অস্ত্রটির নাম উজি। পয়েন্ট টুটু বোর পিস্তল। ইসরায়েল-বেলজিয়ামসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা অস্ত্রটি ব্যবহার করে থাকে। দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যেসব পিস্তল ব্যবহার করে থাকে তার চেয়ে এটি অনেক বেশি আধুনিক। আমদানিকারকরা কারসাজি করে সেই অস্ত্র আনছে বাংলাদেশে। পয়েন্ট টুটু বোরের লাইসেন্স নেওয়া আছে এমন অনেকেই আইনের ফাঁক গলে অত্যাধুনিক এই অস্ত্র নিজের কাছে রাখছে। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পুলিশ। বুধবার (২৮ অক্টোবর) ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে পুলিশ কমিশনারের কাছে একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এই অস্ত্র কোনওভাবে জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের হাতে চলে গেলে তা ভীষণ দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকেও বিশেষজ্ঞ মতামতে এই অস্ত্রকে মিলিটারি গ্রেডের উল্লেখ করে এটিকে কোনওভাবেই সাধারণ মানুষের হাতে তুলে না দিতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞ কমিটি বলেছে, এটি কেবল উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বা ভিআইপিদের নিরাপত্তা প্রদানের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, ‘এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি আমরা আরও গভীরভাবে তদন্ত করে দেখছি।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চলতি বছরের ২০ আগস্ট গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও বিভাগ মোহাম্মদপুর থানাধীন ইউডার সামনে থেকে একটি সিলভার রঙের প্রাইভেটকারসহ মিনাল শরীফ নামে এক মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের সময় তার কাছ থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিদেশি মদ উদ্ধারের পাশাপাশি গাড়ি থেকে একটি অস্ত্রের লাইসেন্স জব্দ করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মিনাল তার বাসায় আরও মাদক রয়েছে জানালে গোয়েন্দা পুলিশ তার ধানমন্ডির ১৫ নম্বর সড়কের ১৯/২ নম্বর বাসার এ/১ নম্বর ফ্ল্যাটে তল্লাশি চালায়। সেখান থেকে মাদক উদ্ধারের পাশাপাশি একটি উজি ব্র্যান্ডের পিস্তল ও ৪৪ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, অস্ত্রটি উদ্ধার করে এর লাইসেন্সের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে আশ্চর্য হয়ে যান তারা। অস্ত্রের ধরন এবং লাইসেন্স পর্যালোচনা করে অস্ত্র এবং লাইসেন্সের মধ্যে গড়মিল পান তারা। লাইসেন্সে পয়েন্ট টুটু বোর উল্লেখ থাকলেও বোর ঠিক রেখে তার কাছে উজি ব্র্যান্ডের অত্যাধুনিক পিস্তল পাওয়া যায়। জিজ্ঞাসাবাদে মিনাল শরীফ অস্ত্রটি বৈধভাবে পুরানা পল্টনের এমএইচ আর্মস কোম্পানি থেকে কিনেছেন বলে জানায়।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, বিষয়টির গভীরতর অনুসন্ধানের জন্য তারা ধানমন্ডি মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়রি (জিডি নং ১০৮৩) করে তদন্তের জন্য আদালত থেকে অনুমতি নেন। পরে লাইসেন্সের সঙ্গে অস্ত্রের ধরনের গড়মিলের বিষয়ে জানতে এমএইচ আর্মস কোম্পানির মালিক মোকারম হোসেনকে একটি চিঠি দেওয়া হয়। ওই চিঠির জবাবে এইচএম আর্মস কোম্পানির মালিক মোকারম হোসেন লিখিত বক্তব্যে জানান, তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে উত্তরা ব্যাংক লিমিটেড রমনা শাখার মাধ্যমে অস্ত্র আমদানি করেন। আমদানিকৃত পণ্য রাইফেল হিসেবে নিয়মিত শুল্ক পরিশোধ করে কাস্টমস হাউজ ঢাকা হতে খালাসের মাধ্যমে রাইফেল হিসেবে বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে গুদামজাত করেছেন। তাদের আমদানি করা একটি অস্ত্রই মিনাল শরীফ নিজের বৈধ লাইসেন্স দেখিয়ে ক্রয় করেছেন।
পুলিশ জানায়, অস্ত্রের লাইসেন্সে পয়েন্ট টুটু বোর উল্লেখ করা ছিল। এটির লাইসেন্স দিয়ে লাইসেন্সধারী একটি পয়েন্ট টুটু বোর রাইফেল ক্রয় করতে পারেন। কিন্তু উজি ব্র্যান্ডের পিস্তলটিও পয়েন্ট টুটু বোর হওয়ায় কৌশলে আমদানিকারকরা সেটি আমদানি ও বিক্রি করছে।
গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, তারা বিষয়টি সম্পর্কে আরও বেশি নিশ্চিত হতে অস্ত্র বিশেষজ্ঞের মতামত নিতে ঢাকা সেনানিবাসের পরিচালক, সদরদফতর লজিস্টিকস এরিয়ায় (ইএমই শাখা) একটি চিঠিসহ অস্ত্রটি পরীক্ষার জন্য পাঠান। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সেনা সদর থেকে অস্ত্রটিকে অত্যাধুনিক উল্লেখ করে এটি মিলিটারি গ্রেডের অস্ত্র হিসেবে শনাক্ত করা হয়।
বিশেষজ্ঞ মতামতে সেনাসদরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, লাইসেন্সে পয়েন্ট টুটু বোর রাইফেল উল্লেখ করা থাকলেও উজি পিস্তল (সেমি অটোমেটিক) ক্রয় করতে পারবে না। উজি পিস্তল ও উজি রাইফেল দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র। অস্ত্র দুটির স্পেয়ার পার্টস, ওজন ও দৈর্ঘ্য ছাড়াও বিভিন্ন পার্থক্য রয়েছে। এছাড়া এটি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক ব্যবহৃত পিস্তলের চেয়েও অত্যাধুনিক। কারণ এর ম্যাগাজিনের ধারণ ক্ষমতা ২০ রাউন্ড। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ব্যবহৃত পিস্তলসমূহের সর্বাধিক ম্যাগাজিন ধারণ ক্ষমতা ১৫ রাউন্ড। বিশেষজ্ঞ মতামতে অস্ত্রের লাইসেন্সে ক্যালিবারের পাশাপাশি অস্ত্রের ধরন সুনির্দিষ্ট থাকা প্রয়োজন এবং অস্ত্রটির ম্যাগাজিনের ধারণক্ষমতা উল্লেখ থাকা প্রয়োজন বলে মতামত দেওয়া হয়।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, বিষয়টি আইন-শৃঙ্খলার জন্য উদ্বেগজনক মনে করে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা অনুসন্ধানে জানতে পারে ছয়টি অস্ত্র আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান গত পাঁচ বছরে ৯১টি উজি পিস্তল আমদানি করেছিল। তারা হলো- এমএইচ আর্মস কোং, আহম্মদ হোসেন আর্মস কোং, মেসার্স তোফাজ্জল হোসেন, কে আহম্মেদ আর্মস অ্যান্ড কোং ও শফিকুল ইসলাম আর্মস অ্যান্ড কোং। এই ছয় প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা ৯১টি উজি পিস্তলের মধ্যে ৪৯টি ইতোমধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে। এছাড়া একই সময়ে মঈন আর্মস কোং নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান ২০টি উজি রাইফেল আমদানি করেছিল। তারা এরমধ্যে ৪টি বিক্রি করেছে। বাকি ১৬টি তাদের মজুদ রয়েছে।
গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের কাছে দেওয়া প্রতিবেদনে আইনে অস্পষ্টতার সুযোগ নিয়ে আমদানি, বিক্রয় ও মজুদকৃত উজি পিস্তলসহ এই ধরনের সকল অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়। একই সঙ্গে অস্ত্রগুলো বাজেয়াপ্ত করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহারের জন্য দেওয়া যেতে পারে বলেও সুপারিশে বলা হয়েছে।
সুপারিশে অস্ত্রের লাইসেন্সে ক্যালিবার উল্লেখ থাকলেও এর সঙ্গে অস্ত্রের ধরন সুস্পষ্ট থাকা, লাইসেন্সে ম্যাগাজিন ক্যাপাসিটি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সেনাবাহিনীর যৌথ অস্ত্র বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে বৈধ অস্ত্র সংক্রান্ত আইন, বিধি, প্রজ্ঞাপন যুযোপযোগী করা, লাইসেন্স ইস্যুকারী কর্তৃপক্ষের অস্ত্র সংক্রান্ত জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা থাকায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে এক্ষেত্রে আরও বেশি গুরুত্ব দিয়ে সম্পৃক্ত করা, লাইসেন্সধারীদের সামাজিক মর্যাদা, পেশা ইত্যাদি বিষয়ে যাচাইয়ে আরও বেশি সচেতন হওয়া ও কাস্টমস থেকে অস্ত্রের চালান খালাসের সময় অস্ত্র বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতিতে পরিদর্শনের বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত বলে পরামর্শ দেওয়া হয়।