ডেস্ক নিউজ
‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ শিরোনামে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতি ছিল- সমৃদ্ধির পথে দেশকে আরো এগিয়ে নেয়া, গণতন্ত্র, নির্বাচন ও কার্যকর সংসদ, আইনের শাসন ও মানবাধিকার সুরক্ষা, দক্ষ, সেবামুখী ও জবাবদিহিতামূলক প্রশাসন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও মাদক নির্মূল করা। গ্রাম হবে শহর- স্লোগানে জনগণকে স্বপ্ন দেখানো হয়েছে- প্রতিটি গ্রামে নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দেয়া, যুবসমাজকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর, কর্মসংস্থান নিশ্চত করার পাশাপাশি শিক্ষা, দক্ষতা ও কর্মসংস্থান বাড়ানো, আত্মকর্মসংস্থান ও তরুণ উদ্যোক্তা তৈরি, দারিদ্র্য বিমোচন ও বৈষম্য হ্রাস, কৃষি, খাদ্য ও পুষ্টি অর্জনে নিশ্চয়তার। এসব প্রতিশ্রুতি পূরণে কতটা সফল শেখ হাসিনার সরকার? গত তিনটি বছর সরকার পরিচালনার অনুভূতিইবা কী ক্ষমতাসীনদের? বিগত তিনটি বছর খুব যে স্বস্তিতে গেছে- তা বলা যাবে না। এই তিন বছরের দুবছর চলে গেছে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে। আছে নানা অতৃপ্তিও। ক্ষেত্র বিশেষে কিছু বিব্রতকর পরিস্থিতিরও মুখোমুখি হতে হয়েছে। বিশেষ করে দলের তৃণমূলের দ্বন্দ্ব, কোনো কোনো মন্ত্রী-এমপি-নেতা হঠকারী কর্মকাণ্ডে নীতি-নির্ধারকরা বিব্রত হয়েছেন বারবার। অবশ্য শেখ হাসিনার সময়োচিত পদক্ষেপে তা সামালও দেয়া গেছে। তবে মৌলবাদ তোষণের কারণে সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে ক্ষমতাসীনদের। আবার এ বছরের শেষার্ধে এসে শারদীয় দুর্গাপূজা ঘিরে বর্বর সাম্প্রদায়িক হামলা নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের ব্যর্থতায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে সরকার। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে দলের ভূমিকাও বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না। এ নিয়ে ভাবমূর্তির সংকটে পড়ে দেশ, সরকার ও দল- তিনটিই।
সব হিসাব মিলিয়ে বিগত তিন বছরের অর্জন ও ঘাটতির হিসাব মেলাচ্ছেন দল ও সরকারের নীতিনির্ধারকরা। হাতে আছে আরো দুই বছর। এই সময়ে জঙ্গি-সন্ত্রাস দমন করে অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল রেখে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়াই সরকারের লক্ষ্য। এক্ষেত্রে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণকেই গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। পাশাপাশি ভোটের বিষয়টি মাথায় রেখে দল গোছানোয় মনোযোগ দেবে ক্ষমতাসীনরা। বিশেষত বিগত নির্বাচন নিয়ে বিরোধী পক্ষের অপপ্রচার ও ক্ষেত্র বিশেষে নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতার কারণে দেশে-বিদেশে নানা সমালোচনা হয়েছে। আগামী নির্বাচনে যাতে এমন পরিস্থিতি এড়ানো যায়; সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দেবে সরকার ও দল।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। ফাইল ফটো
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে জয়ী হয়ে ২০১৯-এর ৭ জানুয়ারি টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। আজ তিন বছর পূর্তি। তিন বছর সময়কালে সরকারের সাফল্য অর্জন অনেক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। জাতির পিতার হাতে গড়া সেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময়েই এ দেশের স্বাধীনতা ও বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপিত হয়েছে। আবার বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী মুজিববর্ষও উদযাপন হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বেই।
উন্নয়নে বদলে গেছে দৃশ্যপট : মানুষের জীবন ও জীবিকার উন্নয়ন এ সরকারের একটি বড় অর্জন। গত কয়েক বছরে মাথাপিছু গড় আয় অনেক বেড়েছে। ২০০৯ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ৭০৯ মার্কিন ডলার। এখন তা ২ হাজার ৫৫৪ মার্কিন ডলার। ২০০৯ সালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১০ বিলিয়ন ডলার। এখন তা ৫০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। একসময় বিদ্যুতের ব্যাপক সংকট ছিল। প্রতি ঘণ্টায় একাধিকবার লোড শেডিং হতো। দেশে এখন বিদ্যুতের সেই সংকট নেই। বাংলাদেশ এখন ২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম। যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্নয়নের আরেক নাম বাংলাদেশ। দেশের আট বিভাগকেই ফোর লেন সড়ক যোগাযোগের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। সদ্য বিদায়ী বছরে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করেছে বাংলাদেশ। পেয়েছে টেকসই (এসডিজি) লক্ষ্যমাত্রার অগ্রযাত্রার পুরস্কারও। দেশে এখন সাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ২ শতাংশ। গড় আয়ু বেড়ে ৭২ দশমিক ৮ বছর হয়েছে। অন্যদিকে দেশে দারিদ্র্যের হার কমে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে ব্যাপক উন্নতি করেছে। বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক ভোরের কাগজকে বলেন, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। মেগা প্রকল্প, খাদ্য, পুষ্টি, কৃষি, গ্রাম শহরে সুষম উন্নয়নে গুরুত্ব রয়েছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা বড় চ্যালেঞ্জ। ধর্মীয় জঙ্গি, নারী ও শিশু পাচার, মাদক নিয়ন্ত্রণ চ্যালেঞ্জ। এসব ক্ষেত্রে আমাদের দুর্বল দিক রয়েছে, সত্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হস্তে দমন করতে হবে।
সৃজনশীল অর্থনীতির জন্য ইউনেস্কো-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রাপ্ত উগান্ডার বেসরকারি সংস্থা মোটিভ ক্রিয়েশনস লিমিটেডের প্রধান। ছবি: পিএমও
স্বপ্ন ছুঁয়েছে মেগা প্রকল্প : নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হবে এ বছরের ডিসেম্বরে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা ও মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালসহ আরো কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার যুগান্তকারী প্রকল্প বঙ্গবন্ধু টানেল দিয়ে এ বছরই গাড়ি চলবে। এরই মধ্যে বহুল প্রত্যাশিত টানেলের কাজের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৭৬ শতাংশ। ব্যয়বহুল প্রকল্প মেট্রোরেলের আনুষ্ঠানিকভাবে পরীক্ষামূলক চলাচল শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত চারটি স্টেশনের কার্যক্রম শেষ হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে মেট্রোরেল উদ্বোধন হবে। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, আগামী জুনের মধ্যে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হবে, এরপর কর্ণফুলী টানেলের উদ্বোধন হবে এবং বছর শেষে মেট্রোরেল উদ্বোধন করবেন শেখ হাসিনা। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, গত তিন বছরে সরকার মেগা প্রকল্পে যতটা গুরুত্ব দিয়েছে স্থানীয় উন্নয়নে ততটা নয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলের রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামো উন্নয়ন আশানুরূপ হয়নি।
বিশ্বে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতাসীন নারী : নারী হিসেবে দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকার অনন্য রেকর্ড অর্জন করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার রেকর্ড ধরে রেখেছেন। শেখ হাসিনা টানা ১৩ বছর হলেও চার মেয়াদে এরই মধ্যে ১৮ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। এই মেয়াদ পূর্ণ হলে ২০ বছর সরকার পরিচালনার অনন্য কৃতিত্ব অর্জন করবেন তিনি।
জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু চেয়ার : জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ছায়া দেবেন বঙ্গবন্ধু। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে তার সম্মানে গত ২১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সদর দপ্তরের উত্তর লনের বাগানে একটি বেঞ্চ উৎসর্গ এবং সেই সঙ্গে একটি বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, এই বৃক্ষও শতবর্ষের ওপর টিকে থাকবে। শান্তির বারতাই বয়ে বেড়াবে।
ইউনেস্কো-বঙ্গবন্ধু পুরস্কার : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে আন্তর্জাতিক পুরস্কার দিয়েছে ইউনেস্কো নির্বাহী সংসদ। এটিই প্রথম বঙ্গবন্ধুর নামে কোনো আন্তর্জাতিক পুরস্কার। গত ১১ নভেম্বর প্যারিসে ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ ফর দ্য ক্রিয়েটিভ ইকোনোমিকস’ নামের এ পুরস্কার বিজয়ী উগান্ডার মোটিভ ক্রিয়েশনের হাতে তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পদ্মা সেতু
দল গোছানোর মনোযোগ : নির্বাচনমুখী দল হিসেবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য দলকে প্রস্তুত, ঐক্যবদ্ধ করতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এজন্য নতুন বছরে ঘর গোছানোর কাজে মনোযোগ দিতে চায় দলটি। কোনো কোনো মন্ত্রী-এমপি এবং দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতার কারণে বারবার ব্রিতকর পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছে ক্ষমতাসীন দলটিকে। এবার তৃণমূলে দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, ভুল বোঝাবুঝি, নেতৃত্বের সংঘাত সবকিছু মিলিয়ে নির্বাচনের আগে দলকে ঐক্যবদ্ধ করাই দলটির অন্যতম লক্ষ্য। নির্বাচনের বছরে যে কোনো অপতৎপরতা মোকাবিলায় নেয়া হবে নানা পরিকল্পনা। জনগণের প্রত্যাশা পূরণের দল হিসেবে নতুন বছরে জনগণের সমর্থন নিয়েই এগিয়ে যেতে চায় আওয়ামী লীগ। এছাড়া নতুন বছরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা চায় দলটি। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান বলেন, নতুন বছরে আমরা আমাদের ঘর গোছানোর কাজ শুরু করব। কোনো সমস্যা থাকলে সেগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানের চেষ্টা করব।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের টার্মিনাল-৩। চলছে নির্মাণ কাজ
চ্যালেঞ্জও পাহাড়সম : উন্নয়নের পাশাপাশি গত তিন বছরে জঙ্গি-মৌলবাদীগোষ্ঠীর তাণ্ডবে সরকারকে বারবার হোঁচট খেতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙা, সুনামগঞ্জের শাল্লায় হামলা, দুর্গোৎসবে সাম্প্রদায়িক হামলায় বিব্রত সরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক ড. শান্তনু মজুমদার ভোরের কাগজকে বলেন, উন্নয়ন এবং সুশাসন শব্দ দুটি সমান্তরাল। সরকারকে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নে পৌঁছাতে সুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি। প্রয়োজন জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা, সরকারে-দলে গণতন্ত্র চর্চা, দলীয় দুর্বৃত্তায়নসহ দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। এক্ষেত্রে নাগরিকদেরও সঠিক দায়িত্বপালন প্রয়োজন। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন ভোরের কাগজকে বলেন, বাংলাদেশে সরকার পরিচালনা সবসময়ই চ্যালেঞ্জিং বিষয়। নতুন করে কোনো চ্যালেঞ্জ আমি দেখছি না। এখন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, ওমিক্রনের সম্ভাব্য ধাক্কা সামলানো এবং অর্থনীতির চাকা স্থিতিশীল গতিতে এগিয়ে নেয়া। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক কিছু ঝামেলা আসবে- সেটি মোকাবিলা করার সামর্থ্য সরকারের আছে। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে শেখ হাসিনার স্থিতিকৃত লক্ষ্য পূরণের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মধারা পরিচালনার ক্ষেত্রে সব জনগণের সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি।