ডেস্ক নিউজ
কঠোর ‘লকডাউনে’ও চট্টগ্রাম বন্দর ২৪ ঘণ্টা সচল রাখার সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এজন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। বন্দরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সব প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
বন্দরের কোনো ধরনের কার্গো ও গাড়ি যাতে কোথাও পুলিশি বাধার মুখে না-পড়ে, তা নিয়েও প্রশাসনের সঙ্গে কথা হয়েছে। এ কারণে লকডাউনে বন্দরের পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে কোনো ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।
মঙ্গলবার বিকালে যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান এ কথা জানান। এ সময় লকডাউনে বন্দর সচল রাখার জন্য গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগ ও প্রস্তুতির কথাও তুলে ধরেন তিনি।
এদিকে বন্দরের পাশাপাশি দেশের রাজস্ব আদায়ের প্রধান সূতিকাগার চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ লকডাউন চলাকালে খোলা রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্টসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলোকে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে অবহিত করেছে।
বন্দর ও কাস্টম সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ৯২ শতাংশই হয়ে থাকে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। রাজস্বের সিংহভাগ জোগান দেয় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ। তাই অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে এই বন্দরের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একদিন বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম বন্ধ থাকলে কনটেইনারের যেমন জট লাগে তেমনি পণ্য ছাড় না-হলে রাজস্ব আদায়েও ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বন্দরে প্রতিদিন গড়ে সাত হাজার কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়। আর রাজস্ব আদায় হয় দৈনিক হাজার কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, গত বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর এর ঢেউ এসে লাগে চট্টগ্রাম বন্দরেও। কমে যায় আমদানি-রপ্তানি। অনেক দেশ থেকেই তখন জাহাজ পাঠানো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আর ক্রয়াদেশ না-থাকায় তৈরি পোশাকসহ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাভাবিক রপ্তানিও ব্যাহত হয়। দেশে লকডাউন ঘোষণার পর সংকট আরও প্রকট হয়ে ওঠে।
শত শত টন পণ্য বন্দরের ইয়ার্ডে এসে জমা হলেও শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ডেলিভারি হয়নি যথাসময়ে। অপরদিকে বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও আক্রান্ত হতে থাকেন। তাদের মধ্যে ১৫ জন মারা যান। জাহাজ থেকে যেসব শ্রমিক সরাসরি পণ্য খালাসে নিয়োজিত থাকেন, গণপরিবহণ ও হোটেল-রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকায় তারাও কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত হতে সমস্যার সম্মুখীন হন।
এক পর্যায়ে দেখা দেয় শ্রমিক সংকট। বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু রাখাই তখন কষ্টকর হয়ে পড়ে। করোনা সংক্রমণে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের একাধিক কর্মকর্তাও করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বর্তমান কমিশনার মো. ফখরুল আলমসহ একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী আক্রান্ত হন। সব মিলিয়ে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহাজাহান যুগান্তরকে বলেন, লকডাউনেও চট্টগ্রাম বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম পুরোদমে সচল থাকবে। শুধু ক্লারিক্যাল পোস্টের ৫০ শতাংশ জনবল রোস্টার করে কাজ করবে। বন্দরের সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা লোকজনের শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করা হবে। এ ছাড়া ট্রাফিক যখন যত শতাংশ প্রয়োজন তত শতাংশ কাজে লাগানো হবে। এ জন্য যত ধরনের নির্দেশনার প্রয়োজন সব নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে কথা হয়েছে। কথা হয়েছে পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গেও। সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে সমন্বয়ের কাজটি এরইমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। বন্দর ও কাস্টসকেন্দ্রিক শিডিউল ব্যাংক ও এডি ব্রাঞ্চগুলো খোলা রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বন্দর থেকে বের হওয়া কোনো কার্গো যাতে পুলিশ না-আটকায়, বন্দরে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী যাতে বাধার সম্মুখীন না-হয়, সে বিষয়ে পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেছি।
বন্দরের গাড়ির জন্য স্টিকার সরবরাহ করা হয়েছে। এর পরও বন্দরের অপারেশনাল কাজ কোথাও কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হলে তাৎক্ষণিকভাবে যাতে তা সমাধান করা যায়, সে জন্য বন্দরের পরিচালক ট্রাফিকের সঙ্গে কথা বলে সমস্যার সমাধান বের করা যাবে। তাও না-হলে আমার (বন্দর চেয়ারম্যান) সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করেছি।
কাজের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের বিষয়টিও নিশ্চিত করেছি। বন্দর হাসপাতালের করোনা ইউনিটটিও প্রস্তুত আছে। বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কেউ করোনা আক্রান্ত বা অসুস্থ হলে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা যাতে হয়, সে বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সিংহভাগ কনটেইনার হ্যান্ডলিংকারী টার্মিনাল অপারেটর সাইফ পাওয়ার টেক-এর এমডি তরফদার রুহুল আমীন যুগান্তরকে বলেন, ‘বন্দর ২৪ ঘণ্টা চালু থাকবে। হ্যান্ডলিং কার্যক্রম পুরোদমে চালু রাখতে বন্দরের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরাও সম্পূর্ণ প্রস্তুত। নিজেদের কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের আনা নেওয়ার জন্য আমরা নিজস্ব পরিবহণের ব্যবস্থা করেছি। যাতে ‘লকডাউনে’ পথে কোথাও কেউ আটকা না-পড়েন। আশা করছি, লকডাউনের কারণে বন্দরের হ্যান্ডলিং কাজে কোনো প্রভাব পড়বে না।’
অন্যদিকে সিংহভাগ রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজও ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি একেএম আকতার হোসেন বলেন, ‘কাস্টম হাউজ খোলা রাখা হবে বলে আমাদেরকে জানিয়েছেন কাস্টমস কমিশনার ফখরুল আলম। করোনায় আক্রান্ত হয়ে বেশ কিছুদিন অসুস্থ থাকার পর গত রোববার থেকে অফিস করছি। আমরাও আমাদের আওতাভুক্ত এজেন্টদের নির্দেশনা দিয়ে বলেছি, পণ্যের শুল্কায়নসহ যাবতীয় কাজ স্বাভাবিক গতিতে চলবে কাস্টম হাউসে। তাই বুধবার (আজ) থেকে শুরু হওয়া ‘লকডাউনে’ যাতে কেউ ঘরে বসে না থাকেন। আমদানিকারক, শিপিং এজেন্ট, ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার, ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে পণ্য খালাসে সমস্যা হবে না বলে মনে করি।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন বলেন, ‘গত বছর ‘লকডাউনে’ বন্দর সচল ছিল। আশা করছি এবারও সচল থাকবে। তবে ব্যবহারকারী হিসাবে বলব, বন্দর ও কাস্টমসের কাজকর্ম এখনো পুরোপুরি অনলাইনভিত্তিক হয়নি। ডকুমেন্টেশনসহ বেশিরভাগ কাজই সশরীরে গিয়ে করতে হয়।
এসব কাজে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োজিত থাকেন, তারা যেন যাতায়াতে বাধার মুখে না পড়েন, তা দেখতে হবে। প্রয়োজনে বন্দর থেকে তাদের জন্য সাময়িক কোনো পরিচয়পত্রের ব্যবস্থা করতে হবে। তা না-হলে পণ্য জাহাজীকরণ, খালাস ও ডেলিভারি ব্যাহত হতে পারে। এ ছাড়া বন্দরের সক পর্যায়ে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে।’