ডেস্ক নিউজ
২৬৩৬.৫৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে হবিগঞ্জ জেলা। এ জেলার উত্তরে সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলা, পূর্বে মৌলভীবাজার জেলা, দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য ও পশ্চিমে কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা।
সুফি সাধক হযরত শাহজালাল (রঃ) এর অনুসারী সৈয়দ নাছির উদ্দিন (রঃ) এর পূণ্যস্মৃতি বিজড়িত খোয়াই, করাঙ্গী সুতাং, বিজনা, রতœা প্রভৃতি নদী বিধৌত হবিগঞ্জ একটি ঐতিহাসিক জনপদের নাম। ঐতিহাসিক সুলতানসী হাবেলীর প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ সুলতানের অধঃস্তন পুরুষ সৈয়দ হেদায়েত উল্লাহর পুত্র সৈয়দ হবিব উল্লাহ খোয়াই নদীর তীরে একটি গঞ্জ বা বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। তার নামানুসারে হবিবগঞ্জ থেকে কালক্রমে তা হবিগঞ্জে পরিণত হয়। ইংরেজ শাসনামলে ১৮৬৭ সালে হবিগঞ্জকে মহকুমা ঘোষণা করা হয় এবং ১৮৭৮ সালে হবিগঞ্জ মহকুমা গঠন করা হয়। আসাম প্রাদেশিক সরকারের ২৭৩নং নোটিফিকেশনের মাধ্যমে ১৮৯৩ সালের ৭ এপ্রিল হবিগঞ্জ থানা গঠিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৬০ সালে সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন) এর অফিস স্থাপিত হয় এবং সর্বশেষ ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ জেলায় উন্নীত হয়। এর জেলার এদিকে হাওড়, অন্যদিকে পাহাড়। মাঝে রয়েছে শিল্পাঞ্চল।
বর্তমান সরকারের পদক্ষেপে বদলে গেছে হবিগঞ্জ। বেসরকারী উদ্যোগে গড়ে উঠছে বিশাল বিশাল শিল্প কারখানা। এরমধ্যে ১১টি বৃহৎ, মাঝারি ১৩২ ও ২৩৭৩টি ক্ষুদ্রে উৎপাদন অব্যাহত আছে। নির্মাণাধীন রয়েছে বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান। তাই শিল্পায়নে এসেছে বিপ্লব। এতে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৩ লাখ লোকের। পাশাপাশি সরকারী উদ্যোগে ৫শ’ ১১ একর জমিতে চুনারুঘাট উপজেলায় শিল্প এলাকা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গ্যাস, বিদ্যুত ও যোগাযোগ এই তিন খাত শিল্পকারখানা গড়ার উপযোগীসহ শিল্পবান্ধব পরিবেশের কারণে এই জেলাকে বেছে নিয়েছে বহুজাতিক রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের মৌলভীবাজারের শেরপুর থেকে হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলা পর্যন্ত ৮৫ কিলোমিটার সড়কের দুইপাশে গড়ে উঠছে শিল্প কারখানা। এ কারণে অনেকে বলছেন, খুব দ্রæত সময়ের মধ্যেই হবিগঞ্জে শিল্প বিপ্লব ঘটেছে। হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার ব্রাহ্মণডুরা, নূরপুর ও মাধবপুর উপজেলার বাঘাসুরা-নোয়াপাড়া ইউনিয়নে গ্যাস সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে প্রতিযোগিতামূলকভাবে গড়ে উঠে দেশী-বিদেশী নানা কোম্পানির কারখানা। আর তার সঙ্গে লাখ লাখ বেকার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
যদিও গ্যাস সংযোগের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে বাঘাসুরা ও অলিপুর এলাকায় স্কয়ার, প্রাণ, বাদশাসহ দেশী-বিদেশী বিভিন্ন কোম্পানি শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে উৎপাদন অব্যাহত রেখেছে। শুধু তাই নয়, গ্যাসের সুবিধা থাকায় দিন দিন নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। মাধবপুর উপজেলার কররা গ্রামে ২৬ বিঘা জমির ওপর প্রায় সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ হচ্ছে শতভাগ রফতানিমুখী ও স্বয়ংক্রিয় এসএম স্পিনিং মিল। এ মিলে প্রতিদিন উৎপাদন হয় ৩২ থেকে ৩৫ মেট্রিক টন সুতা। এরমধ্যে ৩০ হাজার স্পিন্ডেল কটন ও ২৪ হাজার স্পিন্ডেল সিনথেটিক সুতা উৎপাদন হচ্ছে। বছরে মিল থেকে ৪৫ মিলিয়ন ডলারের সুতা বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মিলে কর্মসংস্থান হয় প্রায় ২ হাজার লোকের। দেশী-বিদেশী যৌথ বিনিয়োগে এ মিলের উৎপাদন চলছে।
জানা যায়, আশির দশকে মাধবপুর উপজেলার নোয়াপাড়ায় সায়হাম টেক্সটাইলের মাধ্যমে শিল্পায়নের যাত্রা শুরু হয়। মহাসড়ক, রেল সড়কসহ উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, গ্যাস ও বিদ্যুতের প্রাচুর্য, সহজলভ্য শ্রমিক, কাঁচামালের সহজপ্রাপ্যতা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকায় ব্যাপকভাবে এ এলাকায় শিল্পায়ন শুরু হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা সবুজ মিয়া জানান, হবিগঞ্জ সদর উপজেলার নূরপুর ও মাধবপুর উপজেলার বাঘাসুরা, নোয়াপাড়া ইউনিয়নে স্কয়ার, প্রাণ, বাদশা ও বেঙ্গল গ্রæপসহ দেশী-বিদেশী বড় বড় কোম্পানি সেখানে শিল্প স্থাপন করেছে। আর তার সঙ্গে কর্মসংস্থান হয়েছে লাখ লাখ বেকার লোকের। অর্থনীবিদরা বলছেন, শিল্প প্রতিষ্ঠান হওয়ায় হবিগঞ্জ জেলা সমৃদ্ধ। যেভাবে শিল্প হচ্ছে, এক সময় সাভারে পরিণত হবে। সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা গেছে, হবিগঞ্জ সদর, শায়েস্তাগঞ্জ, বাহুবল, নবীগঞ্জ ও মাধবপুর উপজেলা এলাকার সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের দুইপাশের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বেসরকারী উদ্যোগে গড়ে উঠেছে শিল্প কারখানাগুলো।
২০০৩ সালে সিলেট-ঢাকা মহাসড়ক নির্মাণের পরই এই সড়কের দুই পাশের জমি কেনার প্রতিযোগিতা লেগে যায় শিল্প উদ্যোক্তাদের মাঝে। হবিগঞ্জ সদর উপজেলার অলিপুর এলাকায় প্রায় ৩০০ একর জমির ওপর গড়ে উঠেছে হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক। প্রাণ-আরএফএল গ্রæপ এই পার্ক থেকে উৎপাদিত পণ্য বিভিন্ন দেশে রফতানি করে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে হবিগঞ্জের শিল্প বিপ্লবে সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে বলে জেলা প্রশাসন জানিয়েছে। এখানে আগে প্রতি বিঘা জমি মিলতো যে দামে, এখন প্রতি শতকের দাম তার চেয়েও বেশি। ফলে বদলে গেছে এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার মানও। দূর হচ্ছে বেকার সমস্যা। সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের দুইপাশে জমিতে গড়ে উঠছে বিশাল শিল্প কারখানা। এসব জমিতে দ্রæত শিল্পায়নের ফলে জমির দাম কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গেছে।
মাধবপুর জগদিশপুর এলাকার জমির মালিক মোস্তফা আহমদ বলেন, শিল্পায়ন হওয়ার আগে প্রতি বিঘা বিক্রি হতো ১ লাখ ২০ হাজার টাকায়। বর্তমানে প্রতি শতক বিক্রি হচ্ছে ২ থেকে ৩ লাখ কিংবা তার চেয়েও বেশি। দেশের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এসব শিল্প গড়ে তুলছে। এতে শুধু বেকার অসহায় নারী-পুরুষ নয়, প্রতিবন্ধী মানুষের ভাগ্যের চাকা বদলে যাচ্ছে। এর ফলে শুধু সিলেট অঞ্চল নয়, অন্যান্য এলাকার মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম বিভাগের কিয়দংশ এবং ঢাকা বিভাগের কিয়দংশের চেয়েও হবিগঞ্জ অধিক আলোকিত হবে বলে মনে করেন অনেকেই।
হবিগঞ্জ গ্যাস ফিল্ড, বিবিয়ানা আর রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্র থেকে জাতীয় সঞ্চালন লাইনে ৫.৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (প্রায়) গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। একইভাবে হবিগঞ্জের ৬টি বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র থেকে ১ হাজার ৬৭৫ মেগাওয়াট বিদ্যুত সরবরাহ হচ্ছে জাতীয় গ্রিডে।
শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, শিল্পবান্ধব পরিবেশ বলতে যা বোঝায় তার পরিপূর্ণতা এখানে খুঁজে পাওয়ায় সবার দৃষ্টি এখন হবিগঞ্জে। এছাড়া মাধবপুর উপজেলার আইনশৃঙ্খলা অনেক ভালো এবং বর্তমান সরকার শিল্পায়নের দিকে নজর দিচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় প্রায় ৮৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ইতোমধ্যে অর্ধশতাধিক ভারি ও মাঝারি শিল্প, বিদ্যুত কেন্দ্র, গ্যাসক্ষেত্র গড়ে উঠেছে। কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৩ লাখ মানুষের। ২৯৫ বর্গকিলোমিটারের প্রায় সাড়ে ৩ লাখ জনবসতির মাধবপুর উপজেলার বুক ছিড়ে গেছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক। রেল ও সড়ক পথের উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং গ্যাস ও বিদ্যুতের উৎসস্থল হওয়ায় শিল্প কারখানাগুলোতে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ সুবিধা থাকায় মহাসড়কের উভয়পাশে গড়ে উঠছে শিল্পকারখানাগুলো। উপজেলার হাড়িয়া থেকে বাঘাসুরা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার এলাকাকে শিল্পাঞ্চল ঘোষণা দিয়ে শিল্প পুলিশ ক্যাম্প এবং আবাসিক গ্যাস সংযোগ স্থাপনের দাবি জানিয়ে ২০১২ সালের ৪ আগস্ট তৎকালীন জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেন গণদাবি বাস্তবায়ন পরিষদের পক্ষে আহŸায়ক মুহাম্মদ সায়েদুর রহমান। শেরপুর থেকে মাধবপুর পর্যন্ত ৮৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পুরোপুরি উৎপাদনশীল কারখানা স্থাপিত হলে প্রায় ৭ থেকে ১০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান তৈরি হবে বলে মনে করছেন উদ্যোক্তরা। গতি এসেছে হবিগঞ্জ বিসিক শিল্প নগরীতেও। সেখানে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠানে নানা পণ্য উৎপাদন হচ্ছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে কর্মসংস্থানও। কমেছে বেকারত্ব।
বর্তমান সরকারের তিন মেয়াদে ঘরে ঘরে বিদ্যুত ॥ ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসে। এরপর শুরু হয় ঘরে বিদ্যুত সংযোগ। সেই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালের আগস্ট মাস থেকে চলতি বছরের এ পর্যন্ত হবিগঞ্জ জেলাজুড়ে প্রায় ৩ লাখ ৭৯ হাজার ৫৭৮টি বিদ্যুত সংযোগ প্রদান করেছে হবিগঞ্জ পল্লী বিদ্যুত সমিতি। এ তথ্য জানালেন, সমিতির সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার মোঃ মোতাহার হোসেন। তিনি জানান, মোট বিদ্যুতের গ্রাহক সংখ্যা ৪ লাখ ৯০ হাজার ৪৫৬ জন। মোট লাইন নির্মাণ হয়েছে ৭ হাজার ৮০৮ কিলোমিটার। জানা গেছে, বিদ্যুত সংযোগ সহজে পাওয়ায় জেলার যোগাযোগের কেন্দ্রস্থলে একের পর এক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। সেই সঙ্গে জেলাজুড়ে ঘরে ঘরে বিদ্যুতে আলোকিত হয়েছে। বিদ্যুত সুবিধা কাজে লাগিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে জীবনমানে এসেছে বিরাট অগ্রগতি।
হবিগঞ্জ বিসিকে হাজারও লোকের কর্মসংস্থান ॥ সকাল হলেই দলে দলে লোক আসেন, আবার বিকেল হলে তারা ফিরে যান। সারাদিন তাদের কর্মচাঞ্চল্যে মুখর হবিগঞ্জ বিসিক শিল্পনগরী। এখানকার ৪২টি ক্ষুদ্র কলকারখানায় কাজ করছেন হাজারও লোক। তারা এখন স্বাবলম্বী, সংসারে এসেছে সুখ-সমৃদ্ধি। তাদের চোখেমুখে এখন সোনালি স্বপ্ন। আর এখানে উৎপাদিত পণ্য যাচ্ছে বিভিন্ন স্থানে।
হবিগঞ্জ জেলা কারাগারের কাছেই প্রায় ১৫ একর জমিতে বিসিক শিল্পনগরীর অবস্থান। ১৯৮৬ সালে এটি স্থাপিত হয়। বাস্তবায়নকাল ছিল ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত। শুরুতে এখানে হাতেগোনা কয়েকটি কারখানার কাজ শুরু হয়। এখানে কারখানা স্থাপনে তেমন একটা আগ্রহী ছিলেন না উদ্যোক্তারা। তারপরও কর্তৃপক্ষ উদ্যোক্তাদের নানাভাবে উৎসাহ জোগান। এতে তারা ধীরে ধীরে কারখানা স্থাপন শুরু করে। গ্যাস, বিদ্যুত, পানি ও সড়ক যোগাযোগের সহজলভ্যতাকে কাজে লাগিয়ে মুড়ি, চিড়া, কৃষিপণ্য, কনফেকশনারি খাবার, ময়দার মিল, দরজা-জানালা, কাপড়, মবিল, টায়ার তৈরির কারখানাসহ ৪২টি শিল্পকারখানা স্থাপন করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান হয়েছে হাজারও লোকের। এছাড়া আরও ১০টি কারখানার নির্মাণ কাজ প্রক্রিয়াধীন। এসব প্রতিষ্ঠান স্থাপন হলে আরও এক হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে।
রেলওয়ে জংশন থেকে শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলা ॥ দেশেজুড়ে পরিচিত নাম শায়েস্তাগঞ্জ রেলওয়ে জংশন। এ জংশন থেকে বিভিন্ন ট্রেন যোগে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে শত শত যাত্রী যাতায়াত করে থাকেন। জংশনটি ১৯০৩ সালে প্রতিষ্ঠা পায়। সেই থেকে এ পর্যন্ত জংশনটি হবিগঞ্জের ঐতিহ্য বহন করছে। প্রথমে এ জংশনকে ঘিরে গড়ে উঠে হাট-বাজার। হবিগঞ্জ জেলা প্রতিষ্ঠা পেলে ক্রমান্বয়ে শায়েস্তাগঞ্জ ইউনিয়ন হয়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে ১৯৯৯ সালে শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভা প্রতিষ্ঠা পায়। এরপর ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠা হয় থানা। সর্বশেষ ২০১৭ সালে শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলা হয়।
করোনার মধ্যেও বাগানে চায়ের উৎপাদন অব্যাহত ॥ সেপ্টেম্বর মাস চলছে। বৃষ্টির সঙ্গে হবিগঞ্জের বাগানগুলোর চা গাছে কুঁড়ি গজায়। তৈরি হয় সবুজের সমারোহ। এতে শ্রমিক থেকে মালিক পর্যন্ত সবার মধ্যে উৎসাহ দেখা দেয়। বাগানে মূলত চা বিক্রির অর্থেই পুরো বছরের খরচ বহন হয়। গাছে গাছে চা পাতার একেকটা কুঁড়ি যেন মালিক ও শ্রমিকের কাছে মূল্যবান সম্পদ। তারা এ কুঁড়ির মাঝেই এগিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে বেড়ান। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হবে, গাছে গাছে কুঁড়ি গজাবে। কুঁড়ি যত বেশি সংগ্রহ হবে, বাড়বে উৎপাদন। আসবে অর্থ।
এগিয়ে যাওয়ার আশা নিয়ে জেলার বাহুবল উপজেলার আমতলী চা বাগানে ২৮ মার্চ থেকেই এ মৌসুমের উৎপাদন শুরু হয়। করোনায় শ্রমিকরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে উঁচু ও ঢালু পাহাড়ী জমি থেকে চা পাতা সংগ্রহ করছেন। পরে প্রক্রিয়াজাতের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ফ্যাক্টরিতে। সময়ের সঙ্গে এ বাগানের চারপাশে সবুজের সমারোহে শ্রমিকরা মনের আনন্দে কাজ করছে।
যদিও দেশের সিলেট, চট্টগ্রাম ও পঞ্চগড়ে ৭টি ভ্যালির মাধ্যমে প্রায় ২৫৬টি বাগানে চা উৎপাদন হয়ে আসছে। দেশের অন্যান্য বাগানসহ সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেট জেলায় অবস্থিত বাগানগুলোতে ব্যাক ‘টি’ উৎপাদন হচ্ছে ব্রিটিশ আমল থেকে। সেই সময় থেকে বছরের মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে চা-পাতার উৎপাদন শুরু হচ্ছে, সমাপ্ত হয় ডিসেম্বর মাসে। উৎপাদন শেষ হলে চা-পাতার গাছগুলোর নানাভাবে পরিচর্যা করা হয়ে থাকে।
প্রতি মৌসুমে হবিগঞ্জের বাগানগুলো প্রায় দেড় কোটি কেজি চা-পাতা উৎপাদন করে। নতুন করে চারা রোপণ করে চা-পাতার উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বাগান কর্তৃপক্ষগুলো নানাভাবে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। নিয়মমাফিক বৃষ্টির সঙ্গে রয়েছে চা-পাতা উৎপাদনের সম্পর্ক। এখানে অতি বৃষ্টি হলে হবে না। নিয়ম অনুযায়ী বৃষ্টির সঙ্গে উৎপাদনের ভাল-মন্দ নির্ভর করে। এছাড়াও চা-পাতার উৎপাদন বাড়াতে বাগান কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ শ্রমিকদের আন্তরিকতা বিরাট ভ‚মিকা রাখে। বৃষ্টির সঙ্গে সম্পর্ক রেখে হবিগঞ্জের ছোট বড় মিলে প্রায় ৪১টি বাগানে চা পাতার উৎপাদন চলছে।
হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজ ॥ ৫১ শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু হয় হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজের। ২০১৮ সালের ক্লাস শুরুর মাধ্যমে শুরু হয় নবনির্মিত এই মেডিক্যাল কলেজের পথচলা। মেডিক্যাল কলেজ সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি অনুমোদন পায় এই মেডিক্যাল কলেজ। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পান ডাঃ মোঃ আবু সুফিয়ান। তিনি দায়িত্ব নিয়ে কাজ শুরু করলেও ক্লাস নেয়ার স্থানের অভাবে এ বছর শিক্ষার্থী ভর্তিতে অনুমোদন পায়নি। অবশেষে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে ৫১ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। এর মাঝে ৩৩ জন ছাত্রী ও ১৮ জন ছাত্র ছিল। আপাতত তাদের ক্লাস শুরুর জন্য নবনির্মিত ২৫০ শয্যা হাসপাতালের ২য় ও ৩তলা নির্ধারণ করা হয়।
হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ॥ চলতি বছরের মার্চে হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন অধ্যাপক ড. মোঃ আবদুল বাসেত। রাষ্ট্রপতির এক আদেশে তাকে এ নিয়োগ প্রদান করা হয়। তিনি সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিসম্পদ উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক।
হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০২০ এর ১০ (১) এর ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মোঃ আবদুল বাসেতকে হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে চারবছর মেয়াদে নিয়োগ প্রদান করেন। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে উপসচিব মোঃ নূর-ই-আলম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে উপাচার্য নিয়োগের এ খবর প্রকাশ করা হয়।
অধ্যাপক ড. মোঃ আবদুল বাসেত ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ও ২০১২ সালে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। শিক্ষা ও গবেষণার পাশাপাশি ড. বাসেত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্যসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
বাংলাদেশের হাওড় অঞ্চল খ্যাত বৃহত্তর সিলেটের হবিগঞ্জ জেলায় দেশের সপ্তম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আইনগত অনুমোদন হয় গতবছরের ১০ সেপ্টেম্বর। ২০১৪ সালের ২৯ নবেম্বর হবিগঞ্জ নিউফিল্ডে বিশাল জনসভায় জেলাবাসীর পক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট চারটি বড় দাবি উপস্থাপন করেছিলেন জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এ্যাডভোকেট মোঃ আবু জাহির এমপি।
দাবিগুলো ছিল হবিগঞ্জে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ও বাল্লা স্থলবন্দর স্থাপন এবং শায়েস্তাগঞ্জকে উপজেলা বাস্তবায়ন করা। অন্যান্য দাবিগুলো কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বিল পাস হওয়ার আগেই বাস্তবায়িত হয়।
নাম তার সাগর দিঘী ॥ দেখতে অনেকটা সাগরের মতো। নাম তাই সাগরদিঘী। আবার কারও কাছে ‘কমলারানীর দিঘী’ এবং ‘কমলাবতীর দিঘী’ হিসেবেও পরিচিত। এ দিঘী স্বচ্ছ জলে ছোট ছোট ঢেউয়ের ওপর সূর্যের আলো নেচে বেড়ায়। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন ছোট ছোট প্রদীপ ভাসছে। বর্ষায় এর ঝলমলে রূপ আরও দৃষ্টিনন্দন হয়ে ওঠে।
সাগরদিঘীর চারপাশের পাড়কে ঘিরে একেকটি গ্রাম গড়ে উঠেছে। পূর্ব পাড়ে পূর্বপাড় গ্রাম। পশ্চিম পাড়ে এল আর সরকারী উচ্চবিদ্যালয় ও বিশাল সবুজ মাঠ। স্কুলের ঠিক দক্ষিণেই ‘লাউড় রাজ্যে’র সময়কার স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ, পুরাকৃর্তি পাথরের দাড়া-গুঁটি। উত্তর পাড়ে উত্তরপাড় গ্রাম ও মাদারিঢোলা গ্রাম। দক্ষিণে দক্ষিণপাড় গ্রাম।
দিঘীটি হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলা সদরে অবস্থিত। জেলা সদর থেকে দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার। যাতায়াতে সময় লাগে ২৫ থেকে ৩০ মিনিট। ৬৬ একরের এ দিঘী দেখতে দেশের নানা জায়গা থেকে অসংখ্য মানুষ আসেন। আয়তনের দিক থেকে দিঘীটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জলাধার হিসেবে স্বীকৃত।
বৃহদায়তনের এ জলাধার নিয়ে এলাকায় নানা আলোচনা আছে। দ্বাদশ শতাব্দীতে সামন্ত রাজা পদ্মনাভ প্রজাদের জলকষ্ট নিবারণের জন্য এশিয়ার বৃহত্তম গ্রাম বানিয়াচংয়ের মধ্যভাগে এ বিশাল দিঘী খনন করেন। এ দিঘী খননের পর পানি না ওঠায় স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে রাজা পদ্মনাভের স্ত্রী রানী কমলাবতী এ দিঘীতে নিজেকে বিসর্জন দেন বলে একটি উপাখ্যান প্রচলিত আছে। এ জন্য এ দিঘীকে কমলারানীর দিঘীও বলা হয়ে থাকে।
এ দিঘীর কাহিনী নিয়ে বাংলা ছায়াছবিসহ রেডিও মঞ্চনাটক রচিত হয়েছে। পল্লীকবি জসীমউদ্দীন বানিয়াচং পরিদর্শনকালে নয়নাভিরাম সাগরদিঘীর প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ‘রানী কমলাবতীর দীঘি’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। কবিতাটি তার সূচয়নী কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। দিঘীটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দিঘী হিসেবে খ্যাত। (সূত্র- জেলা প্রশাসনের পাহাড় টিলা হাওড় বন পর্যটনবিষয়ক প্রকাশনা)
দিঘীটি এরশাদ সরকারের আমলে ১৯৮৬ সালে পুনর্খনন করান তৎকালীন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী সিরাজুল হোসেন খান। দিঘীটি বর্তমান সরকারের অনুক‚লে থাকলেও দিঘীর চার পাড়ের বাসিন্দারা এটিতে মৎস্য চাষ করে ভোগদখল করছেন। তবে স্থানীয় লোকজন এ দিঘীকে সংস্কার করে পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্তের দাবি তুলেছেন।