ডেস্ক নিউজ
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরায় সম্প্রতি মুসলিমদের বাড়িঘর ও মসজিদে হামলার মতো ঘটনা অবিলম্বে বন্ধ না হলে ত্রিপুরা তথা সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে এর পরিণাম ভোগ করতে হবে বলে সতর্ক করে দিলেন সুপরিচিত রাজনীতিবিদ প্রদ্যোত মানিক্য দেববর্মা। ত্রিপুরা রাজপরিবারের এই উত্তরাধিকারীর মতে, সম্প্রতি বাংলাদেশে যারা হিন্দুদের পূজামণ্ডপ ও বাড়িঘরে হামলা চালিয়েছে এবং তারপর ত্রিপুরাতেও মুসলিমদের যারা আক্রমণের নিশানা করেছে, তাদের লক্ষ্য একটাই– ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্কের অবনতি এবং শেখ হাসিনা সরকারকে অস্থিতিশীল করে তোলা।
এক সাক্ষাৎকারে প্রদ্যোত মানিক্য দেববর্মার মন্তব্য, ‘কিন্তু শেখ হাসিনা সরকার এতটুকু দুর্বল হলেই বাংলাদেশের কিছু ফ্রিঞ্জ এলিমেন্ট হিন্দুদের ওপর হামলা চালাবে এবং তারা তখন ত্রিপুরা বা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে চলে আসতে বাধ্য হবে। সেই পরিস্থিতি এড়াতে হলে আমাদের সতর্ক হতে হবে এখনই।’
ত্রিপুরায় সাম্প্রদায়িক হামলা নিয়ে ভারতের জাতীয় গণমাধ্যমগুলো কার্যত নীরব। বিরোধী দলগুলোও প্রতিবাদে তেমন সোচ্চার হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে রাজা প্রদ্যোত মানিক্য দেববর্মার সতর্কবাণী অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে। তিনি আগে কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রাহুল গান্ধীর সঙ্গেও ব্যক্তিগত স্তরে ভালো ঘনিষ্ঠতা ছিল তার। তবে বছরদুয়েক আগে কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ‘টিপরা’ নামে উপজাতীয় দলগুলোর একটি আলাদা জোট গড়ে তোলেন তিনি। একটি সর্বভারতীয় চ্যানেলের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ এখানে তুলে ধরা হলো।
প্রশ্ন: ত্রিপুরায় মুসলিম সম্প্রদায় আক্রান্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। কিন্তু রাজ্য সরকারে দাবি, তেমন কোনও ঘটনাই ঘটেনি। বরং তারা প্রতিবাদকারীদেরই কণ্ঠরোধ করতে চাইছে…
রাজা প্রদ্যোত মানিক্য দেববর্মা: এটা ঠিকই যে, ত্রিপুরায় এসব সাম্প্রদায়িক সহিংসতার যথেষ্ট প্রতিবাদ হচ্ছে না। আমি যখন ২০১৯ সালে কংগ্রেস ছাড়ি, তার পেছনে প্রধান কারণ ছিল ওই দলটি ত্রিপুরায় নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে তেমন প্রতিবাদ করছিল না। আজকের ত্রিপুরাতেও মুসলিমদের যে ক্রমাগত আক্রমণের নিশানা করা হচ্ছে, কংগ্রেস বলুন বা সিপিএম-তৃণমূল, কোনও বিরোধী দলই কিন্তু এর বিরুদ্ধে সেভাবে মুখ খুলছে না। আসলে ত্রিপুরায় সব দলেরই লক্ষ্য হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি হিন্দুদের ভোট পাওয়া। সেজন্যই ১০ শতাংশ মুসলিমের ওপর আক্রমণের বেলায় তারা নীরব। দিল্লিতে তাদের নেতারা টুইট করেই দায় সারছেন, অন্যদিকে ত্রিপুরায় সিপিএমের মানিক সরকার কিংবা কংগ্রেস-তৃণমূলের নেতানেত্রীরা একটিও কথা বলছেন না। সবাই আসলে ভোটব্যাংকের রাজনীতি নিয়েই ব্যস্ত।
২০১২ সালে ত্রিপুরা সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
প্রশ্ন: ত্রিপুরায় তো এর আগে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক সংঘাতের কথা কখনো শোনাই যায়নি?
রাজা প্রদ্যোত মানিক্য: এটি একদম শতভাগ সত্যি কথা। আমাদের রাজ্য আগে কখনও এরকম সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দেখেনি। বরং ত্রিপুরার হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির একটি গৌরবময় ইতিহাস আছে। অনেকেই জানে না, মোগল আমলে শাহজাদা সুজা যখন ত্রিপুরায় এসেছিলেন তখন আমার পূর্বপুরুষ, ত্রিপুরার রাজারা তার জন্য আলাদা মসজিদ পর্যন্ত বানিয়ে দিয়েছিলেন। ত্রিপুরা তখন রাজাদের শাসনে একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। কিন্তু এখন দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে কৃত্রিম বিভেদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এর পুরোটাই করা হচ্ছে ভোট ব্যাংকের রাজনীতির জন্য। বিষয়টা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।
প্রশ্ন: অনেকে বলছেন, ত্রিপুরায় যা ঘটেছে সেগুলো বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার জেরে হয়েছে…
রাজা প্রদ্যোত মানিক্য: দেখুন, এখানে আগে বলি প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে আমরা সবসময় ভারতের পরম বন্ধু হিসেবে দেখি। ত্রিপুরাবাসীর মনেও শেখ হাসিনার জন্য একটা বিশেষ শ্রদ্ধা ও মর্যাদার জায়গা আছে, শেখ হাসিনার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর বড় একটা কারণ। মুক্তিযুদ্ধের সময় লাখ লাখ বাংলাদেশিকে আশ্রয় দিয়েছিল ত্রিপুরা, নিজেদের থালার ভাত তাদের সঙ্গে ভাগ করে খেয়েছিল– এই ইতিহাস কেউ মুছতে পারবে না।
মহারাজা প্রদ্যোত মানিক্য দেববর্মা
আজ যখন দেখি বাংলাদেশে বা আমাদের ত্রিপুরায় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটছে, তখন কিন্তু বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না সীমান্তের দুই দিকেই এই হামলাকারীরা চায় না বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের উন্নতি হোক। বরং তারা চায় শেখ হাসিনা সরকারকে অস্থিতিশীল করে তুলতে, দুর্বল করতে।
কিন্তু শেখ হাসিনা সরকার দুর্বল হলে কী ঘটবে? তার দেশের কিছু ফ্রিঞ্জ এলিমেন্ট তখন হিন্দুদের ওপর আক্রমণ করার সুযোগ পাবে। সেই হিন্দুরা ত্রিপুরা ও ভারতের অন্য রাজ্যগুলোতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হবেন। গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলেই তখন বাঙালি হিন্দুদের সঙ্গে উপজাতীয়দের জমি ও জীবিকা নিয়ে নতুনভাবে সংঘাত শুরু হবে, যা আমাদের পুরো অঞ্চলের জন্যই সর্বনাশ ডেকে আনবে। তাই আমাদের নিজেদের স্বার্থেই বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের হাত শক্ত করতে হবে– এটাই আসল কথা।