মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহের পর থেকে আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ আছে করোনা ভাইরাসের মহামারির কারণে। প্রায় দু’মাসের অধিককাল ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে আছে এবং সেপ্টেম্বরের আগে খোলার কোনো সম্ভাবনা এখনও স্পষ্ট নয়। এই লম্বা সময় ধরে শিক্ষার্থীরা স্কুল এবং খেলার মাঠের বাহিরে অবস্থান করছে। এ সময়ের মধ্যে সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চলছে বা বিকল্প ব্যবস্থায় শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখার চেষ্ঠা করা হচ্ছে। সংসদ টিভির মাধ্যমে যেমন শিক্ষার্থীদের পাঠদান হচ্ছে, তেমনি অনলাইন শিক্ষায় বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে, যা সময়ের বিবেচনায় প্রশংসনীয় বটে। কিন্তু সমস্যা হলো, সব শিক্ষার্থীর রেডিও, টিভি, কম্পিউটার কিংবা ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ নেই। এমনকি পরিসংখ্যান বলছে, দেশের অর্ধেক শিক্ষার্থীও এসবের আওতায় নেই। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এক্ষেত্রে গ্রামের চেয়ে শহরের শিক্ষার্থীরা খানিকটা এগিয়ে থাকবে। গ্রামেও কেউ কেউ হয়ত এ সুযোগ পাবে বটে কিন্তু উল্লেখযোগ্য অংশই বঞ্চিত থাকছে। শিক্ষাদানের এ প্রক্রিয়া হয়ত খানিকটা সহায়ক কিন্তু কতটা কার্যকর তা নিয়েও ইতোমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। অন্যদিকে বন্ধুহীন হয়ে ঘরবন্দিত্বের কারণেও শিক্ষার্থীদের মনজগতেও তৈরি হচ্ছে সংকট ।
গ্রামীণ এবং শহুরে শিক্ষার মধ্যেকার যে বৈষম্য বিদ্যমান ছিল তা আরও বাড়বে বলে আপাত দৃষ্ঠিতে মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে করোনা পরবর্তি বিদ্যালয় খুলে দেওয়া হলেও অতি দরিদ্র ও পেটের দায়ে শিশুশ্রমের দিকে ঝুঁকে পড়বে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিশুরা। মোট শিক্ষার্থীর অন্তত ৩০ শতাংশ বা এর বেশি ঝড়ে পড়তে পারে বলে শিক্ষা নিয়ে কর্মরত সংগঠনসমূহ দাবী করছে। ফলে ঝড়েপড়াসহ শিশু শ্রম বৃদ্ধি পাবে। এ শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে না ফেরার আশঙ্কা বেশি। মহামারি-উত্তর পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক অবস্থার জন্য অনেক শিক্ষার্থীর পরিবারের পক্ষেই খাদ্য সংকটের পাশাপাশি শিক্ষা উপকরণ ক্রয় এবং শিক্ষাব্যয় নির্বাহ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। আর তাই খাবারের অভাবের জন্য তাদের পরিবার, শিক্ষার্থীদের শ্রম দিতে বাধ্য করবে। চলমান মহামারির ফলে অনেক গরিব পরিবার আরও বেশি অসহায় হয়ে পড়বে, কাজ হারাবে। সেক্ষেত্রে তাদের সন্তানদের স্কুলে না পাঠিয়ে তারা আয়মূলক কাজে পাঠাতে চাইবে। সংসারের আয় বাড়াতে চাইবে।
এই ঝড়েপড়া শিশুদের মধ্যে সর্বাধিক মেয়েশিশু থাকবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। করোনাজনিত কারণে যে দরিদ্র্যতা বাড়বে, তাতে পরিবারের প্রতিদিনের ব্যয় নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়বে। এর ফলে মেয়েশিশুদের শিক্ষা অব্যহত রাখা পরিবারের জন্য কঠিন হবে। পরিবারে মেয়েশিশুরা হয়ে উঠবে বোঝা। ফলে মেয়েশিশুদের বাল্যবিবাহের হার বাড়বে। পাশাপাশি করোনার কারণে ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পুষ্টিহীনতা বাড়বে বলেও ধারনা করা হচ্ছে। মোটকথা শিক্ষাব্যবস্থার একটি বড় অংশ শিক্ষার্থীরা পড়তে যাচ্ছে কঠিন চ্যালেঞ্জের মূখোমূখি। কিন্তু আমরা কেউ এটি প্রত্যাশা করি না যে, সরকারি এবং বেসরকারি দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার ফলে শিক্ষায় যে গতি এসেছে তা নিম্নমুখী হোক। শিশু শ্রমিক তৈরি হোক। ঝড়েপড়া আর বাল্যবিবাহের হার বাড়–ক। তাই সময় থাকতেই উদ্দ্যেগ গ্রহণ করতে হবে এবং তা শুরু করতে হবে এখন থেকেই।
শিক্ষা মন্ত্রনালয়কে এ সংকট মোকাবেলায় সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। স্কুলগুলো খোলার পড়ে সকল স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের পুরানো তালিকা ধরে তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য প্রাথমিকভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এছাড়াও স্থানীয় সরকারের উদ্যোগে স্কুল খোলার পূর্বে এলাকায় মাইকিং করে সকল শিক্ষার্থীদের যথাসময়ে স্কুলে উপস্থিত হবার আহব্বান জানানোসহ স্কুল খোলার প্রথম দিনে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, ম্যানেজিং কমিটির সদস্য, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি, বেসরকারি সংগঠনের প্রতিনিধি সহ উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ্য থেকে একজন করে প্রতিনিধির উপস্থিতিতে জরুরি সভার আয়োজন করা প্রয়োজন। এই সভা থেকে সকলকে সচেতন ও সরকারের এবিষয়ক নির্দেশনা পৌঁছে দেয়া হবে। স্কুলের অগ্রগামী শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের নিয়ে স্কুলভিত্তিক একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করা যেতে পারে। যারা প্রতিদিনের অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে তাদের স্কুলে ফিরিয়ে আনবেন। অন্যদিকে শিক্ষকদের দিয়ে ড্রপআউট এর শিকার হতে পারে এমন সম্ভাব্য শিক্ষার্থীদের একটি তালিকা তৈরি করে তাদের জন্য বৃত্তি বা দুপুরের খাবাবের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এর পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বেতন মওকুফ এর বিষয়টিও সরকারকে বিবেচনা করতে হবে। এছাড়াও যারা সরকারি বিভিন্ন সেফটিনেট কর্মসূচির আওতায় সুবিধাভূগি, তাদের সন্তানরা যাতে নিয়মিত স্কুলে যায় সে বিষয়ে তাদের নির্দেশনা পৌঁছে দিতে হবে। মোটকথা, শিক্ষা, সমাজসেবা, মহিলাবিষয়ক এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়ের সম্মিলিত উদ্যেগ প্রয়োজন হবে এসংকট মোকাবেলায়।
শিক্ষার্থীদের বিবেচনায় রেখে সরকারি, বেসরকারি সাহায্য বা ত্রাণ তৎপরতার চালানোসহ শিক্ষা উপকরণ সহজলভ্য করার পাশাপাশি পরীক্ষা পদ্ধতিও সহজতর করতে হবে। মনে রাখতে হবে হবে লম্বা সময়ের বিরতির পরে স্কুলে ফিরে শিক্ষার্থীরা যাতে করে কঠিন চাপের মূখে না পড়েন। এর পাশাপাশি স্থানীয় সরকারকে পুরো বিষয়টি মনিটরিং এর দায়িত্ব প্রদান করতে হবে, যাতে তারা সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারেন। সরকার নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করার পূর্বে অবশ্যই তার বর্তমানে বিদ্যমান শক্তির এবং সামর্থের ব্যবহার করতে হবে। এর পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ের সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। আসলে এগুলো হতে পারে একটি সাময়িক এবং তাৎক্ষণিক উদ্যোগ। এধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারলে সরকারের শুভইচ্ছার বহি:প্রকাশ ঘটবে।
আশু করনীয় এর পাশাপাশি এ সংকট মোকাবেলায় সরকারের সংশ্লিষ্ঠ মন্ত্রনালয়কে স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। অতি অবশ্যই এসব পরিকল্পনার সাথে শিক্ষক, স্থানীয় সরকার এবং বেসরকারি সংগঠনসমূহকে যুক্ত করতে হবে। কারণ সকলকে মনে রাখতে হবে এসব উদ্যোগ শুধুমাত্র শিক্ষা সংকট মোকাবেলার জন্য নয়। এ সংকট মোকাবেলার মধ্যে দিয়ে দারিদ্র্য দূরীকরণ, নারী পুরুষের মধ্যেকার বৈষম্য বিলোপ, দক্ষ্য জনশক্তি গড়ে তোলা সহ দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেবার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।
যেকোন দূর্যোগ বা সংকটকালে মানুষ বিপদে পড়ে একথা সত্যি। কিন্তু একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, এসব সংকট মানুষের মধ্যে নতুন ধরনের সম্ভাবনা এবং এই সাথে মানুষের মধ্যে নতুন ধরনের প্রানশক্তিরও সঞ্চার করে। মানুষকে বাঁচতে হবে। সামনে আগাতে হবে। সুতরাং সময় থাকতেই প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করে যদি তা সুষ্ঠভাবে বাস্তবায়নে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় তাহলে সাফল্য আসবেই আসবে। মনে রাখতে হবে রাত যত গভীর হয় ভোরের সম্ভাবনা তত বাড়ে।
লেখক পরিচিতি: উন্নয়ন কর্মী ও মুক্ত সাংবাদিক।