বরিশাল ও ভোলার মধ্যে সংযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে প্রায় ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ চার লেনের একটি সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এটি হবে দেশের সবচেয়ে বড় এবং দীর্ঘ সেতু। এটি পদ্মা সেতু সংযোগের মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলকে সরাসরি রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সংযুক্ত করবে। এর ফলে রাজধানীর সঙ্গে ঢাকা, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের ২২টি জেলা সরাসরি সড়ক সংযোগের আওতায় আসবে।
ভোলা সেতু নির্মাণে দেশের অর্থনীতিতে আসবে নতুন গতি। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি বাড়বে অন্তত আরও ১ দশমিক ২ শতাংশ। বাড়বে এ অঞ্চলের মাথাপিছু আয়, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ নাগরিক সুবিধা। পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক অবদানেও এটি নতুন মাত্রা যুক্ত করবে।
অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, চীনের নেতৃত্বাধীন এশীয় পরিকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক (এআইআইবি) সেতুটি নির্মাণে ঋণ সহায়তা দিতে পারে। এ সপ্তাহের মধ্যে এআইআইবির সঙ্গে এ বিষয়ে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। সেতুটি নির্মাণে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা। সেতুটির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ করেছে চারটি বিদেশি ফার্মের যৌথ দল। তারা বলেছে, এ সেতু নির্মাণে প্রযুক্তিগত কোনো সমস্যা নেই। এই সেতু যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কার্যক্রমে বড় ধরনের অবদান রাখবে। দ্রুতই সেতু নির্মাণকাজ শুরুর সুপারিশ করেছে তারা।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সেতুটি নির্মাণে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের পাঠানো ডিপিপি প্রাথমিক যাচাইয়ের পর মন্ত্রণালয়ের এই সিদ্ধান্ত জানানো হয়। তবে বিদেশি ঋণ ছাড়া এত বড় ব্যয়ের সেতু নির্মাণ সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। ইআরডিকে অনুরোধ করা হয়েছে বিদেশি উৎস থেকে অর্থের সন্ধান করতে। ২০১৮ সালের নভেম্বরে ইআরডি সচিবকে এ বিষয়ে চিঠি দিয়েছে কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সমকালকে বলেন, সরকারের বিভিন্ন মেয়াদি উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে অর্থনৈতিক কার্যক্রমে আরও গতি প্রয়োজন। যোগাযোগ অবকাঠামোতে এ জন্য সরকার বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। ফলে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে যে সেতু প্রয়োজন, সেখানে সেটিই করতে চায় সরকার। ভোলা সেতু নির্মাণে আগে থেকেই সরকারের সিদ্ধান্ত আছে। এই সেতু নির্মাণ হলে দক্ষিণাঞ্চলসহ সারাদেশের যোগাযোগ অবকাঠামোতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।
প্রকল্পের উন্নয়ন প্রস্তাবে (ডিপিপি) আশা করা হয়েছিল, ২০১৯ সালের জুলাই মাসে এটির নির্মাণকাজ শুরু হবে। শেষ হবে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে। তবে বিদেশি সহায়তার বিষয়ে আশাব্যঞ্জক সাড়া না পাওয়ায় এত দিনেও প্রকল্পের কাজ শুরুর বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে ইআরডির একজন কর্মকর্তা জানান, পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে বিশ্বব্যাংকের কাছে ভোলা সেতু নির্মাণে ঋণ চাওয়া হয়নি। বিশ্বব্যাংকের বাইরে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এডিবি, জাইকা, আইডিবি, চীন, আইডিএসহ সব উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাছে ঋণ চেয়েছেন তারা। প্রায় দুই বছর পর এআইআইবি থেকে ভালো সাড়া পাওয়া গেছে। তারা বলেছে, অন্য সংস্থাগুলো যত প্রকল্পে অর্থায়নে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, সেগুলোতেও অর্থায়ন করতে চায় তারা। এ বিষয়ে একটি তালিকা চাওয়া হয়েছে এআইআইবির পক্ষ থেকে। ভোলা সেতুসহ এসব প্রকল্প নিয়ে এ সপ্তাহেই এআইআইবি এবং ইআরডির মধ্যে বৈঠক হওয়ার কথা।
ভোলা সেতুর ডিপিপি থেকে জানা যায়, ভোলা অংশে ভেদুরিয়া ফেরিঘাট থেকে বরিশাল অংশের লাহারঘাট ফেরিঘাট পর্যন্ত দীর্ঘ হবে এ সেতু। ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুটির শ্রীপুর চরের প্রায় তিন কিলোমিটার পর্যন্ত যাবে উঁচু সড়কের আকারে। মূল সেতু হবে ৮ দশমিক ৬৪ কিলোমিটার দীর্ঘ। সংযোগ সেতু হবে ১ দশমিক ০৬৪ কিলোমিটার, সংযোগ সড়ক দুই কিলোমিটার। নদীর তীররক্ষা কার্যক্রম চলবে চার কিলোমিটারজুড়ে। জমি অধিগ্রহণ করতে হবে ৪৮৬ হেক্টর। ২০২৪ সালে সেতু নির্মাণ শেষ হলেই দৈনিক ছয় হাজার ৯৯০টি মোটরযান চলাচল করতে পারবে এটি দিয়ে। তবে পর্যায়ক্রমে ৫৭ হাজার মোটরযান চলাচলের আশা করছে কর্তৃপক্ষ।
প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনের নির্বাহী সারসংক্ষেপে বলা হয়, প্রকল্প এলাকার লাহারহাট ও ভেদুরিয়ায় ৩০ কিলোমিটার এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে কয়েকটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- প্রকল্প এলাকার যোগাযোগ, বিদ্যমান সড়ক অবকাঠামো, অবকাঠামো ব্যয়, নদীর পানিপ্রবাহের গড় গতি। বিদেশে একই দৈর্ঘ্যের সেতু নির্মাণ ব্যয় এবং স্থানীয় পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখা হয়েছে ব্যয় প্রাক্কলনে। অবশ্য প্রথম প্রাক্কলনে এর ব্যয় ৯ হাজার ৯২২ কোটি টাকা ধরা হয়। পরে তা বাড়িয়ে ধরা হয় ১২ হাজার ৯১৬ কোটি টাকা।
ডিপিপিতে বলা হয়, তেঁতুলিয়া ও কালাবাদর নদীর ওপর বরিশাল ও ভোলা সড়কে ভোলা ব্রিজ নামে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। এটি নির্মাণ করবে মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগ। ভোলা সেতু নির্মাণে প্রাথমিক ব্যয়ের মধ্যে সরকার দেবে দুই হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা। বাকি ১০ হাজার ২৮১ কোটি টাকা বিদেশি সহায়তা হিসেবে পাওয়ার আশা করছে সরকার। ২০১৮ সালের অক্টোবরে ডিপিপি তৈরি হয়। তখন টাকার সঙ্গে ডলার বিনিময় হার ৮৩ টাকা ৮০ পয়সা হিসেবে ব্যয় ধরা হয়। এতে মোট ব্যয়ের অঙ্ক দাঁড়ায় ১৫ কোটি ডলার।
ভোলা সেতু নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ-উদ্দীপনা রয়েছে। বিশিষ্ট শিল্পপতি, ঢাকায় ভোলা সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং তৈরি পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএর পরিচালক শহিদুল হক মুকুল জানান, সেতুটি নির্মাণ হলে চট্টগ্রাম বন্দর এবং পায়রা বন্দরের সঙ্গে সহজেই পরিবহন সংযোগ সুবিধা পাওয়া যাবে। সেতুর সঙ্গে গ্যাস সংযোগ থাকারও কথা রয়েছে। ফলে স্থানীয় মজুদ গ্যাসশিল্পের প্রয়োজন অনুযায়ী অন্যান্য অঞ্চলেও সরবরাহ করা যাবে। এ সুবিধায় ভোলাসহ দক্ষিণাঞ্চলে শিল্পবিপ্লব ঘটে যাবে, বিশেষ করে দ্বীপজেলা হিসেবে সড়ক পরিবহন থেকে বিচ্ছিন্ন ভোলার আর্থসামাজিক উন্নয়নে বড় রকমের অবদান রাখবে এই সেতু। ভোলার ২২ লাখ মানুষ সেতুটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। তিনি জানান, ভোলার ভেদুরিয়ায় ৬০০ বিলিয়ন কিউবিক গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। আগে থেকে মজুদ মিলে ভোলায় গ্যাসের মোট মজুদ এখন দেড় ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট।
পদ্মা সেতু বনাম নির্মিতব্য ভোলা সেতু :আলোচিত পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। ভোলা সেতুর দৈর্ঘ্য ১০ কিলোমিটার। তিন দফা বেড়ে পদ্মা সেতুর ব্যয় এখন পর্যন্ত ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। অন্যদিকে ভোলা সেতুর ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ হাজার ৯১৬ কোটি টাকা। অবশ্য, পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়ও প্রথম দফায় অনেক কমে মাত্র ১০ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়। দৈর্ঘ্যে বড় হলেও পদ্মা সেতুর তুলনায় এটির নির্মাণ ব্যয় কম ধরার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে সেতু বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী কাজী মোহাম্মদ ফেরদৌস জানান, পদ্মা সেতুর সঙ্গে রেলসেতু ছিল। তাই ব্যয় অনেক বেশি হয়েছে। ভোলা সেতুতে রেলসেতু নেই। ফলে ব্যয় অনেক কম লাগছে। এ ছাড়া নদীর খরস্রোত বিবেচনায় পদ্মার মতো নির্মাণগত কারিগরি কোনো জটিলতা নেই এই সেতুটিতে। তাই নির্মাণ ব্যয় পদ্মা সেতুর তুলনায় খুব সংগত কারণেই কম হওয়ার কথা।