ডেস্ক নিউজ
আমদানি ব্যয় কমেছে-রেমিট্যান্স বেড়েছে বর্তমান অর্থনৈতিক অস্থিরতা স্বীকার করেই সামনে এগোতে হবে : ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু সিদ্ধান্তের সুফল সামনে পাওয়া যাবে : ড
মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হ্রাস, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে ২০২২ সালের শুরুতে বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুতগতিতে বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ফেব্রুয়ারির শেষদিক থেকে পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে। রাশিয়া বা ইউক্রেন কেউই বাংলাদেশের জন্য বড় কোনো রফতানি গন্তব্য বা আমদানির সোর্সিং দেশ নয়। তবে বাংলাদেশ রফতানি প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য যে দেশগুলোর ওপর নির্ভর করে, সেসব দেশের জন্য রাশিয়া ও ইউক্রেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় বছরের শুরু থেকেই বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়ে। এই যুদ্ধের ফলে বিশ্ব সরবরাহ চেইন আরও ভেঙে পড়ে। ইউক্রেন-রাশিয়া-বেলারুশ অঞ্চল থেকে গম, ভোজ্যতেল, সার, তেল, গ্যাস সরবরাহ প্রায় বন্ধই হয়ে যায়। এই প্রেক্ষাপটে শুধু বাংলাদেশই নয়; জ্বালানির চড়া মূল্য, খাদ্য মূল্যস্ফীতিসহ সার্বিক মূল্যস্ফীতি সারা বিশ্বেই বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ইউরোপের অধিকাংশ দেশে মূল্যস্ফীতি বাড়ার পাশাপাশি আর্থিক মন্দা দেখা দিয়েছে। এই ধারাবাহিকতায় ভালো নেই দেশের অর্থনীতিও। সরকারি হিসেবে মে-জুন-জুলাই মাসে দেশে মূল্যস্ফীতির গড় ছিল ৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ। রেকর্ড মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভের নিম্নগতি এবং বাণিজ্য ঘাটতি- ত্রিমুখী চাপে পড়ে যায় আর্থিক খাত। এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে বিদ্যুৎ-গ্যাসের সঙ্কটে উৎপাদন ব্যাহত হওয়া, রফতানি আদেশ কমে আসা এবং সময়মতো পণ্য রফতানি করার সমস্যা। এ কারণে রফতানি বাণিজ্য কিছুটা শঙ্কায় আছে। তবে কয়েক মাস ধরে চাপে থাকা দেশের অর্থনীতিতে সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দ বাংলাদেশ নিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশ সঙ্কটে নেই; চলমান বৈশ্বিক সঙ্কটে সৃষ্ট অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে ওঠার শক্তি বাংলাদেশের আছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
আমদানি ব্যয় কমানো এবং প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স বাড়ার কারণে বৈশ্বিক সঙ্কটেও আশার আলো দেখছেন বিশ্লেষকরা। পাশাপাশি ডলারের ওপর তৈরি হওয়া চাপ কমে যাচ্ছে। খোলা বাজারে অবিশ্বাস্য দামে বিক্রি হওয়া ডলারের দামও কমে এসেছে ১০৮ টাকায়। দেশের অর্থনীতি আবারো ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে সঙ্কট কেটে যাবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তারা। তাদের মতে, করোনার প্রকোপ কমে যাওয়ার ফলে বৈশ্বিক বাণিজ্য আবার সচল হয় পুরোদমে। দেশের ব্যবসা খাতের পালে হাওয়া লাগায় বেড়ে যায় আমদানি। অবশ্য এ সময় রফতানিও বেড়েছে। তবে আমদানির হার বেশি হওয়ায় ব্যাপক চাপে পড়ে দেশের অর্থনীতি। এ সময়ে ব্যালেন্স অফ পেমেন্টের মধ্যে তফাৎ দাঁড়ায় ৩২ বিলিয়ন ডলারের বেশি। গেল ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি ব্যয় দাঁড়ায় ৮৪ বিলিয়ন ডলার যেখানে রফতানি আয় হয় ৫২ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া, গেল অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৭ বিলিয়নেরও বেশি ডলার বিক্রি করায় রিজার্ভ কমে যায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই রিজার্ভ থেকে এক অর্থবছরে এত ডলার বিক্রি করা হয়নি। এরপরও আমদানি ব্যয় বাড়া এবং ডলারের ব্যাপক চাহিদার কারণে বিশাল চাপ তৈরি হয় রিজার্ভে। ডলারের বাজারে ‘স্থিতিশীলতা’ আনতে নিয়মিত ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবারও কয়েকটি ব্যাংকের কাছে ৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে। সব মিলিয়ে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দুই মাস ১ দিনে (১ জুলাই থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে ২৫৬ কোটি ৯০ লাখ (২ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর এই ডলার বিক্রির চাপে আরও কমেছে রিজার্ভ।
যদিও দেশের অর্থনীতি নিয়ে নানা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে আশা জাগাচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। জুলাই মাসের পর আগস্টেও বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের গতি বেশ ঊর্ধ্বমুখী। জুলাইয়ের পর আগস্টেও ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাঠালেন প্রবাসীরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট সূত্রে জানা গেছে, আগস্ট মাসে ২০৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই অঙ্ক গত বছরের আগস্টের চেয়ে ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি। গত বছরের আগস্টে ১৮১ কোটি ডলার এসেছিল। আর চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দুই মাসের (জুলাই-আগস্ট) হিসাবে রেমিট্যান্স বেড়েছে ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ। গত বছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে এসেছিল ৩৬৮ কোটি ২০ লাখ ডলার। এই বছরের একই সময়ে এসেছে ৪১৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ২০৯ কোটি ৬৯ লাখ ১০ হাজার (প্রায় ২ দশমিক ১ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, আমদানিকারকরা আগস্টে এলসি পেমেন্ট করেছে ৫ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার, যা আগের মাসের ৭ দশমিক ৪২ বিলিয়নের চেয়ে প্রায় ২৫ শতাংশ কম। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মতে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমার আশঙ্কায় প্রয়জনীয় পণ্য ছাড়া অন্য সব ধরনের পণ্য আমদানিতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। এতে আমদানি ব্যয় কমে এসেছে অর্ধেকেরও বেশি। ফলে, প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি ছাড়া বিলাস পণ্য এবং অপ্রয়োজনীয় আমদানি কমেছে। পাশাপাশি প্রবাসী আয় বাড়ছে উল্লেখযোগ্য হারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, তারা বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কট স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছেন। নতুন গভর্নর বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন, যা এখন কাজ করছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। একই সঙ্গে চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই রেমিট্যান্সের ইতিবাচক ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই সময়ে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির খুবই দরকার ছিল। নানা পদক্ষেপের কারণে আমদানি ব্যয় কমতে শুরু করেছে। রফতানির পাশাপাশি রেমিট্যান্স বৃদ্ধির কারণে আশা করছি এখন মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। যদিও রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাড়ার পরও গত বৃহস্পতিবার দিন শেষে বাংলাদেশের রিজার্ভ ৩৯ দশমিক শূন্য পাঁচ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। আগামী সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) জুলাই-আগস্ট মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধের পর অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এই সূচক আরও কমে ৩৮ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
তবে আর্থিক খাতের বিভিন্ন সূচকে উন্নতির ধারা চলমান থাকলেই দেশের অর্থনীতি আবার স্থিতিশীল হবে বলছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, অর্থনীতির কয়েকটি সূচকে উন্নতি ইতিবাচক। তবে এই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। কারণ এক মাসের উন্নতিতে বলা যাবে না যে অর্থনীতির গতিধারা ঘুরে গেছে।
ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নেয়া বেশকিছু সিদ্ধান্ত খুবই ইতিবাচক ছিল অর্থনীতির জন্য। এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। সুফল পাওয়া যাবে সামনের মাসগুলোতে। তবে এভাবে আমদানি বন্ধ রেখে কতদিন চলতে পারবে তা নিশ্চিত নয়। বিলাস পণ্য আমদানিতে যে বাঁধা তা যেন নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখা হয়।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান বলেন, সরকার আমদানি ও রফতানি তদারকির যে কার্যক্রম পরিচালনা করছে তা অব্যাহত রাখতে হবে। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববাজারে কমে আসা পণ্যের দামের প্রভাব যাতে দ্রুত দেশের বাজারে দেখা যায়Ñ সেদিকে নজর দেয়ারও পরামর্শ দেন তিনি।
তবে সেন্টার পর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, বর্তমানে মূল্যস্ফীতি, টাকার বিনিময় হার ও সুদের হারÑ অর্থনীতির এই তিন চলকের মধ্যে সমন্বয় নেই। অর্থনৈতিক চাপ মোকাবিলায় সরকার কিছু সাশ্রয়ী পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু, কোনো সমন্বিত উদ্যোগ এখনো দেখা যাচ্ছে না।
জ্বালানির দাম বাড়ানো-কমানোর ঘটনা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়হীনতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ বলে মনে করেন তিনি বলেন, জ্বালানির দাম ৪০ শতাংশের বেশি বাড়িয়ে আবার পাঁচ টাকা কমানো হলো। দাম বাড়ানোর সময় সামগ্রিক হিসাব না করে শুধু একটি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। এই সিদ্ধান্তগুলো কোথায় হচ্ছে, কে নিচ্ছে, তা পরিষ্কার নয়Ñ হয়তো এসব সিদ্ধান্ত আমলারাই নিচ্ছেন। কারণ, জনপ্রতিনিধিরা এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত আছেন বলে মনে হয় না। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এসব কারণেই সিদ্ধান্ত বারবার পরিবর্তন করতে হয়। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানগুলো ও তাদের কাজের মধ্যে সমন্বয় নেই। এভাবে বাংলাদেশে যত সমস্যা আছে, তা আরও বেশি জটিল হয় সমন্বয়হীনতা ও দক্ষতার অভাবের কারণে। একই সঙ্গে দেশে বর্তমানে যে অর্থনৈতিক অস্থিরতা চলছে, তা স্বীকার করে নিয়ে সামনে এগোতে হবে।