ডেস্ক নিউজ
অতিমারি করোনার কারণে গত বছর পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের অর্থনীতিতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়। এর মানে এসব দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি আগের বছরের চেয়ে কমে যায়। এমনকি পার্শ্ববর্তী ভারতের মতো উচ্চ প্রবৃদ্ধির দেশেও জিডিপির আকার আট শতাংশের মতো কমে যায়। বাংলাদেশ ছিল অন্যতম ব্যতিক্রম দেশ, যার অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আকার আগের বছরের চেয়ে কমেনি। ২০০৯-১০ সালে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি পেছনের দিকে যায়নি।
অতিমারির প্রভাব কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ভালো করছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পুনরুদ্ধার হচ্ছে অনেকের চেয়ে বেশি গতিতে। আবার সামাজিক বিভিন্ন সূচকে অতিমারির মধ্যেও বাংলাদেশ অগ্রগতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পেরেছে। সংকটের মধ্যে বাংলাদেশের এই টিকে থাকার ক্ষমতা আজকের নয়। এর আগেও অনেকবার বাংলাদেশ তা প্রমাণ করেছে। করোনোর মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে সাড়ে তিন শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সাময়িক হিসাবে গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে পাঁচ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ চলতি অর্থবছরে সাড়ে ছয় শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে, যা পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত দেয়। সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন পরিসংখ্যানেও তা স্পষ্ট। অর্থনীতির বর্তমান চালিকাশক্তি রপ্তানি খাতে করোনার মধ্যেও গত অর্থবছরে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে রপ্তানি বেড়েছে ১১ শতাংশ। এ সময়ে রাজস্ব আয় বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ, যা ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফিরে আসার লক্ষণ বলে মনে করা হচ্ছে। রেমিট্যান্সে গত কয়েক মাসে ধীরগতি থাকলেও গত অর্থবছরে রেকর্ড ৩৬ শতাংশ বেড়েছিল। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৪৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি। বাংলাদেশ এখন রিজার্ভ থেকে শ্রীলঙ্কাকে ধার দিচ্ছে।
বিশ্বব্যাংক মনে করছে, পরের অর্থবছরে বাংলাদেশে আরও বেশি প্রবৃদ্ধি হবে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংস্থার পূর্বাভাস ৬ দশমিক ৯ শতাংশ। কেননা রপ্তানি এবং ভোগব্যয়ের ধারাবাহিকতা থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। অর্থনীতির পুনরুদ্ধার অব্যাহত থাকা এবং দারিদ্র্য কমবে কিনা তা নির্ভর করবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে সহায়তার মাধ্যমে অর্থনীতির ক্ষতি মোকাবিলার ওপর।
বাংলাদেশ গত কয়েক বছরে অবকাঠামো উন্নয়নে বিশেষত বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে সাফল্য দেখিয়েছে। নিজেদের টাকায় নির্মিত পদ্মা সেতু এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়। ঢাকায় মেট্রোরেলের নির্মাণও দৃশ্যমান পর্যায়ে। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণকাজ চলছে। সম্প্রতি পায়রা সেতুর উদ্বোধন করা হয়েছে, যা দক্ষিণাঞ্চলে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনেও সক্ষমতা বেড়েছে কয়েকগুণ।
মতামত জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, বাংলাদেশের মানুষের বিরূপ পরিস্থিতিতে টিকে থাকার ক্ষমতা অনেক বেশি। পরপর বন্যার মধ্যেও এখানে কৃষক যে কোনো উপায়ে ফসল ফলায়। অনেক ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকছে। ক্ষুদ্র ঋণে সাফল্য আছে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আর্থিক সেবার ক্ষেত্রে অনেক এগিয়েছে বাংলাদেশ। আর্থিক খাতে সংকটের মধ্যেও নানা প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন হচ্ছে। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের প্রসার হচ্ছে। তবে বাংলাদেশ নানা ক্ষেত্রে আরও ভালো করতে পারত।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সম্প্রতি জন্ম, মৃত্যু, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ ২০২০ সালের ‘ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স’ প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রত্যাশিত আয়ুস্কাল বা গড় আয়ু এখন ৭৩ বছর। ৩০ বছর আগে ১৯৯০ সালে গড় আয়ু ছিল মাত্র ৫৮ বছর। পাকিস্তানের অপশাসনের কারণে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের ৩০ বছরে গড় আয়ু বেড়েছে ১৫ বছর। আর পাকিস্তানের বেড়েছে সাত বছর। সে দেশের গড় আয়ু এখন ৬৭ বছর, বাংলাদেশ থেকে অনেক পিছিয়ে। ভারতের গড় আয়ুও বাংলাদেশের চেয়ে কম। ২০২০ সালে যা ছিল ৭০ বছর। বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে প্রতি হাজারে গত বছর ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। ১৯৯০ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৪৪ জন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তির হারের ক্ষেত্রেও অনেক উন্নতি হয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়ের বয়স বিবেচনায় শিশুদের ৭৩ ভাগ এখন স্কুলে যায়।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক পদ্ধতির হিসাবে ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের মাথাপছিু আয় ছিল ৩২০ ডলার। ২০২০ সালে তা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১০ ডলার। বাংলাদেশের অর্থনীতি বা জিডিপির আকার ১৯৯০ সালে ছিল মাত্র ৩২ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে জিডিপি দঁাঁড়িয়েছে ৩২৪ বিলিয়ন ডলারে। গত এক দশকে বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশগুলোর অন্যতম।
উত্তরণের বাংলাদেশ :বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের শ্রেণীকরণে ২০১৫ সালের ১ জুলাই নিম্ন আয় থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে ধারাবাহিক উন্নতির কারণে বাংলাদেশ এ তালিকায় আসে। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত বা এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্য বলে স্বীকৃতি দেয়। গত ফেব্রুয়ারিতে ওই কমিটি বাংলাদেশকে উত্তরণের জন্য চূড়ান্ত সুপারিশ করেছে। মাথাপিছু আয়ের পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য সামাজিক সূচকে উন্নতি এবং অর্থনীতির টিকে থাকার সক্ষমতার বিচারে বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্য মনে করছে জাতিসংঘ। ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে বের হয়ে ভারত, চীন, মালয়েশিয়ার মতো এলডিসি নয় এমন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাবে বাংলাদেশ।
গত বছর বিখ্যাত সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট ৬৬টি সবল অর্থনীতির তালিকা প্রকাশ করে, যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য বা এমডিজির অনেক সূচক অর্জন করে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কাড়ে বাংলাদেশ। এমডিজিতে ২০১৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি হারে কমাতে সক্ষম হয়। এমডিজি অর্জনের জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে বাংলাদেশ। এসডিজি অর্জনের কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের লক্ষণীয় অগ্রগতি রয়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বিশ্ব অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে তাদের সর্বশেষ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকে এ বছরও বাংলাদেশের মাথাপিছু দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে। আইএমএফের প্রাক্কলন হলো, ২০২১ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ২ হাজার ১৩৯ ডলার। অন্যদিকে, ভারতের মাথাপিছু জিডিপি হবে ২ হাজার ১১৬ ডলার। আইএমএফের হিসাবে গত বছরও বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ভারতকে ছাড়িয়ে যায়।
দারিদ্র্য বিমোচন :দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের সাফল্য প্রশংসিত হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ১৯৭৩-৭৪ সালে বাংলাদেশে দরিদ্র লোকের হার ছিল ৮২ শতাংশ। সর্বশেষ প্রকাশিত খানা আয় ও ব্যয় জরিপ অনুযায়ী ২০১৬ সালে দারিদ্র্যের হার দাঁড়ায় ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। এর ভিত্তিতে ২০১৯ সালে দারিদ্র্যের প্রাক্কলিত হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। কভিডের কারণে গত বছর দারিদ্র্য পরিস্থিতির অবনতি হয়। সাম্প্রতিক বিভিন্ন জরিপ বলছে, এর অনেকটাই এখন পুনরুদ্ধার হয়েছে। বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলেছে, কভিডের কারণে বাংলাদেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতির অবনতি হয়। তবে এখন পরিস্থিতির উত্তরণ হচ্ছে।
আছে চ্যালেঞ্জ :অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, উন্নয়নের পথে বাংলাদেশের সামনে বেশকিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। সঠিক নীতি ও পরিকল্পনার মাধ্যমে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটলে রপ্তানি বাণিজ্যে অগ্রাধিকার সুবিধা অনেক কমে যাবে। বাংলাদেশ ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে বের হলে ইইউর বাজারে ২০২৯ সাল পর্যন্ত বর্তমানের শুল্ক্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পাওয়া যাবে। ইইউর বাইরে অন্যান্য দেশে ২০২৬ সালের পর শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া যাবে না। এ কারণে আগামী পাঁচ বছরের উত্তরণকালীন সময়ের প্রস্তুতি বাংলাদেশের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। টেকসই উত্তরণের জন্য এসডিজি, অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও প্রেক্ষিত পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বয় করে উত্তরণের শক্তিশালী কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা। সার্বিকভাবে আগামী দিনের অগ্রগতির জন্য স্থানীয় বাজার এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো, রপ্তানি বহুমুখীকরণ, কর্মসংস্থান বাড়ানো, অবকাঠামো উন্নয়ন, দুর্নীতি কমানো, মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার প্রসারসহ অনেক বিষয়ে বিশেষ নজর দেওয়ার সুপারিশ উঠে আসছে বিভিন্ন আলোচনায়।