ডেস্ক নিউজ
দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়তে থাকায় সমুদ্রপথে পণ্য আমদানি বাড়ছে। এসব পণ্য আমদানিতে বিদেশি জাহাজের ওপর ভরসা করতে হতো। এর পর নিজেরাই জাহাজ বানাতে শুরু করলেন বিনিয়োগকারীরা। এখন বিদেশে জাহাজ রপ্তানিতে সাফল্য আসতে শুরু করেছে। ভারতের সঙ্গে নৌচুক্তি হয়েছে। তাতে অভ্যন্তরীণ নৌপথে পণ্য পরিবহনের পাশাপাশি ভারতে পণ্য পরিবহনের বড় অংশীদার হতে পারবে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক মান সনদধারী জাহাজ নির্মাণ করে বিশ্বে আবারও মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশ।
বিশ্ববাজারে ছোট ও মাঝারি নৌযানের জন্য বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণশিল্প গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। যদিও এ খাত প্রধানত অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা পূরণ করে। দেশের প্রায় ৯০% জ্বালানি, ৭০% কার্গো এবং ৩৫% যাত্রীর যাতায়ত নৌপথে, যা দেশের অভ্যন্তরে জাহাজের চাহিদা ব্যাপক বাড়িয়েছে। এখন দেশে তৈরি জাহাজ রপ্তানিও হচ্ছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের বড় খাত তৈরি হয়েছে। শিল্পের জন্য বিপুল কাঁচামাল ও ভোগ্যপণ্য আমদানি করছে বড় বড় শিল্প গ্রুপ। এসব পণ্য বন্দর থেকে অভ্যন্তরীণ নৌপথে নিজেদের গুদামে বা কারখানায় কাঁচামাল ও পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক মানের সনদপ্রাপ্ত জাহাজ নির্মাণ হচ্ছে দেশেই।
চট্টগ্রামভিত্তিক জাহাজ নির্মাণ কোম্পানি এফএমসি ডকইয়ার্ড লিমিটেড সুদান সরকারের কাছ থেকে এএসডি টাগবোট নির্মাণের জন্য একটি নতুন কার্যাদেশ পেয়েছে, এই অত্যাধুনিক নৌযানের রপ্তানি মূল্য এক কোটি ৩০ লাখ ডলার।
সর্বশেষ বাংলাদেশের তৈরি পণ্যবাহী কনটেইনার জাহাজ যুক্তরাজ্যে রপ্তানি করেছে আনন্দ শিপইয়ার্ড। ৬ হাজার ১০০ টন ধারণক্ষমতার জাহাজটি কিনেছে যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠান এনজিয়ান শিপিং কোম্পানি লিমিটেড। জাহাজটি রপ্তানি করে ১০০ কোটি টাকার বেশি আয় করেছে বাংলাদেশ।
আনন্দ শিপইয়ার্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৮ সাল থেকেই বৈশ্বিক বাজারে আবারও অবস্থান ফেরাতে শুরু করেছে বাংলাদেশের জাহাজশিল্প। দীর্ঘদিন পর ২০২০ সালে করোনার শুরুতে ৫৫০০ ডিডব্লিউটির আরেকটি জাহাজ রপ্তানি হয়। এখন রপ্তানির অপেক্ষায় আরও তিনটি জাহাজ। ২০১০ সাল থেকে টানা ১০ বছরের মন্দা কাটিয়ে এটি আনন্দ শিপইয়ার্ডের দ্বিতীয় জাহাজ রপ্তানি। গত দুই বছরে দেশ থেকে কোনো সমুদ্রগামী জাহাজ রপ্তানি হয়নি। ফলে এ সময়ে ‘জাহাজ’ নির্মাণ খাত থেকে রপ্তানি আয় বলতে গেলে শূন্যই ছিল। উদীয়মান খাতটির এমন দুঃসংবাদ পাশে ঠেলে এবার নতুন নতুন জাহাজ তৈরি করে এই খাতের সুদিন ফেরার আভাস।
সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় চলাচলকারী যেসব জাহাজ নিবন্ধিত হচ্ছে, সেগুলো এখন মূলত দেশীয় জাহাজ নির্মাণ কারখানায় তৈরি হচ্ছে। এখন আগের মতো আর আমদানি করতে হচ্ছে না। জাহাজ নির্মাণ খাতে বিনিয়োগের সুফল অনেক বেশি। জাহাজ আমদানি কমে আসায় বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে। দেশে কর্মসংস্থান হচ্ছে। আবার আন্তর্জাতিক মানের জাহাজ নির্মাণ করে জাহাজ রপ্তানির জন্য নিজেদের প্রস্তুত করছেন উদ্যোক্তারা, যাদের ভারী শিল্পে বিনিয়োগের সক্ষমতা অনেক বেশি।
আন্তর্জাতিক মান সনদ মেনে জাহাজ নির্মাণের অনুমোদিত কারখানার সংখ্যাও বাড়ছে। বছর পাঁচেক আগেও এই সংখ্যা ছিল ১০টি। এখন তা বেড়ে ১৫টিতে উন্নীত হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে এখন ছোট আকারে চার হাজারের মতো লাইটার জাহাজ রয়েছে। এসব জাহাজে পণ্য পরিবহন ক্ষমতা গড়ে ১ হাজার ২০০ টনের মতো। ঢাকা-চট্টগ্রাম নৌপথের গভীরতা অনুযায়ী, এখন তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টন পণ্য পরিবহনকারী জাহাজ চলতে পারে।
এ বিষয়ে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, জাহাজ নির্মাণশিল্প একটি সম্ভাবনাময় রপ্তানি খাত। অত্যাধুনিক জাহাজ নির্মাণে আমাদের দক্ষতা রয়েছে। আমারা প্রত্যাশা করছি, ভবিষ্যতে এ শিল্পটি তৈরি পোশাকশিল্পের কাছাকাছি রপ্তানি আয় অর্জন করতে পারবে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, সমুদ্রসীমা জয় করলেও আমরা সমুদ্রসম্পদকে কাজে লাগাতে পারিনি। এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছি। সম্ভাবনাময় এ খাত এগিয়ে নেওয়া জরুরি। সরকার এটিকে গুরুত্ব দিয়ে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম, মাতারবাড়ী, মোংলা, পায়রাসহ সব বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে।
আনন্দ শিপইয়ার্ডের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহেল বারী বলেন, ২০০৮ সালে ডেনমার্কে অত্যাধুনিক কনটেইনার জাহাজ ‘স্টেলা মেরিস’ রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রথম জাহাজ রপ্তানি শুরু করি আমরা। এর পর মাত্র দুই বছরে বিভিন্ন দেশে ১১টি জাহাজ রপ্তানি হয়। এখন আবার রপ্তানি বাজার উন্মুক্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, আনন্দ শিপইয়ার্ড ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে সোনারগাঁওয়ের মেঘনাঘাটে আন্তর্জাতিক মানের জাহাজ নির্মাণ করছে। ইয়ার্ডের বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ৩০ হাজার টন। দেশি-বিদেশি ক্রেতাদের কাছে ৩৫৬টি জলযান নির্মাণ করে সরবরাহ করেছি। রপ্তানি বাজারে আরও ভালো করার সক্ষমতা আমাদের রয়েছে।
জাহাজশিল্পের সঙ্গে যুক্ত উদ্যোক্তারা বলছেন, ইউরোপের বাজারে পরিবেশবান্ধব জাহাজের চাহিদা বাড়ায় রপ্তানিতে নতুন নতুন কার্যাদেশ আসতে শুরু করেছে। বাংলাদেশও এখন এসব জাহাজ নির্মাণ করছে। জাহাজ নির্মাণে অনুকূল পরিবেশ থাকায় এ খাতে নতুন বিনিয়োগ বৃদ্ধিরও পরিকল্পনা রয়েছে উদ্যোক্তাদের। তবে এ খাতের বড় চ্যালেঞ্জ জাহাজের নির্মাণসামগ্রী, বিশেষ করে রডের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এটি সামাল দিতে পারলে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়বে।
সাত বছর আগেও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের উপকূলীয় বাণিজ্যের জন্য আন্তর্জাতিক মান সনদপ্রাপ্ত কোনো জাহাজ খুঁজে পায়নি নৌপরিবহন পরিবহন অধিদপ্তর। যে ২২টি জাহাজ বাছাই করেছিল তৎকালীন সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর, তার কোনোটিরই আন্তর্জাতিক মান সনদ ছিল না। এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে।
জাহাজ নির্মাণে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ হচ্ছে কিনা, তা প্রতিটি ধাপে তত্ত্বাবধান করে সনদ দেয় আন্তর্জাতিক ক্ল্যাসিফিকেশন সোসাইটির সদস্যভুক্ত ১২টি প্রতিষ্ঠান। একসময় দেশে শুধু রপ্তানিযোগ্য জাহাজই আন্তর্জাতিক মান তত্ত্বাবধানকারী সংস্থার অধীনে তৈরি হতো।
আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় চলাচলের জন্য এসব জাহাজের উপযুক্ত কারিগরি ও নিরাপত্তাব্যবস্থা রয়েছে। দেশে এসব জাহাজ নির্মাণের অনুমতি ও নিবন্ধন দেয় চট্টগ্রামের নৌবাণিজ্য কার্যালয়। নৌবাণিজ্য কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে দেশে পণ্য পরিবহনের আন্তর্জাতিক মান সনদপ্রাপ্ত জাহাজের সংখ্যা বাড়ছে। এ সময়ে এলপিজি, জ্বালানি ও ভোজ্যতেল, সাধারণ পণ্য ও কনটেইনার পরিবহনের ৭০টির বেশি জাহাজ নির্মিত হয়েছে। নির্মাণাধীন আছে আরও ৩০টি জাহাজ। দেশের অভ্যন্তরে ব্যবহারের জন্য স্থানীয়ভাবে নির্মিত নৌযানের মধ্যে রয়েছে এমপিভি, কনটেইনার, বাল্কার, ট্যাঙ্কার, ড্রেজার, টাগ এবং যাত্রীবাহী ফেরি। আকারে এগুলো এক হাজার থেকে ২০ হাজার ডিডব্লিউটির মধ্যে। দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৩০০ শিপইয়ার্ড রয়েছে; যদিও এর মধ্যে মাত্র ১০টি প্রতিষ্ঠান রপ্তানিযোগ্য জলযান তৈরি করে। অভ্যন্তরীণ বাজার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে বাড়লেও ৫ থেকে ৬ শতাংশ হারে বাড়ছে রপ্তানি বাজার।
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, জাহাজ নির্মাণশিল্পে পাঁচ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ ১৩ ধাপ এগিয়ে ১৪ নম্বরে উন্নীত হয়েছে। পেছনে ফেলে দিয়েছে পাঁচ বছর আগে বাংলাদেশের ওপরে থাকা যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, সিঙ্গাপুর, স্পেন ও রোমানিয়া, মালয়েশিয়া, নরওয়ে ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশকে। ২০২০ সালে বৈশ্বিক মান সনদধারী জাহাজ নির্মাণের তথ্য ব্যবহার করে এই হিসাব করেছে সংস্থাটি।