ডেস্ক নিউজ
ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সচিবালয়ে নিয়মিত যোগাযোগ, বৈঠক করছেন পাকিস্তানের হাইকমিশনার। সম্পর্ক ভালো করতে চীন ও তুরস্ককে কাজে লাগানোরও চেষ্টা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে হঠাৎ ইমরান খানের পাকিস্তানের দৌঁড়ঝাপ লক্ষণীয়। ঢাকায় দেশটির রাষ্ট্রদূত এ ব্যাপারে যেমন জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন, তেমনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশটি তার দুই ঘনিষ্ঠ মিত্র চীন ও তুরস্ককে এক্ষেত্রে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
গত মঙ্গলবার (১৬ মার্চ) বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে পাকিস্তান আগ্রহী বলে মন্তব্য করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ড. আরিফ আলভি। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে সব ধরনের কার্যক্রম গ্রহণেরও আহ্বান জানান তিনি। ওই দিন বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার ইমরান সিদ্দিকীকে নিজের বাসভবনে ডেকে এই আগ্রহের কথা জানান প্রেসিডেন্ট আলভি।
বুধবার পাকিস্তানের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ডনের এক প্রতিবেদনে এ খবর দিয়েছে।
আলাপচারিতায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে অত্যন্ত মূল্যবান বলে মনে করে পাকিস্তান। আমরা বিদ্যমান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ব্যবহার করে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা আরও বাড়াতে চাই।’
ডনের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন সামনে রেখে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে হাইকমিশনার ইমরান সিদ্দিকীকে ঢাকা থেকে পাকিস্তানে ডেকে পাঠায় পাকিস্তান সরকার।
আলাপচারিতায় বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আরও মনোযোগ দিতে পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে নির্দেশ দেয়া হয়। এ সময় তিনি পারস্পরিক সুবিধার জন্য দুই দেশের অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও নাগরিকদের মধ্যকার সম্পর্ক জোরদারে গুরুত্বারোপ করেন।
ডনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে খেলাধুলা নিয়ে সহযোগিতা বাড়ানোর পাশাপাশি রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা বিনিময়ে জোর দেয়ার পরামর্শ দেন প্রেসিডেন্ট আলভি।
তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন এ বিষয়ে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য পাকিস্তানের হাইকমিশনারের বর্তমান পদক্ষেপগুলো সম্পূর্ণ রুটিন ওয়ার্ক। এগুলো আহামরি কিছু নয়। আমাদেরও দায়িত্ব, কেউ যদি সম্পর্কন্নোয়নে আগ্রহী হয়, বৈঠকের সময় চায়, তা দিয়ে তাদের সহায়তা করা। এটা কূটনৈতিক শিষ্টাচারেরও অংশ।’
পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির চাওয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে সম্পর্কন্নোয়ন চাইলে পাকিস্তানকে তাদের একাত্তরের ঘটনার জন্য অবশ্যই আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাইতে হবে। একাত্তরে চালানো হত্যাযজ্ঞের শিকার পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তা না হলে দৌড়ঝাঁপ করে আদতে কোনো লাভ হবে না।’
পাওনা চাইবে বাংলাদেশ
এদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র নিউজবাংলাকে জানান, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা থাকা টাকার ৪০ ভাগ আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের কাছে দাবি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি দল পাওনার বিষয়ে হিসাব-নিকাশ করছে। ১৯৭২ সালের হিসেবে বাংলাদেশের পাওনা ছিল ৪ বিলিয়ন ডলার। এখন ৫০ বছরে তা সূদে-আসলে কয়েকগুণ বেড়েছে।
সূত্র মতে, পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাইলে পাওনায় অর্ধেক ছাড় দেবে বাংলাদেশ। তা না হলে পুরোটা আদায়ের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।
১৯৭২ সালের হিসেবে বাংলাদেশের পাওনা ছিল ৪ বিলিয়ন ডলার। এখন ৫০ বছরে তা সূদে-আসলে কয়েকগুণ বেড়েছে।
আকস্মিক দৌড়ঝাঁপ
হঠাৎ করে কূটনৈতিক সম্পর্কোন্নয়নে মনযোগী হয়েছে ঢাকায় পাকিস্তানি হাইকমিশন। দীর্ঘদিনের শীতল সম্পর্কের শূন্যতা পূরণ করতে চায় তারা। এজন্য ঢাকার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সচিবালয়ে নিয়মিত দৌড়ঝাঁপ করছেন সেদেশের হাইকমিশনার। নানা বিষয়ে সচিবালয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীদের সঙ্গেও হচ্ছে নিয়মিত বৈঠক।
কূটনীতিক মহলে মনে করা হচ্ছে, পাকিস্তানের সঙ্গে প্রায় ছিন্ন হয়ে যাওয়া সম্পর্ক নতুন গতি ফিরে পেয়েছে গত কয়েক মাসে। অনেকের ধারনা, এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে পাকিস্তানের পরম বন্ধু রাষ্ট্র চীন। অন্যদিকে কেউ কেউ মনে করছেন, দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নে মূল ভূমিকায় রয়েছে পশ্চিম এশিয়ার দেশ তুরস্ক।
সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলেন, ‘দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক আসলে নদীর স্রোতের মতো। এতে কখনও জোয়ার, আবার কখনও ভাটা শুরু হয়। তবে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে যে সম্পর্ক, তা স্বাভাবিক হতে পাকিস্তানকে অনেক দূর যেতে হবে। পেরুতে হবে অনেক দুর্গম পথ।’
দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক সবচেয়ে ভঙ্গুর অবস্থায় চলে যায় ২০১৩ সালে, যখন বাংলাদেশ একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার শুরু করে। এই বিচারের ধারাবাহিকতায় আদালত পাকিস্তানের ১৯৭১ সালের মিত্র ও সহযোগী শীর্ষ জামায়াত নেতাদের ফাঁসি দিতে থাকে। তখন দেশটি এই বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলে। ফলে দুই দেশের সম্পর্ক উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে পৌঁছে। এক দেশ অপর দেশের কূটনীতিকদের বহিষ্কার, পাল্টা বহিষ্কার করতে থাকে, যা চলমান ছিল অনেক দিন। অনানুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ ছিল দুই দেশের কূটনৈতিক ভিসা আদান-প্রদান।
বাংলাদেশ এই ঘটনাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও বিচারিক কাজে পাকিস্তানের হস্তক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করে। এছাড়া এ সময় পাকিস্তানের সরকারি ওয়েবসাইটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য লেখা হয়। প্রতিবাদে ইসলামাবাদের কাছে লিখিত জবাব চায় ঢাকা। কিন্তু গ্রহণযোগ্য উত্তর পাওয়া যায়নি। সে সময়ের ঢাকায় পাকিস্তানের হাইকমিশনারের বিরুদ্ধে ঢাকায় বসে সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে তাকে বহিষ্কার করা হয়। এতে দুই বছর শূন্য থাকে ঢাকায় পাকিস্তানি হাইকমিশনারের পদ।
তবে সম্পর্ক পাল্টাতে উদ্যোগী হন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। ২০১৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশনের ফাঁকে শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের ইচ্ছা পোষণ করেন। ঢাকা এই প্রস্তাবে সাড়া না দিলেও কয়েকদিনের মাথায় ২ অক্টোবর হাসিনাকে ফোন করে বসেন ইমরান খান।
এতে সকল বিতর্কিত ইস্যু বাদ দিয়ে ইমরান হাসিনা সরকারের শাসন ব্যববস্থা ভূয়সী প্রশংসা করেন। প্রশংসা করেন বাংলাদেশের ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়নেরও। এটা ছিল দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে প্রায় ১০ বছরের মধ্যে প্রথম বাক্যালাপ।
এরপরই টরেন্টোতে কনসাল জেনারেলের দায়িত্ব পালনরত পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের কর্মকর্তা ইমরান আহমেদ সিদ্দীকিকে ঢাকায় নিয়োগ দেয় ইসলামাবাদ। তিনি এক সময় পাকস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের জয়েন্ট সেক্রেটারি ছিলেন। কাজ করেছেন ওআইসি ও জাতিসংঘে।
২০১৯ সালের ২ অক্টোবরের ওই ফোনালাপ অনেক কারণেই গুরুত্ব পায় কূটনৈতিক মহলে। এর পরদিনই দিল্লি সফরে যান শেখ হাসিনা। ইমরান খান টেলিফোনে শেখ হাসিনার লন্ডনে হওয়া চোখের চিকিৎসার খোঁজ নেন। এর চার মাস পর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় নিয়োগ পাওয়া ইমরান আহমেদ সিদ্দীকি ঢাকায় আসেন। মার্চ থেকে করোনার জন্য ঢাকা অচল হয়ে যায় লকডাউনের কারণে।
এরই মধ্যে জুলাইয়ে নীরবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত। বাংলাদেশের গণমাধ্যম এ বৈঠকের ব্যাপারে অন্ধকারে থাকলেও তা প্রকাশ করে তুরস্কের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ‘আনাদুলু এজেন্সি’।
এর পরপরই জুলাইয়ে আবারও হাসিনাকে ফোন করেন ইমরান খান। এবার বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক গভীরের আগ্রহের কথা জানান ইমরান খান। এছাড়া পারস্পরিক বিশ্বাস, সম্মান, সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে এই সম্পর্কোন্নয়নের কথা বলেন পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী। এরপর গত ৩ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেখা পান পাকিস্তানি হাইকমিশনার।
ওই বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের চালানো গণহত্যার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৭১ সালের ঘটনা ভোলার নয়; এ ব্যথা চিরদিন থাকবে।’
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ শাহরিয়ার আলমের (ডানে) সঙ্গে পাকিস্তানের হাইকমিশনার ইমরান সিদ্দিকীর সাক্ষাৎ। ফাইল ছবি
২০২১ সালের শুরুতে ৭ জানুয়ারি পাকিস্তানি হাইকমিশনার সাক্ষাত করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে। ওই বৈঠকে শাহরিয়ার আলম হাইকমিশনারকে বলেন, ’৭১-এর ক্ষত ভুলে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন কঠিন। তাই সম্পর্কের উন্নয়ন চাইলে অবশ্যই ইসলামাবাদকে ঢাকার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে এবং বাংলাদেশের বকেয়া ফেরত দিতে হবে।
জবাবে পাকিস্তান দূত ’৭৪ সালে সম্পাদিত বহুল আলোচিত ত্রিদেশীয় চুক্তির একটি কপি হস্তান্তর করে জানান, তারা এরই মধ্যে বাণিজ্য বাধা নিরসন এবং বাংলাদেশিদের জন্য পাকিস্তানকে উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ জন্য সব ধরনের ভিসা জটিলতা দূর করেছেন।
২৭ জানুয়ারি ইমরান আহমেদ সিদ্দীকি সচিবালয়ে বৈঠক করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সঙ্গে। বৈঠকে তিনি চট্টগ্রাম-করাচির মধ্যে জাহাজ চলাচল, ঢাকা-ইসলামাবাদ সরাসরি বিমান চলাচল শুরুসহ দুদেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানান। এছাড়া সচিবালয়ে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেন পাকিস্তানি হাইকমিশনার।
সর্বশেষ গত ৩ ফেব্রুয়ারি তিনি বৈঠক করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের সঙ্গে। তবে বুধবারের এই বৈঠকে কী নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তা নিয়ে মুখ খোলেন নি কেউই।