ডেস্ক নিউজ
করোনাভাইরাসের সংক্রমণে বিশ্ব আজ থমকে গেছে। ভেঙে পড়ছে অর্থনীতি, জীবন যাত্রা ঘরে বন্দি। এক দেশ আরেক দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। দেশে দেশে মানুষে মানুষে অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রয়োজনের তুলনায় কতটা অপ্রতুল তা আজ বিশ্ব হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
প্রয়োজনীয় হাসপাতাল নেই, মাস্ক নেই, টেস্টিং কীট নেই, ভেন্টিলেটর যন্ত্র নেই, ডাক্তার নেই। মোট কথা চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে উন্নত দেশগুলোও আজ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আসলে নতুন এই ভয়াবহ অবস্থার জন্য বিশ্বের কোনো দেশই প্রস্তুত ছিল না। কোনো কোনো দেশ উত্তরণের উপায় না পেয়ে অসহায় আত্মসমর্পণ করেছে। ভয়াবহতা অনুধাবন করতে পেরে কর্তা ব্যাক্তিরা কেউ কেউ জাতির সামনে কান্নাকাটি করছেন, কেউ বা বিধাতার উপর ছেড়ে দিয়েছেন। আসলেই প্রকৃতির কাছে সব কিছুই যেন আজ অসহায়। সারা বিশ্ব এখন একটা বিষয় নিয়েই ব্যস্ত তা হচ্ছে চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে। করোনা থেকে কিভাবে বাঁচা যায়, কিভাবে সংক্রমণ রোধ করা যায় দেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। মাত্র ৫৫ হাজার বর্গমাইলের দেশে ১৭ কোটি মানুষের বাস। প্রয়োজনের তুলনায় সরকারের পদক্ষেপ যতই থাকুক না কেন ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে কিছু মানুষ অভাব অভিযোগের পাল্লা ভারি করার চেষ্টা/অপচেষ্টা করবে- এটাই বাস্তবতা। তবে দেখার বিষয় হচ্ছে সরকার বিদ্যমান বিষয়গুলো নিয়ে ওয়াকিবহাল কিনা, ব্যবস্থা নিচ্ছে কিনা। ঘটনা ঘটবে না এমন কোনো দেশ নেই। কিন্তু মোদ্দা কথা হচ্ছে সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে কিনা। এই জায়গাটায় শেখ হাসিনার সরকার পুরোপুরি সফল। এরপরও ব্যবস্থাপনা নিয়ে কিছু অব্যবস্থাপনা থাকবেই। ঐ যে বললাম ১৭ কোটি মানুষের দেশে শত মত,শত পথ ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকেই করোনা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে শুরু করেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ নিয়ে কাজ শুরু করেন। বিদেশ প্রত্যাগতদের জন্য বিশেষ কোয়ারেন্টাইন চালু করেন। বিমানবন্দর থেকেই প্রত্যাগতদের নাম ঠিকানা সাথে সাথেই যার যার এলাকার জেলা প্রশাসকদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে যাতে নজরদারি রাখা যায়।
গ্রামেগঞ্জে প্রশাসনও সেই অনুযায়ীই কাজ করেছে। লক্ষণবিহীন ও সন্দেহজনক নয় এমন যাত্রীদের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার পরামর্শ দেয়া হয় এবং তাদের নিয়মিত ফলোআপ করা হয়।
এছাড়া দেশের সকল বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর এবং স্থলবন্দরে বিদেশ প্রত্যাগত যাত্রীদের থার্মাল স্ক্যানার ও ইনফ্রারেড থার্মোমিটারের মাধ্যমে স্ক্রিনিং করা হয়। লক্ষণযুক্ত এবং সন্দেহভাজন যাত্রীদের কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। শেখ হাসিনার নির্দেশে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা ও আইইডিসিআর যৌথভাবে কাজ শুরু করে।
আইইডিসিআর-এ কন্ট্রোল রুম খোলা হয় এবং রোগটি মোকাবিলায় প্রস্তুতি শুরু করা হয়।এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পৃথক পৃথক কন্ট্রোল রুম চালু করে। এগুলোর মাধ্যমে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ভাইরাসসহ সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে পূর্ব অভিজ্ঞতা ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসরণ করে তিন-স্তর বিশিষ্ট কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট বিদেশি সংস্থা, চিকিৎসা পেশার প্রতিনিধি সকলকে নিয়ে জাতীয় কমিটি হয়েছে। বিভাগ, জেলা, উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি গঠিত হয়েছে। সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
শিল্প কারখানায় আংশিক ছুটি, পর্যটন কেন্দ্র, বিপণি বিতান এবং সড়ক, নৌ, রেলসহ সকল গণপরিবহণ বন্ধ করা হয়েছে এবং জনসাধারণকে ঘরে থাকার ও সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
অর্থাৎ অনেক উন্নত দেশও যখন কোন পদক্ষেপই নেয়নি, এর আগেই করোনা প্রতিরোধে প্রস্তুতি গ্রহণ করে বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার সময়োপযোগী নেয়া সিদ্ধান্তের ফলেই এতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখনো তুলনামূলক ভালো অবস্থানে রয়েছে।
বিশ্বের সবাই যখন ব্যস্ত করোনা প্রতিরোধে অন্যদিকে তখন বিশ্ব অর্থনীতিতে অশনি সংকেত। সেই বেহাল অবস্থার অর্থনীতি থেকে উত্তরণের কোনো পরিকল্পনা এখনও চোখে পড়েনি। বিপন্ন জনগোষ্ঠির জীবনযাত্রাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার কোন পরিকল্পনার কথা এখনো শোনা যায়নি। অথচ বিদেশি সংবদপত্রগুলোতেও বিশ্ব অর্থনীতির অশনিসংকেত নিয়ে সংবাদ ফিচার প্রকাশিত হচ্ছে। বিশ্ব নেতৃবৃন্দের যত প্রেস ব্রিফিং দেখেছি এর সবই করোনা পরিস্থিতির আপডেট ও চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে। এইদিক থেকেও অনেক এগিয়ে আছেন শেখ হাসিনা।
ইতিমধ্যে দেশের অর্থনীতিতে করোনার বিরূপ প্রভাব পড়তে পড়তে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে আমদানি ব্যয় ও রফতানি আয় ১ শতাংশ কমে গেছে। শেয়ারবাজারে ওপর প্রভাব পড়েছে। বিশ্বে জ্বালানি তেলের দাম কমে গেছে। করোনার প্রভাব প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রেও পড়তে পারে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে যাওয়ায় জিডিপির প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেতে পারে।সম্ভাব্য বিপদের কথা আঁচ করতে পেরেছেন বলেই তিনি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দেশের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাব থেকে উত্তরণের জন্য ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত রোববারের সংবাদ সম্মেলনে।
সম্ভাব্য বেহাল অবস্থা থেকে উত্তরণে সহায়তার পদক্ষেপ হিসেবে তাৎক্ষণিক করণীয়, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সরকারি ব্যয়বৃদ্ধি ও কর্মসৃজনকে প্রাধান্য দেয়ার কথা বলেছেন। যার ফল পাবে নিম্নবিত্ত মানুষ। শ্রমিক-কর্মচারী বা অন্যান্য কর্মজীবী মানুষ যাতে কর্মহীন না হয়ে পড়েন, সে জন্য তিনি আর্থিক সহায়তা প্যাকেজ ঘোষনা করেছেন। ঋণসুবিধা দেওয়ার কথা বলেছেন।
সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের ব্যাপকতা বাড়িয়েছেন। এসবের আওতায় দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনগণ, দিনমজুর এবং দিনে এনে দিনে খায় এরকম মানুষের জন্য বিনামূল্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ, ১০ টাকা কেজি দরে চাউল বিক্রয়, দরিদ্র জনগোষ্ঠির মাঝে নগদ অর্থ বিতরণ, “বয়স্ক ভাতা’ এবং ‘বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলাদের জন্য ভাতা’ কর্মসূচির আওতা সর্বাধিক দারিদ্র্যপ্রবণ ১০০টি উপজেলায় শতভাগে উন্নীত করা, এবং জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গৃহীত অন্যতম কার্যক্রম গৃহহীন মানুষদের জন্য গৃহ নির্মাণ কর্মসূচি দ্রুত বাস্তবায়ন করা।
শেখ হাসিনার গৃহীত কর্মসূচীর প্রথম প্যাকেজের আওতায় ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল-সুবিধা দেওয়া, ব্যাংক-ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্প সুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল দেয়ার লক্ষ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ সুবিধা প্রণয়ন করা হয়েছে। এ ঋণসুবিধার সুদের হার হবে ৯ শতাংশ। প্রদত্ত ঋণের সুদের অর্ধেক অর্থাৎ ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ ঋণগ্রহীতা শিল্প বা ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে এবং অবশিষ্ট ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেবে।
দ্বিতীয় প্যাকেজের আওতায় ক্ষুদ্র (কুটিরশিল্পসহ) ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল-সুবিধা প্রদান: ব্যাংক-ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্প সুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল প্রদানের লক্ষ্যে ২০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণসুবিধা প্রণয়ন করা হয়েছে। এ ঋণসুবিধার সুদের হারও হবে ৯ শতাংশ। ঋণের ৪ শতাংশ সুদ ঋণগ্রহীতা শিল্প-প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে এবং অবশিষ্ট ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসাবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেবে।
তৃত্বীয় প্যাকেজের আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবর্তিত এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের (ইডিএফ) সুবিধা বাড়ানো হচ্ছে। ব্লক টু ব্লক এলসির আওতায় কাঁচামাল আমদানি-সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইডিএফের বর্তমান আকার ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হবে। ফলে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অতিরিক্ত ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ইডিএফ তহবিলে যুক্ত হবে। ইডিএফের বর্তমান সুদের হার ২.৭৩% থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হবে।
চতুর্থ প্যাকেজের আওতায় প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিম নামে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ হাজার কোটি টাকার একটি নতুন ঋণসুবিধা চালু করবে। এ ঋণসুবিধার সুদের হার হবে ৭ শতাংশ। পঞ্চম প্যাকেজের আওতায় রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করার জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি আপৎকালীন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
শেষ প্যাকেজটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও আগেই ঘোষণা করেছিলেন। আমার এই লেখাটির শিরোনামটির নামকরণটি এই জন্যই “ সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে শেখ হাসিনা”। সবাই যখন কি হবে, কি হবে, হায় হায় রবে ব্যস্ত তখন শেখ হাসিনা করোনা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি অর্থনীতির সম্ভাব্য ক্ষতি নির্ধারণ করে ইতিমধ্যেই পদক্ষেপ নিয়ে ফেলেছেন। তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের সরকার প্রধানের দৃঢ় হাতে এই দূরদর্শী পদক্ষেপ ইতিমধ্যেই সর্ব মহলে প্রশংসিত হতে শুরু করেছে। এখানেই অন্যান্যদের থেকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের পার্থক্য। তিনি সব সময় এগিয়ে থাকেন। দেশের জন্য , দেশের মানুষের জন্য।