ডেস্ক নিউজ
জীববৈচিত্র্যের বৃহত্তম আধার বিশ^ ঐতিহ্য (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ) এলাকা সুন্দরবন। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন কমতে কমতে এখন দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটারে। যা দেশের সংরক্ষিত বনভূমির ৫১ ভাগ। জলবায়ু পরিবর্তনসহ একশ্রেণীর ক্ষমতাবান অসৎ মানুষের কারণে এখন অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে সুন্দরবনের প্রাণ ও প্রকৃতি। এ অবস্থায় দেশের ফুসফুসখ্যাত সুন্দরবনের প্রাণ ও প্রকৃতি সুরক্ষায় ১৮৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে তিনটি প্রকল্প। চলতি অর্থবছরে চলমান প্রকল্প তিনটি হচ্ছে সুন্দরবনে ২৫ কোটি টাকায় নতুন চারটি ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র নির্মাণ, ১৫৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ব্যয়ে সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্প এবং বাঘসহ বন্যপ্রাণীর পানির চাহিদা মেটাতে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮৪টি পুকুর খনন ও পুনঃখনন প্রকল্প। এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হলে সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি, ইকোট্যুরিজমসহ অবকাঠামোগত সমস্যার বহুলাংশে সমাধান হবে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ।
নতুন চারটি ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র নির্মাণ : সমগ্র সুন্দরবনের ওপর ইকোট্যুরিস্টদের চাপ কমানোসহ ম্যানগ্রোভ বনের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে বনজসম্পদের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে স্থানীয়দের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে নতুন চারটি ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে শরণখোলা রেঞ্জের আলিবান্ধা, চাঁদপাই রেঞ্জের আন্ধারমানিক, খুলনা রেঞ্জের শেখেরটেক ও কালাবগীতে নতুন চারটি ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। সুন্দরবনে প্রতিবেশ পর্যটন বা ইকোট্যুরিজম সুবিধা সম্প্রসারণ ও উন্নয়নে এসব কেন্দ্রে সাড়ে ছয় হাজার বর্গমিটারের একটি আরসিসি ফুট ট্রেইল, একটি ইন্টারপ্রিটেশন ও ইনফরমেশন সেন্টার ও সাতটি স্যুভেনির শপ নির্মাণ, বন কর্মকর্তা-কর্মচারী, ট্যুর অপারেটর, গাইড কো-ম্যানেজমেন্ট কমিটির ৬০০ সদস্যকে প্রশিক্ষণ, স্থানীয়দের পাশাপাশি স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীদের সচেতনতা বৃদ্ধিসহ সাতটি ফাইবার বডি ট্রলার, তিনটি পন্টুন ও গ্যাংওয়ে, তিন কিলোমিটার আরসিসি সড়ক, পাবলিক টয়লেট, সাড়ে ৮ হাজার ঘনমিটার পুকুর খনন, প্রদর্শনী ম্যাপ সেড, আরসিসি বেঞ্চ ও পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণ করা হবে। এছাড়া গাইড ম্যাপ, পর্যটকদের জন্য ১০টি পথ নির্দেশনা ও ঝুলন্ত সেতুসহ অন্য অবকাঠামোও গড়ে তোলা হবে। বর্তমানে সুন্দরবনে ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র হিসেবে করমজল, হাড়বাড়িয়া, কটকা, কচিখালী, দুবলারচর, হিরণপয়েন্ট ও কলাগাছিয়া রয়েছে। নতুন চারটি কেন্দ্র নির্মাণকাজ চলতি অর্থবছরের মধ্যে শেষ হলে সুন্দরবনে ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রের সংখ্যা দাঁড়াবে ১১টিতে।
সুরক্ষা প্রকল্প : সুন্দরবন সুরক্ষা নামের বড় এই প্রকল্পটিতে ব্যয় হচ্ছে ১৫৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। এ প্রকল্পে সুন্দরবনের দুবলা, ককিলমুনি, শ্যালা, কচিখালী, চরখালী, তাম্বুলবুনিয়া, জোংড়া ও ঝাপসি টহল ফাঁড়িসহ ২৮টি ঝুঁকিপূর্ণ বন অফিসে আরসিসি ভবন, পন্টুন ও গ্যাংওয়ে নির্মাণ, বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বন সন্নিহিত এলাকায় পলি পড়ে ভরাট হওয়া বাউন্ডারি নদী-খাল পুনঃখনন করা হবে। সুন্দরবনের পানি, মাটি, বৃক্ষরাজি ও বন্যপ্রাণীসহ প্রাণপ্রকৃতি নিয়ে ইকোলজিক্যাল মনিটরিং সিস্টেম গড়ে তোলা হচ্ছে। পাশাপাশি এসব নিয়ে করা হবে উচ্চতর গবেষণা। খুলনায় সুন্দরবন বিভাগের অফিসে সাড়ে ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে জিওগ্রাফি ইনফরমেশন সিস্টেম বা জিআইএস ল্যাব। এই ল্যাব দিয়ে সুন্দরবনের হালনাগাদ মানচিত্র তৈরি করা হবে। চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি একনেকে পাস হওয়া এ প্রকল্পটির কাজ ২০২২ সালের মধ্যে শেষ হলে সুন্দরবনের প্রাণপ্রকৃতির হালনাগাদ চিত্র উঠে আসবে। জলবায়ু পরিবর্তনসহ একশ্রেণীর প্রভাবশালীর কারণে অস্তিত্বসঙ্কটে থাকা সুন্দরবনের বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির ইরাবতীসহ ছয় প্রজাতির ডলফিন, ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া, ৪৩ প্রজাতির মলাস্কা ও এক প্রজাতির লবস্টার, সুন্দরী, গেওয়া, গরানসহ ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদরাজি, রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও হরিণসহ ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ীসহ ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও ৩১৫ প্রজাতির পাখি সুরক্ষায় দ্রুত বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে বন বিভাগ।
৮৪টি পুকুর খনন ও পুনঃখনন : লবণাক্ত জলাভূমির সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণসহ ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর বসবাস। বন্যপ্রাণীর মিঠাপানির চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বনজীবী ও পর্যটকদের খাবার পানির জন্য চারটি নতুন পুকুর খনন ও ৮০টি পুকুর পুনঃখনন করা হচ্ছে। জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে চার কোটি ৯৮ লাখ টাকা ব্যয়ে এসব পুকুরের মধ্যে ৭০টিতে নির্মাণ করা হচ্ছে পাকা ঘাট। সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণসহ বন্যপ্রাণীর আধিক্য রয়েছে এমন এলাকাগুলোতে এসব পুকুর খনন ও পুনঃখননের কাজ আগামী জুন মাসের মধ্যে শেষ হবে। পুরাতন পুকুরগুলো ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ভরাট হয়ে যাওয়ায় বছরের পর বছর ধরে বন্যপ্রাণীগুলো সুপেয় পানিসঙ্কটের মধ্যে ছিল। খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো এ বিষয়ে জানান, সুন্দরবনে এই প্রকল্প তিনটির কাজ শেষ হলে ইকোট্যুরিজমের উন্নয়ন ও দীর্ঘদিন ধরে বাঘ-হরিণসহ বন্যপ্রাণীর সুপেয় পানি সমস্যার বহুলাংশে সমাধান হবে। পাশাপাশি ম্যানগ্রোভ বনের প্রাণপ্রকৃতি নিয়ে ইকোলজিক্যাল মনিটরিং সিস্টেমের মাধ্যমে গবেষণা করা সহজতর হবে।