বৈশ্বিক মহামারি করোনা পরিস্থিতিতে দেশের শ্রমবাজারে বড় ধাক্কা লেগেছে। ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে বিদ্যমান বৈদেশিক কর্মসংস্থান। রেমিট্যান্সে এখনো এর প্রভাব না পড়লেও লক্ষণ ভালো নয়। করোনাকালীন সময়ে কয়েক লাখ শ্রমিক কাজ হারিয়ে দেশে ফেরত এসেছেন। নতুন করে যাদের যাওয়ার কথা ছিল, সেই সংখ্যাও মারাত্মকভাবে কমে গেছে। তাই বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাতে আগামীতে যেকোনো ধস ঠেকাতে কৌশল খুঁজছে সরকার। এর অংশ হিসাবে বিদেশফেরতদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ও প্রণোদনা দেয়ার পাশাপাশি নতুন শ্রমবাজারে আগ্রহ রয়েছে সরকারের। এর মধ্যে ৬টি দেশে শ্রম রপ্তানির ব্যাপারে কাজ শুরু করেছে পররাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্ত হওয়ার পক্রিয়াও প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, দেশের অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়; এর বাইরেও বিকল্প শ্রমবাজার খুঁজছে সরকার। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন- কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে তেলনির্ভর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কাজের সুযোগ কমে যেতে পারে।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক মো. শামসুল আলম জানান, নতুন যেসব দেশে সম্ভাবনা দেখছে বাংলাদেশ- সেগুলোর মধ্যে রয়েছে মধ্য এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের দেশ রোমানিয়া, উজবেকিস্তান এবং কাজাখস্তান। এছাড়াও জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং হংকং এর কথাও ভাবা হচ্ছে। তিনি জানান, মরুভ‚মির চেয়ে এসব দেশে আবহাওয়া সহনীয়। তাছাড়া এসব দেশে কাজগুলোর ধরন ভালো, শুধু ক্লিনারের কাজ নয়। বেতনও বেশি, আবার শ্রমিকদের অধিকারের পরিস্থিতিও ভালো। মো. শামসুল আলম বলেন, জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি সমঝোতা স্বারক সই হয়েছিল। ‘আই অ্যাম জাপান’ নামে একটি কোম্পানি ঢাকায় বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করছে। তারা ভাষা প্রশিক্ষণ দিয়ে, কর্মী নির্বাচন করে জাপানে বিভিন্ন কোম্পানি, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ফ্যাক্টরির কাজ নিজেরাই শিখিয়ে নিয়োগ দিচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়াতে সরকারিভাবে ইতোমধ্যেই অনেকে গেছেন। বাংলাদেশি কর্মীদের সেখানে কাজের জন্য ইপিএস নামে বিশেষ ভিসা রয়েছে। সরকারি রিক্রুটিং এজেন্সি বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিসেস প্রশিক্ষণ দিয়ে ইতোমধ্যেই অনেককে দক্ষিণ কোরিয়া পাঠিয়েছে- যারা নানা কোম্পানি ও উৎপাদনকারী কারখানায় কাজ করছেন। জাপানের মতো দক্ষিণ কোরিয়াও নিজেরা ভাষা ও দক্ষতা তৈরি করে, খরচ দিয়ে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়। মো. শামসুল আলম বলেন, আরো কর্মী নিতে আগ্রহী দক্ষিণ কোরিয়া। সেখানে স্যামসাং ও দাইয়ুর মতো প্রতিষ্ঠানের কারখানায় বাংলাদেশিরা কাজ করছেন। কৃষিতেও কাজ করছেন বাংলাদেশিরা।
তিনি বলেছেন, নতুন দেশগুলোতে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। কেউ যেন দেশগুলোর নাম শুনেই যাওয়ার চেষ্টা না করে। অসাধু চক্রের খপ্পরে পড়ে মানবপাচারের শিকার যেন না হয়; এজন্য আমরা দেখে শুনে এগুচ্ছি।
এদিকে অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করে এ রকম সংস্থা রামরুর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, ২০২৫ সাল পর্যন্ত জাপান সারা বিশ^ থেকে ৫ লাখ কর্মী নেবে। বাংলাদেশকে এই বাজারটা ধরতে হবে। যারা জাপানিজ ভাষা জানবে ও সেখানকার সংস্কৃতি সম্পর্কে জানবে তাদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে। তিনি আরো জানিয়েছেন, গত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ২ হাজারের মতো শ্রমিক বিদেশে কাজে গেছেন। তার মধ্যে আটশই মধ্য এশিয়ার দেশ উজবেকিস্তানে। সেখানে মধ্যপ্রাচ্যের দেশের থেকে তারা বেশি বেতন পাচ্ছেন। তবে সেখানে যেতে হলে কমপক্ষে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা থাকতে হবে। ঠিক কী কাজে সেখানে যাচ্ছেন বাংলাদেশিরা সেটি পরিষ্কার নয়।
অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী আরো বলেন, করোনা ভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর একটি বিষয় স্পষ্ট- পৃথিবীর অনেক দেশে স্বাস্থ্যসেবা খাতে কর্মী দরকার। তার তথ্যমতে নার্স এবং ল্যাব টেকনিশিয়ানের চাহিদা রয়েছে প্রচুর। তিনি বলেন, পুরনো গন্তব্যগুলোতেও নতুন কাজের সুযোগ রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে স্বাস্থ্য খাতে অনেক বিনিয়োগ হচ্ছে। যে নতুন গন্তব্যের দেশগুলোতে সুযোগ রয়েছে সেখানকার ভাষা শিক্ষার ওপর জোর দিচ্ছেন অভিবাসীদের নিয়ে যারা কাজ করে তাদের সবাই। সেই সঙ্গে জানা দরকার ইংরেজিও। তাসনিম সিদ্দিকীর মতে, যাওয়ার আগে কেবল ২-৩ মাসের ক্রাশ কোর্স করে কখনোই নতুন বাজার ধরা যাবে না। সেজন্য একদম স্কুল থেকেই অন্যান্য দেশের ভাষা ও সংস্কৃতিতে ওরিয়েন্টেশন দরকার। তিনি মনে করেন বিভিন্ন কারিগরি শিক্ষা, যেমন ওয়েল্ডিং, ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী মেরামত, গাড়ি মেরামত, বৈদ্যুতিক কাজ- এসব কাজের শিক্ষা মাধ্যমিক স্কুল পর্যায় থেকেই শুরু করা দরকার- শিক্ষার্থীদের যার যেটাতে আগ্রহ। নার্স ও ল্যাব টেকনিশিয়ান তৈরিতে বেসরকারি খাতের সঙ্গে ভর্তুকি দিয়ে হলেও সরকারের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা এবং কৃষি কাজে যোগ দিতে হলে কৃষি যন্ত্রপাতি, গাছের আধুনিক উপায়ে পরিচর্যা, গাছ ও তার মৌসুম সম্পর্কে শিখানোর প্রশিক্ষণের দরকার।
নারী অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করে এরকম সংস্থা বিএনএসকের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বলেন, করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে ইউরোপসহ বহু দেশে বিশেষ করে বয়স্কদের কেয়ার-গিভার বা সেবাদানকারীর চাহিদা অনেক বেড়েছে। শিশুদের দেখভালের জন্য আয়া দরকার হচ্ছে। বাংলাদেশের যেসব নারী মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মীর কাজ করছেন তারা ইতোমধ্যেই এ ধরনের নার্সিংয়ের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তিনি জানান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপের দেশগুলোতে মানুষের গড় আয়ু বেশি; তাই বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেশি। এসব দেশে প্রচুর বয়স্ক ব্যক্তি একা থাকেন অথবা বয়স্কদের কোনো বিশেষায়িত আবাসনে থাকেন। যুক্তরাজ্যে ইতোমধ্যেই অনেক বাংলাদেশি নারী বয়স্ক ও শিশুদের সেবাদানকারী হিসেবে কাজ করছেন। সুমাইয়া ইসলাম বলেন, যারা মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মী, বিমানবন্দর, রাস্তা ও শপিংমলে পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে কাজ করেন- তারা খুব সহজেই হোটেলে নানা কাজ করতে পারবেন। যে মেয়েটি মধ্যপ্রাচ্যে কারো বাড়িতে ঘর, বাথরুম আর কাপড় পরিষ্কার করে, সে হোটেলেও হাউস-কিপিংয়ের এসব কাজ সহজেই করতে পারবে। যারা করোনা ভাইরাসের জন্য চাকরি হারিয়ে দেশে ফেরত এসেছেন তাদের স্কিল ডাইভার্সিফাই করে সহজেই এসব পেশায় পাঠানো সম্ভব। দোকানে সেলসেও এসব মেয়েদের কাজে লাগানো যেতে পারে।
অন্যদিকে করোনায় রেমিট্যান্সে ধাক্কা আসবে কিনা এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, আগামী দিনগুলোতেও রেমিট্যান্সের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেছেন, করোনা পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে এক রকম হবে, আর করোনা না থাকলে রেমিট্যান্সের হার আরেক রকম হবে। এ নিয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে যেটুকু করা দরকার সেটুকু যাতে করা হয়। যারা ফিরছে তাদের প্রণোদনা দেয়ার দাবি জানান তিনি।
ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও গবেষণা সংস্থা পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, শ্রমিক ফিরলেও রেমিট্যান্স বাড়ছে। এখানে হিসাবের গড়মিল রয়েছে। পুরো বিষয়টি এখনো পরিষ্কার নয়। সময় বলে দিবে রেমিট্যান্সের ভবিষ্যৎ।
এদিকে একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বেশ কয়েকটি দেশের শ্রমবাজারে অশনি সংকেত দেখা দেয়ায় বিকল্প শ্রমবাজার হিসেবে সরকার আরো ৬টি নতুন দেশে শ্রমিক পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে। দেশগুলো হচ্ছেÑ কম্বোডিয়া, পোল্যান্ড, চীন, রোমানিয়া, ক্রোয়েশিয়া এবং সিচিলেস। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, বিদেশে বাংলাদেশি শ্রমিকদের শ্রমবাজার যাতে সংকুচিত না হয় সেজন্য বাংলাদেশ মিশনগুলো নিরলসভাবে কাজ করছে। নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধানের জন্য ক‚টনৈতিক প্রচেষ্টাও জোরেশোরে চলছে।
বাংলাদেশে বড় অঙ্কের রেমিট্যান্স আসে এমন দেশের মধ্যে সৌদি আরব, মালদ্বীপ, সিঙ্গাপুর, ওমান, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, দক্ষিণ আফ্রিকা, কাতার, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, জর্ডান, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইতালি, ইরাক, শ্রীলঙ্কা, মরিশাস, রাশিয়া, তুরস্ক, লেবানন, নেপাল, হংকং, জাপান, লন্ডন, লিবিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক প্রবাসী বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন। এ সংখ্যা আড়াই থেকে ৩ লাখের কম নয়। আবার নতুন করে কোনো দেশে কেউ যেতেও পারছে না। সৌদি আরবে বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগের পর দেশে ফিরেছেন ১ লাখ ১২ হাজার ৮৯৬ জন। মালদ্বীপ ট্যুরিস্টনির্ভর দেশ হওয়ায় তারা ১৫ হাজার ১২৪ জনকে ফেরত পাঠিয়েছে। কাজের চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় বা কাজ না থাকায় কর্মী ফেরত পাঠিয়েছে সিঙ্গাপুর, ওমান, কুয়েত, বাহরাইন, দক্ষিণ আফ্রিকা, কাতার, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, শ্রীলঙ্কা, মরিশাস, রাশিয়া, তুরস্ক ও লেবানন। অবশ্য শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক জানিয়েছে, গত ১ এপ্রিল থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ লাখ ৭৬ হাজার ৪৪১ জন বাংলাদেশি দেশে ফিরেছে। একসঙ্গে এতজন শ্রমিক দেশে ফেরার প্রভাব রেমিট্যান্সের ওপর পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, আশঙ্কার বাইরে ছিল প্রবাসী আয়। কারণ চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের শুরু থেকেই রেমিট্যান্স আসার প্রবৃদ্ধি ছিল ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু এবার করোনা ভাইরাসের ধাক্কায় দেশের একমাত্র আশা জাগানো এই সূচকটিও হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।