ডেস্ক নিউজ
অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। ভ্রমণ পিপাসুরা ভালোবেসে নাম দিয়েছেন ‘সাগরকন্যা’। ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে সূর্যোদয় ও সূর্য়াস্তের মনোরম দৃশ্য আহা! চোখ জুড়িয়ে যায়! এই দৃশ্য দেখতে কার না ভালো লাগে? সমুদ্র সৈকতের পাশেই দেড় শতাধিক একর জমিতে অবস্থিত ‘নারিকেল কুঞ্জ’ তাকালেই মন জুড়িয়ে যায়। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ তথা ফেরি পারাপারের ঝক্কিঝামেলার কারণে ভ্রমণ পিপাসুরা কুয়াকাটা মুখি হতে চান না। সবাই ছুটে যান কক্সবাজার।
পায়রা সেতুর কারণে এখন বদলে যাবে কুয়াকাটা। রাজধানী ঢাকা এবং বরিশাল থেকে কুয়াকাটা কম সময়ে যাওয়া যাবে। পায়রা সেতু চালুর পর যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় এখন ভ্রমণ পিপাসুরা ছুটবেন কুয়াকাটায়। পর্যটনকে কেন্দ্র করে দক্ষিণাঞ্চলের সাগরকন্যা কুয়াকাটার অর্থনীতি পাল্টে যাবে। পর্যটন ঘিরে হাজার হাজার মানুষের হবে কর্মসংস্থান। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিতে বদলে যাবে দৃশ্যপট।
এক সময় সড়কপথে ঢাকা থেকে বরিশাল হয়ে সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা যেতে ১০টি ফেরি পার হতে হতো। সময় লাগতো ১২ থেকে ১৫ ঘণ্টা। বিগত বছরগুলোতে সড়ক অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়নের ফলে এই পথে বাকি ছিল কেবল দুটি ফেরি। এরমধ্যে পায়রা নদীতে সেতু চালু হওয়ায় এখন বাকি থাকল কেবল পদ্মা সেতু। আগামী বছর পদ্মা সেতু চালু হয়ে গেলে কোনো ফেরি পারাপার ছাড়াই ঢাকা থেকে সড়কপথে কুয়াকাটা যাওয়া যাবে। তখন কুয়াকাটার ভাগ্য পরিবর্তনের পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি জেলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে কৃষকরা নিজেদের উৎপাদিত পণ্য অল্প সময়ের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় নিতে পারবেন। পণ্যের দামও পাবেন। একটি সেতু দক্ষিণাঞ্চলকে রাজধানী ঢাকার কাছাকাছি নিয়ে আসবে।
পটুয়াখালীসহ দক্ষিণাঞ্চলবাসীর দীর্ঘদিনের অপেক্ষার পালা শেষ হয়েছে। গতকাল পটুয়াখালী জেলার দুমকী উপজেলার লেবুখালীতে স্বপ্নের পায়রা সেতু উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একটি সেতুর মাধ্যমে ফেরি পারাপারের দুর্ভোগ ঘুচিয়ে দক্ষিণাঞ্চলে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় নবদিগন্তের সূচনা হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার এই উন্নয়নে পাল্টে যাবে দক্ষিণাঞ্চলের কোটি মানুষের জীবন যাত্রা।
পটুয়াখালী-বরগুনা জেলাসহ উপকূলীয় অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় সৃষ্টি হবে অভূতপূর্ব উন্নয়ন। খুলে যাবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটার সম্ভাবনার দ্বার। পায়রা সেতু চালুর মধ্য দিয়ে ঢাকার সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগের পথ সুগম হয়েছে পর্যটন নগরী কুয়াকাটা, পায়রা সমুদ্রবন্দর, পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, কোস্টগার্ডের সিজি-বেইজ অগ্রযাত্রা, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর।
জানা যায়, জয়েন্ট ভেঞ্চারে সেতু নির্মাণ করেন লিডিং ঠিকাদার চীনের লো ঝিয়াং কোম্পানি। সেতুর অধিকাংশ মালামালও এসেছে চীন থেকে। করোনার কারণে মালামাল আসায় জটিলতা ছিল। তবে কুয়েত ফান্ড ফর আরব ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট, ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ বিনিয়োগে ১১৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ হয় এই সেতু।
জানা যায়, আগে কুয়াকাটা থেকে প্রায় ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা সময় লেগে যেতো বরিশাল পৌঁছাতে। কুয়াকাটা থেকে পটুয়াখালী পৌঁছাতে ৩টি ফেরি পার হতে হতো। আর পটুয়াখালী থেকে বরিশাল পৌঁছাতে একইভাবে আরও ৩টি ফেরি পার হতে হতো। পায়রা সেতু চালু হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে। সড়ক পথে পটুয়াখালি থেকে বরিশাল আসা যাওয়া করা যাবে। এখন বরিশাল থেকে মাত্র দুই থেকে আড়াই ঘণ্টায় পৌঁছে যাওয়া যাবে পায়রাবন্দর ও সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটায়। ফলে পর্যটন শিল্প সংশ্লিষ্ট অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। পটুয়াখালীসহ আশপাশের জেলাগুলো যোগাযোগ ব্যবস্থায় আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে। ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারিপুর, শরীয়তপুরসহ আশপাশের জেলাগুলোর যোগাযোগ বেড়ে যাবে কুয়াকাটার সঙ্গে। শুধু তাই নয়, রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর যোগাযোগ সহজ করে দিয়েছে একটি সেতু।
জানা যায়, ২০১৩ সালের ১৯ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পটুয়াখালী-বরিশাল মহাসড়কের লেবুখালী ফেরিঘাটের দক্ষিণ পাশে এই সেতুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৬ সালের ২৪ জুলাই সেতুর কাজ শুরু হয়। নানা জটিলতায় ৩ দফা সময় বাড়ানোর ফলে সেতুটি নির্মাণে সময় লেগেছে ৮ বছর। প্রথমত অ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মাণে জমি অধিগ্রহণ, নদী শাসনের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু জটিলতা ছিল। তারপরও চীনা কোম্পানী দক্ষতার সঙ্গে সেতুর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন।
পায়রা সেতু প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, এই সেতু নির্মাণে ১ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এর মধ্যে ৮২ শতাংশ অর্থায়নে ছিল কুয়েত ফান্ড ফর আরব ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এ্যাপেক্স ফান্ড। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী সেতুর আদলেই এক্সট্রা ডোজ ক্যাবল পদ্ধতিতে পায়রা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। সেতুতে থাকা ১৬৭টি বক্স গার্ডার সেগমেন্টের কারণে দূর থেকে দেখলে মনে হয় সেতুটি শূন্যে ভেসে আছে। ১ হাজার ৪৭০ মিটার দৈর্ঘ্য সেতুটি নির্মাণে বসানো হয়েছে ১৩০ মিটার দৈর্ঘ্যরে বেশ কিছু পাইল। এসব পাইল পদ্মা সেতুতে বসানো পাইলের থেকেও অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক। ৩২টি স্প্যানের মূল সেতুটি বিভিন্ন মাপের ৫৫টি টেস্ট পাইলসহ ১০টি পিয়ার পাইল ও পিয়ার ক্যাপের ওপর নির্মিত।
সেতু নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী আব্দুল হালিম বলেন, এ সেতু সর্বোচ্চ জোয়ারেও নদীর উপরিভাগ থেকে ১৮.৩০ মিটার উঁচুতে থাকবে। ৪ লেন বিশিষ্ট এই সেতুতে মনোরম আলোকসজ্জা করা হয়েছে। সেতুর আলোতে ঝলমল করছে পায়রা নদী সংলগ্ন এলাকা। বাংলাদেশে এই প্রথম পায়রা সেতুতে বসানো হয়েছে হেলথ মনিটরিং সিস্টেম। ভূমিকম্প, বজ্রপাত এবং ওভারলোডেড গাড়ির ক্ষেত্রে এই সিস্টেম আগাম সংকেত দেবে। ফলে বড় ধরনের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে সেতুটি।
সেতুতে যানবাহন পারাপারে যে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে তা ফেরির তুলনায় কয়েকগুন বেশি বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, যেখানে ফেরিতে যাত্রীবাহী বাস পার হতে ৫০ টাকা লাগতো, সেখানে সেতুর টোল ধরা হয়েছে ৩৪০ টাকা। অন্যান্য যানবাহনের ক্ষেত্রেও একই হারে বাড়ানো হয়েছে টাকার অঙ্ক।
বাঁচলো ৫২ কোটি টাকা : দক্ষিণ বাংলার মানুষের আকাক্সক্ষা ও স্বপ্নের পায়রা সেতুর উদ্বোধনের পর সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে। অন্যান্য প্রকল্প নির্মাণে কয়েক দফায় ব্যায় বাড়ানো হলেও পায়রা সেতু নির্মাণে ৫২ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে চীনের ঠিকাদার কোম্পানি লো ঝিয়াং। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম তার বক্তব্যে জানান, করোনা ঝুঁকিতেও এই সেতুর কাজ অব্যাহত রাখতে সংশ্লিষ্ট সবাই সচেষ্ট ছিলেন। সময় বর্ধন এবং নানাবিধ জটিলতার মধ্যেও প্রকল্পের পূর্ত কাজের চুক্তি মূল্য থেকে ৫২ কোটি ২৫ লাখ টাকা সাশ্রয় হয়েছে।
নির্মাণশৈলীর দিক থেকে নান্দনিক শোভামণ্ডিত এই সেতুটি ইতোমধ্যে স্থানীয় মানুষের নজর কেড়েছে। প্রতিদিন অগণিত মানুষ এ সেতুটি দেখার জন্য ভিড় করছে। বিশেষ করে রাতের আলোকিত সেতু মানুষকে আকৃষ্ট করছে। তিনি বলেন, পায়রা সেতু নির্মাণের বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে সহজসাধ্য মনে হলেও এর তলদেশে পানির স্রোত ছিল তীব্র এবং নদীর গতি প্রকৃতি ছিল অভিনব। যেটিকে পদ্মার সঙ্গে তুলনা করা চলে। এছাড়া চ্যানেলের তলদেশে গভীরতা পাওয়া যায় ৪৩ মিটার। আধুনিক প্রযুক্তি যন্ত্রপাতির ব্যবহার করা হয়েছে এ সেতু নির্মাণে। ভায়াডাক্টসহ ৩৩৮টি পাইলের মধ্যে ৪০টি পাইলের গভীরতা ১৩০ মিটার। যা এ যাবতকালের সর্বাপেক্ষা গভীর। নদীর মধ্যে পিলার-টু-পিলার বা স্প্যানের গ্যাপ রাখা হয়েছে ২শ’ মিটার। এটিও এ যাবতকালের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশ সরকার (জিওবি), কুয়েত ফান্ড এবং ওপেক ফান্ডের অর্থায়নে এ সেতুটি নির্মাণে ব্যয় হয়ে ১৪৪৭ দশমিক ২৪ কোটি টাকা। ১৪৭০ মিটার দৈর্ঘ্যরে এ সেতুটির প্রস্থ ১৯ দশমিক ৭৬ মিটার। আর সেতুর সংযোগ সড়কের দৈর্ঘ্য ১২৬৮ মিটার এবং প্রস্থ ২২ দশমিক ৮০ মিটার। এ সেতুতে ৩২টি স্প্যান ও ৩৩৮টি পাইল রয়েছে। এর মধ্যে মূল সেতুর পাইল সংখ্যা ৫২টি। এছাড়া পিলার সংখ্যা ৩১টি।