ডেস্ক নিউজ
করোনার ধাক্কা সামলিয়ে ধীরে ধীর স্বাভাবিক গতিতে ফিরছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ছয় মেগা প্রকল্পের নির্মাণ কাজ। ইতোমধ্যেই স্থগিত হওয়া কাজ শুরু হয়েছে মেট্রোরেল প্রকল্পে। বাকি পাঁচটির কাজ স্থগিত না হলেও বেশ ঝিমিয়ে পড়েছিল।
সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকারের ফাস্টট্র্যাক মনিটরিং টাস্কফোর্স। এরই অংশ হিসেবে প্রকল্প কাজে স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। ফলে বিভিন্ন প্রকল্পে দেশি কর্মীদের পাশাপাশি বিদেশিরাও যোগ দিচ্ছেন। তবে পুরোদমে কাজ শুরু হতে আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে বলে জানায় সংশ্লিষ্টরা।
মেট্রোরেল ছাড়া করোনার প্রভাবে প্রায় স্থবির হওয়া বাকি পাঁচ প্রকল্প হচ্ছে- পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, দোহাজারী-রামু হয়ে কক্সবাজার ও রামু হতে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ এবং মাতারবাড়ি ১২০০ মেগাওয়াট আলট্রা সুপার বিদ্যুৎ কেন্দ্র। পদ্মা সেতু ছাড়া বাকি প্রকল্পগুলোতে রয়েছে বৈদেশিক অর্থায়ন।
গত অর্থবছরের সংশোধিত এডিপি (আরএডিপি) বরাদ্দের অর্ধেক খরচ হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত এ অর্থবছরের মে মাস পর্যন্ত উল্লিখিত ছয়টি প্রকল্পের অনুকূলে ব্যয় হয়েছে ১৭ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা। বরাদ্দ ছিল ৩০ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। পুরো বরাদ্দ ব্যয় করতে হলে এক মাসে (জুন-২০২০) প্রায় ১৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় করা প্রয়োজন। তবে নির্ধারিত মেয়াদে বৃহৎ এই প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন শঙ্কার মুখে পড়েছে। ইতোমধ্যেই মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তুতি শুরু হয়েছে পদ্মা সেতুর।
‘ফাস্টট্র্যাক অগ্রগতি’ (মে মাস পর্যন্ত) প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এটি তৈরি করেছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। জুন মাসে প্রতিবেদনটি পাঠানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে।
তবে কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে মেগা প্রকল্পগুলো নিয়ে নতুন করে ভাবার তাগিদ দিয়েছেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন।
তিনি বুধবার যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় ফাস্টট্র্যাকভুক্ত মেগা প্রকল্পগুলো নিয়েও নতুন করে ভাবা প্রয়োজন। অর্থাৎ যেসব প্রকল্প করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে সক্ষমতা বাড়াবে কেবল সেসব প্রকল্পকেই গুরুত্ব দিতে হবে। যেমন বিদ্যুতের প্রকল্পের চেয়ে এখন জরুরি হচ্ছে পদ্মা সেতু মেট্রোরেলের মতো প্রকল্প শেষ করা। তাই প্রথমে যে কাজটি করতে হবে সেটি হচ্ছে গুরুত্ব নির্ধারণ করা। এরপর দ্রুত বাস্তবায়নে কর্মকৌশল তৈরি করা।
পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ : ‘ফাস্টট্র্যাক অগ্রগতি’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় হচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে। গত অর্থবছরের আরএডিপিতে বরাদ্দ ছিল চার হাজার ১৫ কোটি টাকা। মে মাস পর্যন্ত খরচ হয়েছে দুই হাজার ৮৭০ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। তবে প্রকল্পের শুরু থেকে ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ২৯৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
প্রকল্পটির সার্বিক অগ্রগতি ৭৯ দশমিক ৫০ শতাংশ। মূল সেতু নির্মাণ কাজ হয়েছে ৮৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। নদী শাসন কাজ ৭২ শতাংশ। তবে গত মাসে প্রকাশিত বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) পরীক্ষণ প্রতিবেদনে প্রকল্পটি নির্দিষ্ট মেয়াদে শেষ নাও হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
পদ্মা সেতু প্রকল্প পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো. শফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, করোনার মধ্যেও প্রকল্পের কাজ বন্ধ ছিল না। তবে যে গতিতে এগিয়ে যাওয়া কথা সেটি হয়নি। এখন বিদেশিরা ফিরতে শুরু করেছে। প্রকল্পটির গতি বাড়ছে। তারপরও আগামী বছর জুনের মধ্যে এটি শেষ করা যাবে না। এজন্য মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তুতি শুরু করা হয়েছে। তবে কতদিন বাড়বে সেটি এখনও বলা যাচ্ছে না।
মেট্রোরেল : এই প্রকল্পের কাজ করোনার শুরুতেই স্থগিত হয়ে যায়। বুধবাার প্রকল্প এলাকা সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ডিপোর অভ্যন্তরে সীমিত পরিসরে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ডিপো এলাকায় অপারেশন কন্ট্রোল সেন্টার, ডিপো কন্ট্রোল সেন্টার, ওয়ার্কশন তৈরি, স্টাবেলিং ইয়ার্ড তৈরি (যেখানে ট্রেন থাকবে) চলছে। এছাড়া ভায়াডাক্ট ইরেকশন এবং রেললাইন বসানোর কাজ সীমিতভাবে শুরু হয়েছে। তবে করোনার কারণে মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত পুরোপুরি কাজ শুরু হতে এখনও এক সপ্তাহের মতো লাগবে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, প্রকল্পে কর্মরত থাইল্যান্ডের কর্মীরা ফিরে এসেছেন। চীনের কর্মীরা বাংলাদেশেই ছিলেন, তারাও কাজ শুরু করেছেন। জাপানের কর্মীরা কিছু ফিরেছেন। অনেকেই ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কার্যক্রম চলছে। এরই মধ্যে গাবতলী ও উত্তরায় দুটি আইসোলেশন সেন্টার ও চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। ২০১২ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে। আরএডিপিতে বরাদ্দ ছিল চার হাজার ৩২৬ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। মে মাস পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে দুই হাজার ৩২৫ কোটি ৩১ লাখ টাকা। শুরু থেকে ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় নয় হাজার ৯২৯ কোটি ৯২ লাখ টাকা।
প্রকল্পটির সার্বিক অগ্রগতি ৪৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ডিপো এলাকার ভূমি উন্নয়ন শতভাগ, পূর্ত কাজ ৬৮ শতাংশ, উত্তরা নর্থ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ৯টি স্টেশনের নির্মাণ কাজ ৭১ দশমিক ০৯ শতাংশ, আগারগাঁও থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত সাতটি স্টেশনের কাজ ৪৩ দশমিক ২৩ শতাংশ। কারওয়ান বাজার থেকে মতিঝিল পর্যন্ত সাতটি স্টেশনের কাজ ৪৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল সিস্টেম ৩৮ দশমিক ৫০ শতাংশ, রেলকোচ ও ডিপো ইকুইপমেন্ট ২৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ শেষ হয়েছে। মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত বর্ধিত অংশের জন্য সোশ্যাল সার্ভে চলছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ : এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে এক লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য। গত অর্থবছরের আরএডিপিতে বরাদ্দ ছিল ১৪ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে মে মাস পর্যন্ত খরচ হয়েছে সাত হাজার ৮৭৩ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এটির শুরু থেকে ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় হয়েছে ২৮ হাজার ৩২৫ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।
মে মাস পর্যন্ত আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ০৪ শতাংশ। ১২টি ওয়ার্কিং ডকুমেন্টেশন প্যাকেজ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ। প্রতিটির জন্য মাইলস্টোন অ্যাচিভমেন্ট সার্টিফিকেট স্বাক্ষরিত হয়েছে। ইতোমধ্যেই তিনটি প্যাকেজের প্রি-ইন্সপেকশন শেষ হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক ড. শৌকত আকবর যুগান্তরকে জানান, করোনার মধ্যেও এ প্রল্পটির কাজ স্থবির হয়নি। নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করায় এখন গতি আরও বড়েছে। গত মার্চ-এপ্রিল ও মে মাসে রাশিয়া থেকে নতুন করে প্রায় ৫৭০ জন কর্মী এসেছেন। জুলাই-আগস্ট মাসে আরও ৭০০ কর্মী যোগ দেবেন। সাব কন্ট্রাকটরদের মধ্যে জার্মান থেকে ১১ জন এসেছে। ভারত থেকে ৮১ জন আসার অনুমতি দেয়া হয়েছে। করোনা শুরুর আগে সাড়ে ছয় থেকে আট হাজার কর্মী প্রতিদিন কাজ করতেন। কিন্তু এখন প্রতিদিন কাজ করছেন সাড়ে আট থেকে সাড়ে ১০ হাজার কর্মী।
তিনি জানান, বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে স্বাস্থ্যবিধিতে। প্রকল্পে ঢোকার সময় শরীরে তাপমাত্রা মাপা হয়। তারপর কাজ চলাকালীন আরও দু’বার তাপমাত্রা মাপা হয়। বিদেশি যারা আসছেন তাদের করোনা নেগেটিভ সনদ এবং ১৪ দিন কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। দেশে যারা ছুটিতে গ্রামের বাড়ি বা প্রকল্পের বাইরে যাবেন তাদের সাত দিন বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। তারপর টেস্ট করে কাজে যোগ দেবেন। কাজ চলাকালীন যদি কারও করোনা পজিটিভ হয়, তাহলে ওই অংশকে লকডাউন করে দেয়া হচ্ছে। যারা ওখানে কাজ করছিল সবাইকে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন রাখা হয়। কাজের সিফটের ক্ষেত্রে নতুন করে পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে।
পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ : এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে। আরএডিপিতে বরাদ্দ ছিল তিন হাজার ২৯৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা। মে মাস পর্যন্ত খরচ হয়েছে ২৯৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। শুরু থেকে ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ২৫৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা। প্রকল্পটির ২৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ ভৌত এবং ৩০ দশমিক ৫২ শতাংশ আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী গোলাম ফখরুদ্দিন এ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন,করোনার মধ্যেও প্রকল্পের কাজ বন্ধ ছিল না। তবে গতি কমে গিয়েছিল। এখন আবারও গতি ফিরে আসছে। বিদেশি কর্মীরা ফিরতে শুরু করেছে। প্রথম দিকে দেশীয় শ্রমিকরা ভয়ে আসতে চাইত না। এজন্য আমরা টাকার অঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছি। যাতে তারাও কাজে যোগ দিতে উৎসাহিত হয়। আশা করা যাচ্ছে শিগগিরই গতি বাড়বে।
দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ও রামু-মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ : এটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। ২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে। আরএডিপিতে বরাদ্দ ছিল এক হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। মে মাস পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৯০৯ কোটি টাকা। শুরু থেকেই ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় চার হাজার ৮০৬ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৩৯ শতাংশ আর আর্থিক অগ্রগতি ২৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এ প্রকল্পেও গতি বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
মাতারবাড়ি ১২০০ মেগাওয়াট আলট্রা সুপার বিদ্যুৎ কেন্দ্র : প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা। আরএডিপিতে বরাদ্দ ছিল তিন হাজার ২২৫ কোটি টাকা। মে মাস পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে তিন হাজার ২০১ কোটি টাকা। শুরু থেকে ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা। প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি ২৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং আর্থিক ৩৩ দশমিক ৩২ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। এ প্রকল্পের গতি বাড়াতে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ।