ডেস্ক নিউজ
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে। বাংলাদেশের দারিদ্র্য কমেছে ৫০ শতাংশ। মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, মাতৃমৃতু্য ও শিশুমৃতু্যর হার কমেছে, সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে। তবে বাংলাদেশে এখনো প্রতি ৬ শিশুর মধ্যে একজন অপুষ্টির শিকার।
বাংলাদেশ জনসংখ্যায় পৃথিবীর ৮ম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। কিন্তু আয়তনের দিক থেকে পৃথিবীর ৯৪তম দেশ। এখানে এক লাখ সাতচলিস্নশ হাজার পাঁচশত সত্তর বর্গকিলোমিটার এলাকায় প্রায় সতের কোটি মানুষের বসবাস। সঙ্গে আরও রয়েছে প্রায় ১০ লক্ষাধিক শরণার্থীর আশ্রয়। দেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১২৬৫ জন- যা পৃথিবীতে এগারোতম। রাজধানী ঢাকা আয়তনে বিশ্বে নবম এবং জনসংখ্যায় ৬ষ্ঠ ঘনবসতিপূর্ণ মেগাসিটি। এখানে মাত্র ৩০,৪৪০ হেক্টর ভূমিতে প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস। পৃথিবীতে ১৩৫টি দেশের একক জনসংখ্যা ঢাকার তুলনায় কম। তাই বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র একটি ভূখন্ড থেকে এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্যের সংস্থান করা নিঃসন্দেহে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। কিন্তু সবাইকে তাক লাগিয়ে সেই অসাধ্য সাধন করেছে বাংলাদেশ। দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনসহ কৃষির অন্যান্য ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় উন্নতি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের অন্যতম সেরা অর্জন। বৈশ্বিক কৃষিতে বাংলাদেশের কৃষির সফলতার গল্প আজ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য উদাহরণ। আমরা করোনার এই দুঃসময়েও দেশের কৃষির জন্য কয়েকটি সুসংবাদ পেয়েছি। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কৃষি বিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএ মতে, চাল উৎপাদনে কয়েক বছরের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে বিশ্বে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। একইসঙ্গে বাংলাদেশ এখন চাল রপ্তানিকারক দেশ। বিশ্বে ধান থেকে চাল ছাড়া আরও নানাবিদ খাদ্যপণ্য তৈরি করা হয়। তাই আমাদের নবীন উদ্যোক্তাদের ধান বা চাল থেকে নতুন নতুন খাদ্যপণ্য উৎপাদন নিয়ে চিন্তাভাবনা করা উচিত।
অন্যদিকে, স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে বাংলাদেশে ভুট্টা উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। দেশে বিগত পাঁচ বছরে ভুট্টার উৎপাদন দ্বিগুণ হয়ে ২৭ লাখ টন হতে ৫৪ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। গত বছর বিশ্বে হেক্টরপ্রতি ভুট্টার সর্বাধিক ফলনের রেকর্ড তুরস্কের। দেশটিতে প্রতি হেক্টরে সাড়ে ১১ টন ফলন হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র হেক্টরপ্রতি ১০ টন ফলন নিয়ে বিশ্বে ২য় অবস্থানে রয়েছে। আর বাংলাদেশে হেক্টরপ্রতি ভুট্টার ফলন হয়েছে পৌনে ১০ টন। প্রতি বছর প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য খাতে খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে। এতে ভুট্টার একটি বড় বাজার তৈরি হয়েছে। দেশে প্রাণিখাদ্যের বাজার বছরে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। মাছ, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির উৎপাদন বাড়ায় ভুট্টার চাহিদাও বাড়ছে। উৎপাদন ও ফলন বৃদ্ধি পাওয়ায় ভুট্টার আমদানি নির্ভরতা কমে এখন রপ্তানি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
বিশ্বে পরিবেশবান্ধব তন্তু বিবেচনায় পাটের কদর দিন দিন বেড়েই চলছে। আর সেই পাট উৎপাদনে পৃথিবীতে ভারতের পরই বাংলাদেশের স্থান এবং পাট রপ্তানিতে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম। বাংলাদেশ থেকে অনেক দেশ পাটের আঁশ আমদানি করে তা থেকে নানাবিদ পণ্য তৈরি করে ইউরোপের বাজারে রপ্তানি করে থাকে। আমাদের সময় এসেছে দেশীয় কাঁচামাল থেকে বৈচিত্র্যময় চাহিদাসম্পন্ন পণ্য তৈরি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথ সুগম করা।
বাংলাদেশে চা শিল্পের বাজার ২০ হাজার কোটি টাকার ওপরে। বিগত চার দশকে দেশে চা উৎপাদন বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। লন্ডনভিত্তিক ‘ইন্টারন্যাশনাল টি কমিটি’র প্রতিবেদন অনুসারে, চা উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান একধাপ এগিয়ে গত বছর ৯ম স্থানে উন্নীত হয়েছে। চীন ও ভারত পণ্যটি উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। যদিও দেশীয় ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে বিদেশে চা রপ্তানি কমে যাচ্ছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)-এর তথ্যানুযায়ী, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। পেঁয়াজ ও ফুলকপি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে নবম। আলু উৎপাদনে সপ্তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও এখন আলু রপ্তানি হচ্ছে। আলু বাংলাদেশের সব শ্রেণির মানুষের কাছে বছরব্যাপী সহজলভ্য ও সুলভ সবজি হিসেবে বিবেচিত। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় এখন ভাতের সঙ্গে আলুও রয়েছে। বিশ্বে প্রতি বছর যে হারে শাকসবজি চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতেও বাংলাদেশ শীর্ষস্থানীয়। কিন্তু দেশে শাকসবজির প্রায় ৭০ ভাগই উৎপাদিত হয় শীতকালের মাত্র ৪-৫ মাসে। বাকি সময়ে উৎপাদিত হয় মাত্র ৩০ শতাংশ। আবার উৎপাদিত সবজির প্রায় ২৫ ভাগই নষ্ট হয় ফসলের মাঠে এবং ফসল সংগ্রহ-উত্তর বিভিন্ন ধাপে। বছরব্যাপী নিরবচ্ছিন্ন সবজি উৎপাদন, পরিবহণ ও ফসল সংগ্রহ-উত্তর ব্যবস্থাপনা এ ক্ষেত্রে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
ফল উৎপাদনে উষ্ণমন্ডলীয় দেশগুলোতে বাংলাদেশ দশম আর সামগ্রিকভাবে ২৮তম। কিন্তু ফল উৎপাদনের আওতা বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষে অবস্থান করছে। বাংলাদেশ কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়। আম উৎপাদনে ৭ম। পেয়ারা উৎপাদনে ৮ম। পেঁপে উৎপাদনে ১৪তম। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলদেশ থেকে ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে আম-কাঁঠাল রপ্তানি শুরু হয়েছে। ইউরোপের বাজারেও বাংলাদেশের আমের চাহিদা তৈরি হয়েছে।
এফএও-এর তথ্যমতে, স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনেও বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। বিগত কয়েক দশকে মৎস্যক্ষেত্রে বাংলাদেশে নীরব বিপস্নব ঘটেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বিশ্বে যে পরিমাণ ইলিশ উৎপাদিত হয়, তার ৮৬ শতাংশই হয় আমাদের দেশে। ইলিশের প্রজনন, বংশবৃদ্ধি এবং জাটকা সংরক্ষণে বাংলাদেশের মডেল এখন বিশ্বের অনেক দেশই অনুসরণ করছে। একসময় সাদা সোনা হিসেবে পরিচিত চিংড়ি রপ্তানিতেও বাংলাদেশ সমৃদ্ধ ছিল।
অপরদিকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, বাংলাদেশে পালনকৃত গবাদিপশুর সংখ্যা ২ কোটি ৪০ লাখেরও বেশি। শুধু তা-ই নয়, গবাদিপশু পালনে সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বাদশ অবস্থানে রয়েছে। ছাগল উৎপাদনেও বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ আর ছাগলের মাংস উৎপাদনে বিশ্বে পঞ্চম। আবার ছাগলের মাংসের গুণগত মান এবং উৎপাদনশীলতা বিবেচনায় আমাদের নিজস্ব জাত বস্নাক বেঙ্গল গোট বিশ্বখ্যাত। কয়েক বছর আগেও প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমার থেকে আমদানিকৃত গরু দিয়েই মিটত দেশের মাংসের চাহিদা। প্রতি বছর কোরবানির সময় দেশ দুটি থেকে আমদানি হতো ২২ থেকে ২৫ লাখ গবাদিপশু। কিন্তু সেই নির্ভরতা কমিয়ে এখন স্বয়ংসম্পূর্ণতার পথে বাংলাদেশ। গবাদিপশুর সংখ্যায় বাংলাদেশ সমৃদ্ধ হলেও গুণগত মানসম্পন্ন মাংস ও দুধ উৎপাদনকারী খামার প্রতিষ্ঠায় প্রভূত সম্ভাবনা রয়েছে।
ধানসহ নানাবিদ ফসলের জাত উন্নয়নে বাংলাদেশের সফলতা বিশ্বখ্যাত। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় বন্যা, খরা, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা ও দুর্যোগসহিষ্ণু শস্যের জাত উন্নয়নে বাংলাদেশ বিশ্বে সুনাম কুড়িয়েছে। পাশাপাশি বিশেষ পুষ্টিসমৃদ্ধ ফসলের জাত উন্নয়নে বাংলাদেশ অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। প্রতি বছর নতুন নতুন ফলমূল, শাকসবজি দেশে চাষাবাদের তালিকায় যোগ হচ্ছে।
প্রায় চার কোটি টন খাদ্য উৎপাদন করে বাংলাদেশ এখন দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন বেড়েছে তিনগুণেরও বেশি, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচগুণ এবং ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে প্রায় দশগুণ। দেশে ফসল বহুমুখীকরণের পাশাপাশি ফসল নিবিড়তা বেড়ে হয়েছে প্রায় দুইশ’ শতাংশ। দুই যুগ আগেও দেশের অর্ধেক এলাকায় একটি ও বাকি এলাকায় দু’টি ফসল হতো। বর্তমানে দেশে বছরে গড়ে দু’টি ফসল হচ্ছে। এছাড়া বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশে পশুপালন ও হাঁস-মুরগির খামারেও অগ্রগতি এসেছে। পুষ্টির অন্যান্য উপাদান ডিম, দুধ ও মাংসের উৎপাদনও বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাতে বৃদ্ধি পেয়েছে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যের জনপ্রতি প্রাপ্যতা। ছাদ-কৃষি ও নগরকৃষিতে মানুষের আগ্রহ ও জনপ্রিয়তা আশাব্যঞ্জক। এ সামগ্রিক সাফল্যের মূলে রয়েছে বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের যুগোপযোগী পরিকল্পনা, পরিশ্রমী কৃষক এবং মেধাবী কৃষিবিজ্ঞানী ও কৃষি সম্প্রসারণবিদদের যৌথ প্রয়াস।
কৃষিখাতে এতসব সাফল্যের পরেও বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা ও ঘাটতি রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ফসলের হাইব্রিড জাত উদ্ভাবনে ঘাটতি, প্রাণী ও মৎস্যসম্পদের অধিক উৎপাদনশীল জাতের অভাব, সার ও কীটনাশকে ভেজাল, সেচ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন না হওয়া, কৃষি সংশ্লিষ্টদের দক্ষতার ঘাটতি, উন্নত প্রযুক্তি ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ধীরগতি, কৃষিপণ্যে মূল্য সংযোজনের অভাব, পর্যায়ক্রমে কৃষিজমি কমে যাওয়া, কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও প্রত্যহিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ অন্যতম। এছাড়াও কৃষকের শ্রম ও ঘামে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের বাজারজাতকরণ ও ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি অন্যতম বড় সমস্যা হিসেবে বিবেচিত। ‘উত্তম কৃষি চর্চা’ সংশ্লিষ্ট সনদের ব্যবস্থা না থাকায় ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কৃষিপণ্য রপ্তানিতে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। পাশাপাশি কৃষিঋণের অপর্যাপ্ততা, কৃষি বীমা ব্যবস্থা না থাকায় কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই কৃষি খাতের উন্নয়ন, গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালীকরণ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য কৃষি সংশ্লিষ্টদের সচেতন ও সংগঠিত হওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে কৃষির আধুনিকায়ন, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপন এখন সময়ের দাবি।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ খোরপোশ কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে উত্তরণ ঘটিয়েছে। এখন চ্যালেঞ্জ হলো উৎপাদনের গুণগতমান নিশ্চিত করে রপ্তানিমুখী কৃষিতে বিশ্বে নিজেদের অবস্থান করে নেওয়া। এখনো বাংলাদেশের প্রায় ৬০ ভাগ মানুষের জীবন জীবিকা কোনো না কোনোভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪০ ভাগ কৃষিতে নিয়োজিত। দেশে প্রতি বছর ১.৩৭ শতাংশ হারে জনসংখ্যা বাড়ছে। অন্যদিকে ০.৭৪ শতাংশ হারে আবাদি জমি কমছে। বাংলাদেশের মোট আবাদি জমির পরিমাণ মাত্র সাড়ে আট মিলিয়ন হেক্টর। এর ৭৫ ভাগ জমিতেই ধান চাষ হয়, বাকি ২৫ ভাগ জমিতে অন্যান্য ফসল চাষাবাদ হয়। কিন্তু শিল্পায়ন, বসতবাড়ি নির্মাণ, নগরায়ণসহ নানাবিদ কারণে ফিবছর আবাদি জমি কমছে।
জলবায়ু এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিতে থাকা দেশসমূহের মধ্যে শীর্ষে বাংলাদেশ। তাই আগামী দিনের কৃষি যে সুষম গতিতে চলবে, তা হলফ করে বলা কঠিন। অন্যদিকে, দেশে প্রতি বছর বিশ লাখ নতুন মুখ যোগ হচ্ছে। ধারণা করা হয়, ২০৫০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৫ কোটিতে। এ বিপুল বর্ধিত জনগোষ্ঠীর পুষ্টিকর খাবার জোগান দিতে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই।
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে। বাংলাদেশের দারিদ্র্য কমেছে ৫০ শতাংশ। মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, মাতৃমৃতু্য ও শিশুমৃতু্যর হার কমেছে, সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে। তবে বাংলাদেশে এখনো প্রতি ৬ জন শিশুর মধ্যে একজন অপুষ্টির শিকার।
৫ বছরের কম বয়সি ৩৬ শতাংশ শিশু খর্বকায় (উচ্চতা কম), ৩৩ শতাংশ শিশু কৃশকায় (ওজন কম)। বাংলাদেশে ২২ শতাংশ কিশোরীর উচ্চতা কম। এছাড়া নারীদের মধ্যে রক্তস্বল্পতার হারও অনেক বেশি। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৮০ ভাগ লোক গ্যাস্ট্রিকে আক্রান্ত, ২০-২২ শতাংশ লোক হৃদরোগে, ৮০-৯০ লাখ লোক ডায়াবেটিসে, প্রায় ১০-১২ লাখ লোক কিডনি রোগে এবং ১৫ লাখ লোক ক্যানসারে আক্রান্ত। আর এসব রোগের মূল কারণ ভেজাল খাদ্য গ্রহণ, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন না করা, সুষম খাদ্য গ্রহণে অসচেতনতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পয়ঃনিষ্কাশন ও সুপেয় পানির অভাব এবং পুষ্টি সম্পর্কে অজ্ঞতা।
আমরা বলে থাকি কৃষিই কৃষ্টি, কৃষিই সমৃদ্ধি। কৃষকরাই যে এ দেশের প্রাণ; কৃষক বাঁচলে বাঁচবে দেশ। বৈশ্বিক মহামারিতে বিশ্ব যখন স্থবির, তখনও থেমে নেই বাংলার কৃষকরা। নিজের হাতে ফলিয়েছেন ফসল। আর সেই ফসলই বাঁচিয়ে রেখেছে ঘরবন্দি ১৭ কোটি মানুষের জীবন। বাঁচিয়ে রেখেছে দেশের অর্থনীতি। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কিছু দেশে তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৩৫ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের কম। এ বর্ধিত তরুণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান করতে হলে কৃষিতে আত্মনিয়োগ করতে হবে। আমরা খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করেছি, এখন আমাদের পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে অধিকতর মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। প্রতিযোগী দেশসমূহের সঙ্গে সক্ষমতা তৈরি করে বিদেশে কৃষিপণ্যের রপ্তানি বাড়াতে হবে। কৃষিতে বায়োটেকনোলজি ও ন্যানোটেকনোলজির ব্যবহার বাড়ানো, নতুন নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগ, রোগবালাই প্রতিরোধী উন্নত জাত উদ্ভাবন করতে হবে। এছাড়াও ফসলের বছরব্যাপী নিয়ন্ত্রিত চাষাবাদ, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ও সেচ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন জরুরি। এসডিজি’র ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ১০টি এবং এর অন্তর্গত ৩৩টি টার্গেটের সঙ্গে কৃষিখাতের সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। তাই এসডিজি’র লক্ষ্য অর্জনে কৃষি খাতের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও কৃষি উৎপাদকদের আয় বৃদ্ধি অপরিহার্য।
লেখক : অধ্যাপক, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।