এক মা তাঁর ক্ষুধার্ত সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে নিজের মাথার চুল বিক্রি করেছেন বলে জানা গেছে। দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার পালিবটতলী গুচ্ছগ্রামে এ ঘটনা ঘটে। মাত্র ৩৫০ টাকায় স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে চুল বিক্রি করেন সোনালী বেগম নামের ওই মা। সেই অর্থ দিয়ে খাবার কিনে খাওয়ান সন্তানদের।
এমন খবর পেয়ে মধ্যরাতে খাদ্যসামগ্রী নিয়ে ওই মা ও ক্ষুধার্ত সন্তানদের বাড়ির দরজায় হাজির হন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবদুর রাফিউল আলম। অসহায় ওই নারী ও তাঁর স্বামীর কাজের ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন তিনি।
পালিবটতলী গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দারা জানায়, সোনালী বেগম (২৫) একজন নওমুসলিম। তাঁর বিয়ে হয়েছে আট বছর আগে। তাঁর এক ছেলে এক মেয়ে। স্বামী সোহাগ মিয়া করোনার কারণে এখন বেকার। আগে হোটেলে কাজ করতেন। করোনার জন্য সোহাগ বেকার জীবন যাপন করে আসছেন কয়েক মাস ধরে। অনেক চেষ্টা করেও তিনি কোনো কাজ পাননি। এই কয়েক মাসে করোনার মধ্যে যা সঞ্চয় ছিল তাও শেষ হয়ে যায়। হোটেলে কাজ করে চলত তাঁদের সংসার। সরকারি গুচ্ছগ্রামে সোহাগ পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন।
ওই গুচ্ছগ্রামের সাগর হোসেনসহ অনেকে জানান, কিছুদিন ধরে খেয়ে না খেয়ে দিনাপাতি করছেন তাঁরা। নিজের ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে পারলেও শিশু ছেলে-মেয়েদের ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে পারেননি সোনালী। তাই কোনো উপায় না পেয়ে সন্তানদের পেটের ক্ষুধা মেটাতে আর মুখে হাসি ফোটাতে নিজের অতি প্রিয় মাথার চুল কেটে বিক্রি করেন সোনালী। এলাকায় চুল কিনতে আসা ব্যবসায়ীদের কাছে তাঁর চুল মাত্র ৩০০ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি। চুল ব্যবসায়ী যখন বুঝতে পারলেন অভাবে আর সন্তানদের ক্ষুধা মেটাতে চুল বিক্রি করছেন তখন ৫০ টাকা বেশি দেন এই মমতাময়ী মাকে।
এদিকে, এ রকম খবর পেয়ে পালিবটতলী গ্রামে খাদ্যসামগ্রী নিয়ে মাঝরাতে অনাহারি অসহায় ও হতদরিদ্র পরিবারটির কাছে ছুটে যান হাকিমপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবদুর রাফিউল আলম।
কথা হয় নওমুসলিম মা সোনালীর বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আট বছর আগে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়ে সোহাগকে বিয়ে করি। সংসারে আমার এক ছেলে এক মেয়ে। স্বামীর স্বল্প উপার্জনে সন্তানদের নিয়ে দুঃখ-সুখ ভাগাভাগি করে কাটিয়ে দিচ্ছিলাম সংসার জীবন। করোনার কারণে স্বামী বেকার হয়ে পড়েন। তাঁর কোনো কাজ নেই। কয়েক দিন ধরে চুলায় ভাতের হাড়ি চড়াতে পারিনি। সব সহ্য করা যায়। কিন্তু সন্তানদের কষ্ট সহ্য করতে পারি না। তাই কোনো উপায় না পেয়ে অনেক প্রিয় চুলগুলো বিক্রি করে দেই।’
সোনালী আরো বলেন, ‘সেদিন রাতে ইউএনও স্যার আমার বাড়িতে এসে আট দিনের খাবার দিয়ে গেছেন। আজকে আমাকে তিনি একটি সেলাই মেশিন এবং আমার সংসার আর সন্তানদের লালন-পালনের জন্য আমার স্বামীকে একটা ফুচকার দোকান করে দিয়েছেন। এই সময় স্যার যদি আমাদের পাশে না দাঁড়াতেন তাহলে বাচ্চাদের নিয়ে না খেয়ে থাকতে হতো।’
সোনালীর স্বামী সোহাগ হোসেন বলেন, ‘আমি কোনোদিন ভাবতে পারিনি ইউএনও স্যার এভাবে আমাদের পাশে দাঁড়াবেন। কয়েক মাস থেকে আমি বেকার জীবন যাপন করছি। আজ থেকে আমি এই ফুচকার ব্যবসা শুরু করলাম। আমি আর বেকার থাকব না। হাটে-ঘাটে আর বাজারে ঘুরে ফুচকা বিক্রি করব। আমার সংসারে আর কোনো অভাব হবে না।’
সোহাগ হোসেন আরো বলেন, ‘ফুচকার গাড়িসহ সব সরঞ্জাম এবং ফুচকা বানানোর জিনিসপাতি কিনে দিয়েছেন ইউএনও স্যার। সঙ্গে কিছু টাকা দিয়েছেন। আমার স্ত্রীকে একটা সেলাই মেশিনও দিয়েছেন। সে সেলাইয়ের কাজ করতে পারে। আমরা দুজন মিলে কাজ করব এবং সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করব।
এ বিষয়ে হাকিমপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুর রাফিউল আলম বলেন, ‘গত কয়েকদিন আগে রাতে আমি জানতে পারি উপজেলার পালিবটতলী গুচ্ছগ্রামে একটি অসহায় পরিবার সন্তানদের নিয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। এমনকি সন্তানদের মুখে খাবার দেওয়ান জন্য সোনালী বেগম তাঁর মাথার চুল বিক্রি করেছেন। এমন সংবাদ পাওয়ার পর আমি নিজে ওই পরিবারের জন্য কয়েকদিনের খাদ্যসামগ্রী নিয়ে পৌঁছে দিয়েছি। গত সোমবার বিকেলে আমি ওই নওমুসলিম নারীকে একটি সেলাই মেশিন এবং তাঁর স্বামীকে একটা ফুচকার গাড়িসহ সব সরঞ্জাম কিনে দিয়েছি। এ ছাড়া ওই নারীকে উপজেলায় দর্জি কাজের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করে দিয়েছি।