ডেস্ক নিউজ
সারা দেশকে পর্যায়ক্রমে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে সরকার। বন্ধ রেলপথ চালু এবং নতুন রেললাইন নির্মাণের মধ্য দিয়ে দেশের প্রায় সব জেলায় রেল সেবা বিস্তৃত করার কর্মযজ্ঞ চলছে গত এক দশক ধরে। ইতিমধ্যে প্রায় সাড়ে ৩০০ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণ, নতুন নতুন জেলায় রেলপথ সম্প্রসারণ এবং ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার পুরনো রুটগুলো চালু করার মধ্য দিয়ে সেবা বিস্তৃতির তৎপরতা চলছে। দক্ষিণের বরিশাল, ঝালকাঠি, বরগুনা, পটুয়াখালীসহ নতুন নতুন জেলা নিয়ে আসা হচ্ছে রেল নেটওয়ার্কের আওতায়।
এদিকে তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে প্রথম রাঙামাটিকে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রামের রাউজান থেকে রাঙ্গুনিয়া হয়ে কাপ্তাই পর্যন্ত ৪২ কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন রেলপথের জন্য বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকার সঙ্গে আলোচনা করছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। ইতিমধ্যে প্রকল্পটির সম্ভাব্যতার সমীক্ষা শেষ হয়েছে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় দেশে ৮৫৬ কিলোমিটার নতুন ডুয়েল গেজ রেললাইন ও ১ হাজার ১৮১ কিলোমিটার ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন রেলওয়ে ট্র্যাক নির্মাণ এবং ৭২৫ কিলোমিটার রেলপথ পুনর্বাসন, রেল সেতু ও লেভেল ক্রসিং গেট নির্মাণের কাজ চলছে। এ ছাড়া ইতিমধ্যে সিমুলেটর, রিলিফ ট্রেন, বেশ কিছু লোকোমোটিভ ও বগি সংগ্রহ করা হয়েছে, সেই সঙ্গে বগি সংস্কারের কাজ চলছে। ইতিমধ্যে ৪৪টি জেলাকে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও ১৫টি জেলাকে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ-ভারত সংযোগের পুরনো রেলরুটগুলো চালু করারও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ আন্তদেশীয় যোগাযোগের ক্ষেত্রে রোহনপুর-সিঙ্গাবাদ, দর্শনা-গেঁদে, বেনাপোল-পেট্রাপোল এবং বিরল-রাধিকাপুর এই চারটি গুরুত্বপূর্ণ রেল সংযোগের মাধ্যমে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন করা হচ্ছে। তাছাড়া আখাউড়া-আগরতলা, কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলরুটের কাজ চলছে। সংযুক্ত হবে বুড়িমারী-শিলিগুড়ি এবং ফেনী-বিলোনিয়া রুটও (সর্বশেষ, প্রস্তাবিত)। ৫৫ বছর পর নীলফামারীর চিলাহাটি-হলদিবাড়ী (ভারত) রুটে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল উদ্বোধন হয়েছে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর। ইতিমধ্যে এই রুটে ভারত থেকে গত এক মাসে অন্তত ছয় দফা পাথরবোঝাই ওয়াগন নিয়ে আসা হয়েছে। দুই দেশের আন্তসংযোগের প্রাচীনতম রেলপথ কুলাউড়া-শাহবাজপুর রুটটি চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভারতের আসাম রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত লাইনটি চালু হয়েছিল ১২৫ বছর আগে ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৯৬ সালের ৪ ডিসেম্বর। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এক সময় ট্রেন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে রেলপথটি। বিএনপি সরকার ২০০২ সালে বন্ধ করে দেয় দীর্ঘ ১০৬ বছর চালু থাকা এ রেলপথ। রেলের সম্পত্তি চুরি ও বেদখল হয়ে যায়। বর্তমান সরকার দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে দুই দেশের পণ্য পরিবহন এবং আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়াতে ২০১০ সালের পর বন্ধ লাইনটি চালুর উদ্যোগ নেয়। বন্ধ হওয়ার ১৬ বছর পর ২০১৮ সালের আগস্টে পুনর্বাসনের কাজ শুরু হয়। তবে মেয়াদ শেষ হলেও কাজ হয় মাত্র ১৭ শতাংশ। ২০২২ সাল পর্যন্ত কাজের মেয়াদ বাড়ানো হলেও অগ্রগতি শূন্য। মোট কাজ হয় মাত্র ৩০ শতাংশ।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক সুলতান আলী বলেন, বিভিন্ন কারণে সময়মতো কাজ শেষ করা যায়নি। নতুন মেয়াদ ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে যাবে বলে আশা করছি।
এদিকে গত ২৮ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, অল্প খরচে যোগাযোগ স্থাপন ও পণ্য পরিবহনের সুবিধার্থে আমরা সমগ্র বাংলাদেশকে রেল যোগাযোগের আওতায় নিয়ে এসেছি। মধুখালী থেকে কামারখালী হয়ে মাগুরা পর্যন্ত নতুন রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প-ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ হতে ‘ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন’-এর উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। তিনি বলেন, যে সব এলাকায় রেললাইন নেই সে সব এলাকাতেও রেল সহযোগিতা দিয়ে দিচ্ছি। যেন পণ্য পরিবহন ও ব্যবসা বাণিজ্যে সমৃদ্ধি করা যায়। তিনি বলেন, ২১ বছর পর আমরা ক্ষমতায় এসে রেলের উন্নতিতে আলাদাভাবে রেলওয়ে মন্ত্রণালয় করে দেই। বিএনপি আমলে বিশেষ করে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে রেলের অনেক অভিজ্ঞ কর্মীকে বিদায় করে দেয়। আমরা সরকারে এসে বঙ্গবন্ধু সেতুতে রেল সংযোগ করি। যমুনা নদীর ওপর আরেকটা ডেডিকেটেড রেলসেতুরও কাজ আমরা করে যাচ্ছি। তাছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইস্পিড ট্রেন লাইন করার চিন্তাভাবনা আছে। এ ব্যাপারে স্টাডি চলছে।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, পদ্মা সেতু পার হয়ে ভাঙ্গা থেকে একদিকে যেমন যশোর হয়ে খুলনা পর্যন্ত রেল যোগাযোগ করব, অপর দিকে সোজা বরিশাল হয়ে একেবারে পায়রা নতুন নৌবন্দর পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। বরিশাল বিভাগকে এক সময় বলা হতো বাংলার ভেনিস। সেখানে রেললাইন করার চেষ্টা করেও ব্রিটিশরা পারেনি। আমরা উদ্যোগ নিয়েছি, স্টাডি চলছে। ব্রিটিশদের অনুরোধ করছি তারা যেন রেলটা নির্মাণ করে দেয়। আমরা সমগ্র বাংলাদেশকে রেলওয়ের আওতায় নিয়ে আসছি।
রেল যাবে রাঙামাটি : এদিকে পার্বত্য তিন জেলার মধ্যে প্রথম রাঙামাটিতে রেলপথ নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করছে রেলওয়ে। চট্টগ্রামের রাউজান থেকে রাঙ্গুনিয়া হয়ে কাপ্তাই পর্যন্ত ৪২ কিলোমিটার রেলপথের জন্য ৮ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে ৭ হাজার ১৪১ কোটি টাকার বৈদেশিক ঋণ সংস্থানের জন্য রেলওয়ের অনুরোধে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি), জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) মতো একাধিক বৈশ্বিক ঋণদাতার সঙ্গে আলোচনা করছে। রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, ২০১৮-২০১৯ সালে প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা সমীক্ষা শেষ হয়েছে এবং ডাবলগেজ রেল ট্র্যাকের একটি পরিকল্পনা নকশাও প্রস্তুত করা হয়েছে। এতে নয়টি স্টেশন থাকবে। পার্বত্য জেলা রাঙামাটিকে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হলে রাঙামাটিকেন্দ্রিক পর্যটন সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যাবে। সেখানে নতুন বিনিয়োগ যুক্ত হবে। আঞ্চলিক বাণিজ্য ও ব্যবসার প্রসার ঘটবে। বিশেষ করে পাহাড়ে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী সহজে সারা দেশে পাঠানো সম্ভব হবে।
রেলওয়ের ৩০ বছর মেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান (২০১৬-২০৪৫) এর মধ্যে রয়েছে ২০২২ সালের মধ্যে কাপ্তাই পর্যন্ত রেলপথ স্থাপন করা। তবে অর্থায়ন নিশ্চিত না হওয়ায় বাস্তবায়ন বিলম্বিত হবে। রেলওয়ে চলতি বছর প্রকল্পটির কাজ শুরু করে ২০২৬ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার পরিকল্পনা করছে। এদিকে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনকে লেখা এক চিঠিতে সম্প্রতি ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন লিমিটেড (ইরকন) কাজ পেলে অর্থায়ন নিশ্চিত করার প্রস্তাব দিয়েছে। রেল কর্মকর্তারা বলছেন, তারা ভারতীয় ঋণের মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে আগ্রহী নয়। কারণ, ভারতীয় ঋণের সঙ্গে তাদের ‘কঠিন শর্ত’ সংযুক্ত রয়েছে এবং বাস্তবায়নের সময় অন্যান্য সমস্যা হয়।
এদিকে রেলওয়ে গত এক দশকে প্রায় সাড়ে ৩০০ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণের পাশাপাশি মিটারগেজ রেললাইন ডুয়েলগেজে রূপান্তর করেছে ২৪৮ কিলোমিটার। রেললাইন পুনর্বাসন করা হয়েছে ১ হাজার ১৩৫ কিলোমিটার। ৯০টি স্টেশনে সিগন্যালিং ব্যবস্থার উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন করা হয়েছে। ১১৭টি নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে। এই সময়ে নতুন ইঞ্জিন সংগ্রহ করা হয়েছে ৪৬টি। যাত্রীবাহী ক্যারেজ সংগ্রহ করা হয়েছে ২৭০টি। রেলের দুই অঞ্চলের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ১১টি প্রকল্পসহ পূর্বাঞ্চলের ২৩টি প্রকল্পের কাজ চলছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে সর্বশেষ বিদেশ থেকে আসা ১০টি ইঞ্জিনও রয়েছে। আরও কিছু ইঞ্জিন দক্ষিণ কোরিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে কেনার প্রক্রিয়া চলছে। একইভাবে যাত্রীবাহীসহ আরও ২০০ কোচও আসা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। চলমান প্রকল্প দ্রুত শেষ ও নতুন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে রেল যোগাযোগে যুগান্তকারী এক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. সুবক্তগীন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পূর্বাঞ্চলে অগ্রাধিকার প্রকল্পসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজ চলছে। এরই মধ্যে লাকসাম-আখাউড়া ডুয়েলগেজ রেললাইনের ৭৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। বর্তমানে এই প্রকল্পসহ সরকারের অগ্রাধিকার আরও কয়েকটির কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে।
পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিভিন্ন সংকটের মধ্যেও ট্রেন চলাচল ও প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে চলছে। তিনি বলেন, চলমান বিভিন্ন প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন হলে ট্রেন চলাচলে গতি আসবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার আরও উন্নতি করতে নেওয়া হচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রাম বুলেট ট্রেনের প্রকল্পও। সংকটগুলো চিহ্নিত করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সবকিছু বিবেচনা করে দ্রুত বাস্তবায়ন করা গেলে সরকারের উন্নয়নের পাশাপাশি একটা যুগান্তকারী মাইলফলক হিসেবে আগামীতে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে বলে জানান তিনি। দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুনদুম রেললাইন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মো. মফিজুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আগামী ২০২২ সালের মধ্যে এ রেললাইন প্রকল্পটির কাজ সম্পন্ন করে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সঙ্গে রেল যোগাযোগ চূড়ান্তভাবে চালু হবে বলে আশা করছি।