ডেস্ক নিউজ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীদের যুক্ত করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেছেন, যথোপযুক্ত সমাধান খুঁজে বের করা এবং তাদের অভিজ্ঞতা থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য নেতৃত্বের দলে মহিলাদের থাকা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘সঙ্কটের সময় নারীরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই, সঙ্কটের কার্যকর সমাধান খুঁজে বের করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীদের যুক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ।’ শেখ হাসিনা উল্লেখ করেছেন, সব ধরনের গতানুগতিকতা ভেঙ্গে এবং অদম্য সাহস এবং নেতৃত্বের দক্ষতা দেখিয়ে নারীরা প্রতিটি ক্ষেত্রে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। খবর বাসসর।
প্রধানমন্ত্রী স্থানীয় সময় মঙ্গলবার বিকেলে জাতিসংঘ সদর দফতরের ট্রাস্টিশিপ কাউন্সিলে সাধারণ পরিষদের সভাপতি কাসাবা কোরোসি আহূত ইউএনজিএ প্ল্যাটফর্ম অব উইমেন লিডার্সের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে ভাষণদানকালে এই মন্তব্য করেন। এবারের সম্মেলনের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘আজকের আন্তসংযুক্ত চ্যালেঞ্জে নারী নেতাদের দ্বারা রূপান্তরমূলক সমাধান।’
শেখ হাসিনা দৃঢ়ভাবে মনে করেন, জটিল বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মতামত বিনিময় এবং শুধুমাত্র ‘আমাদের নিজ নিজ দেশের জন্য নয়, মানবজাতির জন্য’ ইতিবাচক ফলাফল আনার লক্ষ্যে এই নেটওয়ার্ককে (ইউএনজিএ প্ল্যাটফর্ম অব উইমেন লিডারস) ব্যবহার করার এটাই উপযুক্ত সময়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার দেশের দৃষ্টিকোণ থেকে, তারা বিশ্বব্যাপী নারী নেতৃত্বকে উৎসাহিত করার জন্য জাতিসংঘের প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণ অব্যাহত রাখার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন।
এই বিষয়ে তিনি তিন দফা প্রস্তাব করেন। তা হলো লিঙ্গ সমতার বিষয়ক উপদেষ্টা বোর্ডের স্থানীয়করণ, পর্যাপ্ত রাজনৈতিক ও আর্থিক উপায়ে নারী নেতৃত্বাধীন সুশীল সমাজ-সংস্থাকে লালন ও সমর্থন এবং লিঙ্গ সমতার জন্য সাধারণ এজেন্ডাকে শক্তিশালী করতে নেতৃবৃন্দের একটি শীর্ষ সম্মেলন আহ্বান তুলে ধরেন। শেখ হাসিনা তার প্রথম দফা প্রস্তাবে লিঙ্গ সমতা বিষয়ে উপদেষ্টা বোর্ড গঠনের সুপারিশ করেন। ‘এটি এখন স্থানীয়করণ করা দরকার। আমাদের সব স্তরে জেন্ডার চ্যাম্পিয়নদের প্রয়োজন, বিশেষ করে তৃণমূল স্তরে এবং আমরা উদাহরণসহকারে নেতৃত্ব দিতে পারি’ বলেন তিনি।
এ ছাড়াও, নারী-নেতৃত্বাধীন সুশীল সমাজ সংস্থাকে পর্যাপ্ত রাজনৈতিক ও আর্থিক উপায়ে লালন-পালন এবং সমর্থন করা প্রয়োজন, তিনি তার দ্বিতীয় দফায় বলেন, ‘এই ধরনের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।’ সর্বশেষে তিনি লিঙ্গ সমতার জন্য তাদের সাধারণ এজেন্ডাকে শক্তিশালী করতে নেতৃবৃন্দের একটি শীর্ষ সম্মেলন আহ্বান করার লক্ষ্যে সবাইকে আমন্ত্রণ জানান। ‘শুধু আমাদের নয়-সকল নেতাদের লিঙ্গ সমতা এবং নারীর ক্ষমতায়নের অগ্রগতির জন্য দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া উচিত এবং উপস্থাপন করা উচিত।’
বাংলাদেশের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, সরকার নারীদের আইনী সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং তাদের আর্থিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য নতুন উপায় তৈরি করাসহ নারীর ক্ষমতায়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এ লক্ষ্যে তিনি বলেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন অভীষ্টে (এমডিজি)’র তিনটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে। ‘আমরা লিঙ্গ সমতা এবং নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ,’ তিনি যোগ করেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে জাতীয় বাজেটের প্রায় ২৭ শতাংশ নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য বরাদ্দ করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাজনৈতিক পটভূমিতে বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষ থেকে সর্বনিম্নস্তর পর্যন্ত সকল স্তরে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করেছে। ‘আমরা আমাদের নারীদের সকল অর্থনৈতিক কর্মকা-ে এগিয়ে নিয়ে আসছি।’ নারী উদ্যোক্তাকে উৎসাহিত করা তার সরকারের একটি মূলনীতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নারী ও পুরুষ উদ্যোক্তাদের জন্য অর্থে সমান প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে আমরা ব্যবসার জন্য লিঙ্গ-নিরপেক্ষ আইনী কাঠামো গড়ে তোলায় সুনির্দিষ্ট নীতিগত পদক্ষেপ নিয়েছি।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নারী উদ্যোক্তাদের ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জামানতবিহীন ঋণ দিচ্ছে। সরকারপ্রধান উল্লেখ করেন যে পুনঃঅর্থায়ন প্রকল্পের ১৫ শতাংশ তহবিল, ১০ শতাংশ শিল্প প্লট এবং ১০ শতাংশ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তহবিল মহিলাদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। প্রতিটি ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ডেডিকেটেড ডেস্ক রয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্পে ৪০ লাখের বেশি নারী কর্মরত এবং দেশের প্রায় ৩৫ শতাংশ নারীর ব্যাংক এ্যাকাউন্ট রয়েছে। জিডিপি’র প্রবৃদ্ধিতে নারীর অবদান ৩৪ শতাংশ। তিনি বলেন, আমরা ২০২১ সালের মধ্যে প্রতিটি সেক্টরে ৪০ শতাংশ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়েছি।
শিশুদের বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবে বাংলাদেশ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার সরকার বাংলাদেশের শিশুদের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য উপযুক্ত করে বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে আগামী বছর থেকে একটি নতুন জাতীয় পাঠ্যক্রম চালু করতে যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা আমাদের শিশুদের সত্যিকারের বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। আমরা আগামী বছর থেকে একটি নতুন জাতীয় পাঠ্যক্রম চালু করছি। সোমবার (নিউইয়র্ক স্থানীয় সময়) জাতিসংঘ মহাসচিবের ট্রান্সফর্মিং এডুকেশন সামিটে সম্প্রচারিত একটি ভিডিও রেকর্ডিংয়ে জাতীয় বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী একথা বলেন। খবর বাসসর।
তিনি আরও বলেন, নতুন পাঠ্যক্রম আমাদের শিক্ষার্থীদের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করবে। এ প্রয়াস তাদের জলবায়ু সহনশীল হওয়ার বিষয়ে সচেতন করবে এবং দেশকে একটি উন্নত, জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে পরিণত করতে রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তাদের সত্যিকারের এজেন্ট হিসেবে গড়ে তুলবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা গবেষণা ও উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। কারিগরি শিক্ষার জন্য, আমাদের লক্ষ্য হলো আরও ভাল সংযোগ শিল্প স্থাপন করা। আমাদের সন্তানদের এমন দক্ষতা থাকা উচিত যা তারা বিশ্বের যে কোন স্থানে ব্যবহার করতে পারে। যোগ্যতার পারস্পরিক স্বীকৃতির জন্য আমাদের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন। আমরা বুনিয়াদী এবং জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ উন্নত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বহুভাষিক শিক্ষার প্রসারের জন্য দেশে আমাদের কিছু নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক তৈরি করা হয়েছে। আমরা রাখাইন প্রদেশ থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হওয়া এবং আমাদের ভূখ-ে আশ্রয় নেয়া লাখ লাখ শিশুকে মিয়ানমারের পাঠ্যসূচীতে শিক্ষা দিচ্ছি। তিনি বলেন, মানসম্পন্ন এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার জন্য তার সরকারকে অবশ্যই শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ এবং প্রণোদনার জন্য বিনিয়োগ করতে হয়েছে। আমরা আমাদের জিডিপির অনুপাতে শিক্ষার জন্য বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীদের এসডিজি-৪ অর্জনের জন্য তাদের আর্থিক প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে। বিশ্বব্যাপী অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যয় করা সম্পদকে শিক্ষার জন্য একটি সুষ্ঠু অংশীদারিত্বের জন্য প্রদান করা উচিত। আমরা স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ে এসডিজি-৪ সূচকগুলো পর্যবেক্ষণ করা অব্যাহত রাখব। শিক্ষা হচ্ছে জাতির মেরুদণ্ড। আমাদের অবশ্যই জিডিপিতে একটি সমতা এবং অধিকার ভিত্তিক আনুপাতিক ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী ট্রান্সফর্মিং এডুকেশন সামিট আয়োজনের জন্য মহাসচিবকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এই শীর্ষ সম্মেলন কাজের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতের পরিবর্তনের সঙ্গে শিক্ষা সম্পর্কে নতুন চিন্তা-ধারার প্রতিফলন। তিনি বলেন, কোভিড-১৯ মহামারী সারাবিশ্বে শিক্ষা লাভের ক্ষতি করেছে। বাংলাদেশে আমরা ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে ছয় লাখ স্কুল শিক্ষার্থীকে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষায় তালিকাভুক্ত করেছি। আমরা ৫ বছরের বেশি বয়সী শিশুদের টিকা দেয়া শুরু করেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থী উপবৃত্তি এবং বৃত্তি পাচ্ছে। সরকার কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন পরিবারগুলোকে মোবাইল গেটওয়ের মাধ্যমে নগদ প্রণোদনা প্রদান অব্যাহত রাখবে। উপবৃত্তি, দুপুরের খাবার এবং বিনামূল্যে পাঠ্য বই বিতরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আমাদের সফল কর্মসূচীগুলো অব্যাহত রাখা হবে।
মহামারী পরিস্থিতি দূরশিক্ষণ ব্যবস্থা উদ্ভাবনের সুযোগ খুলে দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে তারা একটি মিশ্র শিক্ষা ব্যবস্থা মহাপরিকল্পনা তৈরি করেছেন। আমরা আগামী বছরের মধ্যে প্রায় ৫৯,৭৮০টি মাল্টি-মিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করব। আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডিজিটাল বিভাজন কমানোর দিকে মনোনিবেশ করবো। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীর অনুপাতে সমতা অর্জনে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করেছে। তিনি বলেন, আমরা উচ্চ ও কারিগরি শিক্ষায় ছাত্র-ছাত্রীর অনুপাতে ব্যবধান কমাতে কাজ চালিয়ে যাব। আমাদের মেয়েদের শিক্ষিত করা সবসময়ই আমার প্রধান অগ্রাধিকারের অন্যতম।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৭৭তম অধিবেশনে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে পৌঁছেছেন। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সফরসঙ্গীদের বহন করা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ভিভিআইপি ভাড়া বিমান রাত ১০টা ২৫ মিনিটে (স্থানীয় সময়) নিউইয়র্ক জেএফকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে।
ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মুহাম্মাদ ইমরান এবং জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মুহাম্মাদ আব্দুল মুহিত বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান।