘটনায় মিন্নির সরাসরি জড়িত থাকার প্রমাণ মেলে। কিন্তু মিন্নিকে কেন আইন শৃঙ্খলা বাহিনী আটক করছে না সেটারও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের মনে।