কলেজ শেষে বিকালের ট্রেনে একটা বড় অংশের বন্ধুরা চলে গেলে কেমন যেন শুন্যতা চেপে বসতো। সারাদিনের ব্যস্ততা, ক্লাস, আড্ডা আর রাজনীতির ডামাডোল থেকে খানিকটা মুক্তি। ক্লান্তি এসে ভর করতে সাহস পেতো না। বিকালে রেল লাইন ধরে মিতা সিনেমা পার হয়ে লাইনের পাশে বসে দ্বিতীয় দফার আড্ডা। সন্ধা অবধি টানা। বলছি ৯০ সালের আগের সময়ের কথা। পীরগাছা কলেজে অধ্যায়নের সময়কালে। কী নিদারুন সোনাঝড়া সেই সব দিন। তখন আমি পুরোপুরি ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত। গরম সময়। দেশে স্বৈরাচার বিরোধী মুভমেন্ট। আর রাজনীতি বললেই সামনে চলে আসে আমাদের প্রিয় ক্যাম্পাস। আমাদের পীরগাছা কলেজ সে সময় বেশ নামকরা। আশেপাশের নানা জায়গা থেকে ছাত্র/ছাত্রীরা এসে মূখর করে তুলেছিল কলেজ ক্যাম্পাস আর রাজনীতি। সেই সাথে কলেজ হোস্টেল আর মেস। আড্ডার সাথে রাজনীতি আর রাতে ডিম খিচুড়ি। স্বৈরাচার বিরোধী উত্তাল আন্দোলন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। মিটিং, মিছিল, চিকামারা, পোস্টার সাটানো আর অবরোধ। সাথে আমাদের তারণ্যের ক্ষয়। কোন কোন দিন সন্ধায় মশাল মিছিল। কী টান টান উত্তেজনা। অন্যদিকে লিটল ম্যগাজিনের প্রস্তুতি। শিল্পকলায় গানের মহড়া, কখনো কখনো নাটকের প্রস্তুতি। সারদিন জুড়েই অন্তহীন কাজ আর পরিকল্পনা।
সরকার দলীয়দের হোন্ডা মটরবাইকের আওয়াজ। হুমকী- ধামকী। মহড়া। ভয়ভীতি। আর আমাদের উত্তাল আন্দোলন। কে কাকে করে ভয়। চলে সমানে সমান। সন্ধায় প্রকাশদার কাপড়ের দোকানে মিজান চাচা বসতেন। সেখানে খানিকটা জমত আড্ডা রথি মহারথিদের। আমরা এড়িয়ে চলতাম। সরকার দল বলে কথা। অন্যদিকে জাহাঙ্গির ভাইয়ের দোকানে আমরা মাঝেমাঝে ভিড় করতাম। তারপর হয়ত কপালে জুটে যেত গরম সিংগারা আর চা। নিদেনপক্ষে বেকারীর বিস্কুট আর চানাচুর। স্টেশন থেকে পশ্চিমদিকের রাস্তা ধরে সোজা সারি সারি দোকানপাঠ পিছনে ফেলে এগিয়ে গেলে শেষ মাথায় লাকী সিনেমা হল। তারপর সোজা সড়ক রংপুরমূখি। হলের পাশে রাস্তার ধারে রুবেলদের বাসা। উল্টোদিকে নাছুমামুদ স্কুলের পাশে থাকে রায়হান। পুকুরপাড়ের উল্টোদিকে ঢাকাইয়া বন্ধু রতনদের আস্তানা। আমাদের অবাধ যাওয়া আর আসা। আজ লিখতে বসে একসাথে কত কথাই না স্মৃতি পটে বেসে উঠছে। কোনটা ফেলে কোনটা লিখি।
ভাবছি এবং উপলব্দি করছি আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে ফিরে যাওয়ার যেমন মধুরতা আছে তেমনি আচমকা কোথাও একটা চিনচিনে ব্যথার অনূভব। মানুষ আসলে আগায় না, প্রতিদিন পিছনেই ফিরে যায়, পিছনেই পড়ে থাকে। স্মৃতিপটে ভাঁসে কত চেনামুখ, হাসি, ঠাট্টা, জমাটি আড্ডা, লড়াই সংগ্রাম, বিপ্লবীপনা। স্টেশনের দিকে হাইস্কুলের শেষমাথায় ধীরেনদার রূপশ্রী স্টুডিও। বেলা অবেলার আড্ডা। সময় পার করা। এইসাথে চেনা পথ আর রিকসার টুং টাং যাওয়া আর আসা। কখনো কখনো ধুলি উড়িয়ে শো শো শব্দে বেড়িয়ে যাওয়া মটর সাইকেল কিংবা উপজেলা চেয়ারম্যানের একমাত্র জিপগাড়ি। এই দেখতে দেখতে কাটে আমাদের দিন আর বয়ে যায় তরুণবেলা। লাল্টুদা অথবা নির্মলদায়ের দোকানের গরম সিংগারার সাথে চা অথবা গরম পুড়ি আর জিলাপি। নিদেনপক্ষে পীরগাছার নামকরা বেকারির স্পেশাল পাউরুটি। দূপুরের খাবার এভাবেই পার হয়ে যায়। বিকাল নামে। স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় মধ্যরাত অবধি মানুষের আনাগোনা। ট্রেন ফেরত যাত্রীর চলাচল। হকারের চিৎকার, হাকডাক- চাই চানাচুর পাউরুটি। অথবা রেল পুলিশের আচমকা টর্চের আলো আর বাঁশির তীব্র হুইসেল। ট্রেন চলে গেলে খানিক বিরতি। আবার সুনশান নীরবতা ভেদ করে বেজে ওঠে ট্রেন আসার আগমনি ঘন্টি। ট্রেন আসে চলে যায়, ক্ষণিক দাড়ায়। এরকম পরিবেশে কতদিন রেল লাইনের পাশে দাড়িয়ে মনে হতো আচমকা মাঝরাতের ট্রেনে চেপে দূর-বহুদূরে কোথাও চলে যাই। অচেনা শহর আর অজানা দেশে, সবকিছু পিছনে ফেলে। হয়নি যাওয়া আর মেটেনি সে আশা। বড়দূর গাইবান্ধা, বোনার পাড়া অথবা ফুলছড়ির হাট। বন্ধু টুকুর বাড়ি।
এ শহরের বিনোদন বলতে একমাত্র ঠাঁয় দাড়িয়ে থাকা দুটি সিনেমা হল। আধা ইট আর টিন দিয়ে ঘেরা। সময়ে অসময়ে বিনা টিকেটে ঢুকে পড়ে সময় পার করি । কখনো একা কখনো দলবেধে। মাঝে মাঝে দর্শনীর বিনময়ে ভিসিআর এ পূরানো দিনের সিনেমা। উত্তম সুচিত্রা। পথে হল দেরী, হারনো সুর ইত্যাদি। মধ্যেরাতে চলে নিষিদ্ধ সিনেমা ভিসিআর এ। আমাদের প্রবেশ নিষেধ। কঠিন বাধা অতিক্রম করে বেড়ার ফুঁটো দিয়ে এরকম সিনেমার দু একটি দৃশ্যের বর্ননা আমরা শুনেছি। এরকমভাবে নিশিসিনেমা দেখার অপরাধে বড়ভাইদের তাড়া খেয়ে পালাতে গিয়ে তিনদিন বিছানায় পড়ে ছিল আমাদের এক বন্ধু। সে গল্প অন্যদিন। সে সময় আজকের মত ঘরে ঘরে টেলিভিশন ছিল না। কিছু বাড়িতে সবে টিভির আগমন ঘটেছে। লম্বা বাঁশে আটকানো এন্টিনা জানান দিত টেলিভিশনের উপস্থিতি। এতে আবার কেউ কেউ বাটি বসিয়ে ভারতীয় চ্যানেল দেখার প্রয়াস করতো। হিন্দি গান আর মুভি দেখার চল সবে শুরু হয়েছে। এর পাশাপাশি বিশেষ দিবসে আয়োজন করা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। উপচে পড়া মানুষের ভিড়। দলমত মিলিয়ে। এই নিয়ে আমাদের জীবন। অজপাড়াগায়ের ছোট্ট আমাদের এই থানা শহর। অন্য শহরের সাথে যোগাযোগ এর মাধ্যম বলতে একমাত্র ট্রেন। হেরিং বোমের ইটবিছানো রাস্তা দিয়ে জেলা শহর রংপুরের সাথে একমাত্র সংযোগ। দু একটি বাস এবরো থেবড়ো রাস্তা মারিয়ে সবে চলাচর শুরু করেছে। ট্রেনের কারণে গাইবন্ধার সাথেই এলাকার মানুষজনের বেশি যোগাযোগ। বলছিলাম আমার শহর পীরগাছার ফেলে আসা দিনের কিছু স্মৃতি।
যাক ফেলে আসা গল্পে ফেরা যাক। আজ আর দিন তারিখ মনে নেই বা করতেও পারছি না। থাকার কথাও নয়। তবে সেটুকু আজও স্মৃতি থেকে হারায়নি। যে সময়ের কথা বলছি, সেসময় শীত আসন্ন। এ এলাকায় যেমন আগাম শীত হানা দেয় তেমনি এর তীব্রতা। আর তাই সন্ধা নামার আগেই শরীরে জ্যাকেট কিংবা চাদর মুড়িয়ে সকলে চলে আসে বাজারে। ছোট ছোট আড্ডা। ধূয়া উঠা চায়ে চুমুক আর রাজনীতির তপ্ত আলোচনা জমে উঠে মোড়ে, চায়ের দোকান আর রেল স্টেশনের এদিক সেদিক।
রাত ৮টা নাগাত কী মনে করে কলেজ হোস্টেল এর দিকে যাবো ভাবছি। প্রথমে ভেবেছিলাম রুবেলকে সাথে নিয়ে যাই। পরে মত পাল্টে একাই রওনা দেয়া। লাকী সিনেমা হলের সামনে কিছু লোকের অযাচিত ঘোরাঘুরি। সান্ধকালিন শো চলছে, নাইট শোয়ের জন্য অপেক্ষা। দু চারটে কুকুর গা এলিয়ে শুয়ে আছে এদিক সেদিক। ম্যানেজার আশেপাশে ঢু মারছেন। পাশের দোকানীরা অপেক্ষমান তার ক্রেতার জন্য। পাড়াগায়ের সিনেমা হলের যেমন চিত্র হয়, এটিও তেমনি। বিনে পয়সায় নায়ক নায়িকাদের ডায়লগ হজম করতে হয় পরশী আর পথচারীদের। শুধু ছবি দেখা যায় না। আমাদের বন্ধু রুবেলের তো এরকম শতখানেক সিনেমার ডায়লগ ছিলো একেবারে মুখস্ত। সময়ে অসময়ে সে এসব ঝাড়তো। সিনেমা হল পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে আসি। আচমকা পিছন থেকে কে যেন মাফলার টেনে ধরে। রতন। আমাদের ঢাকাইয়া বন্ধু। হিড়হিড় করে টেনে এলএসডি গোডউনের পাশের চায়ের দোকানে। বলে কি মিয়া সিনেমা দেকবার জন্য আইছোনি। না সূচক জবাব দিয়ে চায়ে চুমুক। রতন আমাদের অরাজনৈতিক বন্ধু। সহজ সিধে, বন্ধু বৎসল। বাপের বড় ব্যবসার কারণে পকেট শুন্য থাকেনা কখনোই। চায়ে চুমুক দিয়ে সেই রতনই বলে ওঠে, মিয়া তোমরা বেশি বাড় বাড়ছো। জাতীয় পার্িট কিন্ত তোমাদের উপর ভীষন ক্ষেপা। সাবধানে থাইকো। বলা যায় না, কখন কী হয়। উৎকন্ঠা আর আবেগ মেশানো তার এই আগাম সতর্ক বাণী শুনে চমকে উঠি। রাজনীতি করা নিয়ে রতনের অনীহাটা আগাগোড়া জানি। কিন্তু এর পাশাপাশি এও মানি, নানাকারণে সে এলাকার অনেক খবরাখবর রাখে। সময়টা ভাল না যাচ্ছে না বুঝি। সামনে আসছে কলেজ সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনকে ঘিরে আমাদের নিজেদের মধ্যেও দূরত্ব বাড়ছে । প্যানেল চূড়ান্ত করা যায়নি। আর এর পাশাপাশি শিবির আর ছাত্র সমাজের হাকডাক। সময়টা কঠিন। তারূণ্যের ধর্ম, সাহস বাড়ে কিন্তু কমে না। বাস করি জলে কুমির তো থাকবেই।
রতনকে বিদায় দিয়ে এলএসডি গোডাউনের পাশ ঘেঁষে সরু সড়ক দিয়ে টিপটিপ করে কলেজের দিকে আগাই। যাবো কলেজ হোস্টেল এ। অন্ধকারে ঘিরে আছে কলেজ মাঠ, একাডেমিক বিল্ডিং। কেমন যেন অস্থির করা নীরবতা। ফাঁকা এলাকা হবার কারণে ঠান্ডার মাত্রাটা একটু বেশি। প্রশাসনিক ভবনে টিমটিম করে জ্বলছে বাতি। পাশেই ব্যাচেলার টিচার রুম। থাকেন রাব্বুল স্যার। বয়সে তরূণ। সেই সুবাধে আমাদের সাথে খাতির একটু বেশিই। প্রিন্সিপাল স্যারের দূর সম্পর্ক এর আত্নিয়তার কারণে একটা ডেম কেয়ার ভাব নিয়ে চলেন। সদা পরিপাটি অবিবাহিত যুবক স্যার আমাদের। রুবেলের সাথে নানা বিসয়ে স্যারের খুটখাট লেগেই থাকতো। আর স্যার আমাদের ডেকে দিত বিচার।
যাহোক আমি সামনে আগাই একা। সাথে অন্ধকার আর সুনশান নীরবতা। কলেজ মাঠে ঢুকছি। আচমকা কিছু পায়ের শব্দ। ছায়ার মত কয়েকজন মনে হয় এগিয়ে আসছে আমার দিকে। কুয়াশা আর অন্ধকারে সবকিছুই অস্পষ্ঠ। এরমাঝে চাদর মোড়ানো ৫/৭ জন ঘিরে ধরে আমাকে। কিছু বোঝার আগেই তারা টেনে নিয়ে যায় একাডেমিক বিল্ডিং এর বারান্দায়। অন্ধকার আরও বাড়ে, সাথে ভয়। কাউকেই চেনা মনে হয় না। এসবের কারণও কিছু বুঝতে পারি না। রতনের কথা মনে পড়ে। কী ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে পারছি না। আমাকে ঘিরে সবাই চুপচাপ, মনে হল তারা যেন কারও জন্য অপেক্ষা করছে। নীরবতা ভেংগে জানতে চাই , কী ব্যাপার আপনারা কারা? কেন আমাকে এভাবে এখানে নিয়ে এলেন। একজন বলে উঠলেন অপেক্ষা করেন, সব বুঝবেন। অচেনা চেহারার ভারী কন্ঠ। কেউ একজন ফস করে মুখ ঘুরিয়ে সিগারেট জালায়। চাদর মোড়ানো লম্বা ছায়ার মতো আমাদের দিকে কেউ একজন এগিয়ে আসছে বুঝতে পারি। দেবদূত না যমদূত? এ অবস্থা থেকে কেউ আমাকে বাঁচাতে আসবে সেটি কল্পনাতেও আসে না। এই শীতের মাঝে ভীতরে ভীতরে ঘামছি। বাড়ছে টেনশন। মনে পড়ছে প্রিয়জনদের মুখ। বন্ধুদের কথা। মিছিল। নির্বাচনের প্রস্তুতি। আচমকা জুলে ওঠে টর্চ। সোজা আমার মুখ বরাবর। আলোতেও অন্ধকার বাড়ে। ছায়ামূর্তি আমার নাম ধরে ডেকে ওঠে। চমকে উঠি। কন্ঠটা খানিকটা চেনা মনে হয়।