ডেস্ক নিউজ
ভারত করোনা টিকা রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় ভ্যাকসিন নিয়ে বাংলাদেশে তৈরি হয়েছিল সংকট। ভেস্তে যাচ্ছিল টিকাদান কর্মসূচির মাস্টারপ্ল্যান। সংকট সমাধানে রাশিয়ার তৈরি করোনাভাইরাস টিকা ‘স্পুটনিক-ভি’ আমদানি ও জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। মে মাসেই রাশিয়া থেকে আসছে ৪০ লাখ ডোজ টিকা। রাশিয়ার টিকা কেনার পাশাপাশি তাদের প্রযুক্তি এনে দেশে টিকা উৎপাদন চুক্তির প্রক্রিয়াও এগিয়েছে অনেক দূর। চীন উপহার হিসেবে দেবে ৬ লাখ ডোজ টিকা। কোভ্যাক্স থেকে আসবে ফাইজারের ১ লাখ ডোজ টিকা। এ ছাড়া ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তির বাকি টিকার চালান থেকে ২০ লাখ ডোজ আনার চেষ্টা চলছে। সংকট সমাধানে এক উৎসে নির্ভর না থেকে বিকল্প ব্যবস্থা করছে সরকার।
সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার সরবরাহ সংকটে দেশে টিকাদান কার্যক্রম নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিল। এ প্রেক্ষাপটেই গতকাল রাশিয়ার টিকা আমদানি ও জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘২৪ এপ্রিল এ টিকা ব্যবহারের অনুমোদনের জন্য ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরে আবেদন করা হয়েছিল। আজ (মঙ্গলবার) সভায় তা অনুমোদন পেল। আমরা এ টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিলাম। এখন এটা বাংলাদেশে আমদানি ও ব্যবহারে কোনো বাধা রইল না।’
ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর ৮ জানুয়ারি ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা আমদানি ও দেশে জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দেয়। টিকা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের টেকনিক্যাল কমিটি গতকাল এক বৈঠক করে। ওই বৈঠক থেকেই রাশিয়ার টিকা জরুরি প্রয়োগের অনুমোদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ‘স্পুটনিক-ভি’ হলো করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় টিকা, যা বাংলাদেশের মানুষের ওপর প্রয়োগের অনুমোদন দেওয়া হলো। এর আগে পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কর্মরত রাশিয়া, বেলারুশ ও ইউক্রেনের নাগরিকদের ব্যবহারের জন্য স্পুটনিক-ভি টিকার ১ হাজার ডোজ দেশে আনার অনুমতি দিয়েছিল সরকার। তবে তা বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য ছিল না।
ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর জানিয়েছে, আগামী মাসেই এ টিকার ৪০ লাখ ডোজ বাংলাদেশে আসবে। অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান বলেন, মের মধ্যে বাংলাদেশ রাশিয়ার টিকা পাবে। প্রাথমিকভাবে ৪০ লাখ ডোজ টিকা আসবে। এগুলো সবই সরকারিভাবে দেশে নিয়ে আসা হবে। মূলত সরকারিভাবে (জি টু জি) এ টিকা আমদানির বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হবে। এরপর তা আমদানি করা হবে। সরকার আলোচনা করে এ টিকার দাম নির্ধারণ করবে। বাংলাদেশে ইনসেপটা, পপুলার ও হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস টিকা উৎপাদন করে বলে ব্রিফিংয়ে জানান মাহবুবুর রহমান। এর মধ্যে ইনসেপটা ১৪ ধরনের টিকা উৎপাদন করে। এসব কোম্পানির মাধ্যমে দেশে রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি টিকা উৎপাদন করা যায় কি না সে সম্ভাব্যতা বিবেচনা করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘রাশিয়ার এ টিকা আমদানি কেবল নয়, দেশেই উৎপাদনের বিষয়েও কথা চলছে। এরই মধ্যে ইনসেপটা রাশিয়ার সঙ্গে কথাও বলছে। টিকা উৎপাদনকারী আরও ফার্মাসিউটিক্যালস দেশে আছে। আশা করা যায় দেশেই এ টিকা উৎপাদন করা সম্ভব হবে।’ চীনের সঙ্গে টিকা কেনার বিষয়েও চলছে জোর আলোচনা। জরুরি প্রয়োজনে করোনাভাইরাসের টিকা পেতে চীনের উদ্যোগে নতুন প্ল্যাটফরমে নাম লেখাতে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ। ‘ইমারজেন্সি ভ্যাকসিন স্টোরেজ ফ্যাসিলিটি ফর কভিড ফর সাউথ এশিয়া’ নামের এ প্ল্যাটফরমে চীন, বাংলাদেশ ছাড়া বাকি চারটি দেশ হচ্ছে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে চুক্তির ৩ কোটি ডোজ টিকা নির্ধারিত সময়ে পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়ায় বিকল্প উদ্যোগ নেয় সরকার। গত দুই মাস ভারত থেকে কোনো টিকা আসেনি। ফলে প্রথম ডোজ নেওয়াদের দ্বিতীয় ডোজের পর্যাপ্ত টিকা সরকারের হাতে নেই। চুক্তি অনুযায়ী ৩ কোটি ডোজ টিকার মধ্যে এখন পর্যন্ত দুই দফা চালানে ৭০ লাখ ডোজ পেয়েছে বাংলাদেশ। মার্চে টিকার চালান আসেনি, এপ্রিলের চালানও এখন পর্যন্ত আসার কোনো আভাস পাওয়া যায়নি। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের টিকার কাঁচামাল রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়া, ভারতে কভিড আক্রান্ত অনেক বেড়ে যাওয়া ও টিকা রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশে সেরাম ইনস্টিটিউটের টিকা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
গতকাল পর্যন্ত বাংলাদেশে টিকার মজুদ ছিল ১৯ লাখের কিছু বেশি। এখন প্রতিদিন প্রায় ১ লাখ ডোজ টিকা দেওয়া হচ্ছে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে টিকার প্রথম ডোজ। এ হারে টিকা দেওয়া চলতে থাকলে আগামী ১৮-২০ দিনের মধ্যে টিকা ফুরিয়ে যাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকার একটি উৎসের ওপর নির্ভর করায় সংকটে পড়তে হয়েছে বাংলাদেশকে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটি সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিল কোনো একটি টিকার জন্য কাজ না করে একাধিক উৎসের সঙ্গে যোগাযোগ ও টিকা সংগ্রহের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার। টিকা দ্রুত পেতে অগ্রিম টাকা জমা দিতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিল কমিটি। কিন্তু সরকার শুধু অক্সফোর্ডের টিকা আমদানি করেছে। চীনের সিনোভ্যাক বাংলাদেশে ট্রায়ালে আগ্রহী থাকলেও সিদ্ধান্তহীনতায় তা আর হয়নি। সরকার এখন অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার বাইরে অন্য উৎস থেকে টিকা কেনার বিষয়ে কার্যক্রম শুরু করেছে। এ ছাড়া মে মাসে বৈশ্বিক উদ্যোগ কোভ্যাক্স থেকে দেশে আসবে ফাইজার-বায়োএনটেকের ১ লাখ ডোজ টিকা। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে দেশের শীর্ষস্থানীয় ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের মাধ্যমে সরকার অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ৩ কোটি ডোজ টিকা আমদানির চুক্তি করেছে। এখন পর্যন্ত সেরাম ৭০ লাখ ডোজ টিকা দিয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী এখনো পাওনা রয়েছে ২ কোটি ৩০ লাখ ডোজ। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারকে উপহার দেওয়া হয়েছে একই টিকার ৩৩ লাখ ডোজ। অর্থাৎ বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত মোট ১ কোটি ৩ লাখ ডোজ টিকা পেয়েছে। বাকি টিকা আনতে বেক্সিমকো-সেরাম ও সরকার পর্যায়ে চলছে আলোচনা। কার্যক্রম চালিয়ে নিতে রাশিয়া থেকে টিকা আমদানি করা হচ্ছে। টিকা আনার প্রক্রিয়া চলছে চীন থেকেও। পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন জানিয়েছেন, চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে টিকা আনার উদ্যোগ চলছে। তবে প্রক্রিয়া শেষে টিকা আসতে দুই সপ্তাহ লাগবে। এর আগে দেশে কোথাও থেকে টিকা আসছে না। গতকাল পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের বাসভবনে সাংবাদিকদের তিনি এ তথ্য জানান। টিকা নিয়ে চীনের উদ্যোগে ছয় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন যোগ দেন। গতকাল দুপুর ২টায় ভার্চুয়ালি এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে আরও যোগ দেন চীন, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা।