ডেস্ক নিউজ
সড়ক পরিবহন আইনের বিধিমালা চূড়ান্ত হয়েছে। এটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। আগামীকাল রবিবার বিধিমালাটি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। ওই দিনই বিধিমালা প্রকাশ করা হতে পারে।
সড়ক পরিবহন আইন পাস হয় ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। ৮ অক্টোবর প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। আর ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর থেকে আইনটি কার্যকরের ঘোষণা দেয় সরকার। কিন্তু আইন পাসের পর চার বছরেও বিধিমালা চূড়ান্ত না হওয়ায় এর শতভাগ প্রয়োগ আটকে রয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে আজ শনিবার জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস পালিত হচ্ছে। সড়ক পরিবহন আইনের বিধিমালা চূড়ান্ত হওয়ার বিষয়টি কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী। তিনি বলেন, ‘বিধিমালা পাস হয়ে গেছে। আমরা অর্থ বিভাগে মতামতের জন্য পাঠিয়েছি। অর্থ বিভাগ এটার অনুমোদন দিয়েছে বলে বৃহস্পতিবার জেনেছি। আমরা রবিবার (আগামীকাল) এটি পেয়ে যাব। ’
সড়কের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন সংশ্লিষ্ট এমন সবাই এত দিন এই বিধিমালার অপেক্ষায় ছিলেন। বিশেষজ্ঞদের ভাবনা, আইনের সঠিক ব্যবহার থাকলে সড়কে শৃঙ্খলা থাকবে। এতে দুর্ঘটনাও কমবে।
বিধিমালা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিবহন ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘১৯৮৩ সালে মোটরযান অধ্যাদেশ তৈরি হওয়ার এক বছরের মাথায় বিধিমালা তৈরি হয়। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮, এটা পাস করতে গড়িমসি করে এক বছর লাগে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিধিমালাটা আলোর মুখ দেখেনি। এ কারণে আইনের পূর্ণাঙ্গ প্রয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না। আমি মনে করি, একটা অত্যন্ত আধুনিক আইন তৈরি করা হয়েছে। এই আইন যদি শতভাগ প্রয়োগ হয় তাহলে আমাদের সড়ক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আসবে। ’
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়নের জন্য আইনের কার্যকর ভূমিকা থাকা দরকার। বিধিমালা না থাকায় এত দিন আইন অকার্যকর ছিল। চার বছরে বিধিমালার কাজ শেষ করতে না পারা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। আইনের সংশোধনও আটকে আছে। পরিবহন মালিকদের কারণে সরকার এত দিনেও আইন বাস্তবায়ন করতে পারছে না।
এদিকে সড়ক পরিবহন আইনের মোট ১২৬টি ধারার মধ্যে ২৯টি ধারায় পরিবর্তন এনে সংশোধিত আইনের খসড়া প্রণয়ন করা হয়। পরে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতামত নিতে গত বছরের মে মাসে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে খসড়াটি তোলা হয়।
আইনের সংশোধন প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, ‘খসড়াটি আমরা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আলোচনা শেষে সম্মতি পাওয়ার পর খসড়াটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হবে। সেখান থেকে বিল আকারে সংসদে উপস্থাপন করা হবে। ’
আইনের কী সংশোধনের প্রস্তাব
বর্তমান আইনের ১০৫ নম্বর ধারায় দুর্ঘটনায় কোনো ব্যক্তি গুরুতর আহত বা নিহত হলে দায়ী ব্যক্তির সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাওয়া থেকে আহতদের বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। আর নিহত ব্যক্তির পরিবারকে পাঁচ লাখের পরিবর্তে তিন লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের প্রস্তাব করা হচ্ছে। তবে ভুক্তভোগীকে জরিমানার টাকা সম্পূর্ণ বা আংশিক পরিশোধের জন্য আদালত আদেশ দিতে পারবেন।
সংশোধনীর খসড়া প্রস্তাবে চালকের সহযোগীও শিথিল যোগ্যতায় চালক হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। সব মিলিয়ে এ আইনের ১২৬টি ধারার মধ্যে ২৯টি সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৫টি ধারায় বিদ্যমান কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড কমানো হচ্ছে। আর ভারী ও মাঝারি মোটরযানের সংজ্ঞাসহ আটটি বিষয়ের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। নতুন কয়েকটি ধারাও যুক্ত করা হয়েছে। প্রস্তাবগুলো গৃহীত হলে নিয়ন্ত্রণহীন গাড়ি বা চালকের অবহেলার কারণে দুর্ঘটনায় শুধু আহত হওয়ার ঘটনা ঘটলে চালককে দায়ী করে বিচার করা যাবে না।
দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান কড়াকড়িভাবে মানার দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, একজন কর্মক্ষম ব্যক্তি প্রাণ হারানোর কারণে ২৪ লাখ ৬২ হাজার ১০৬ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। সেই হিসাবে প্রত্যেক নিহত ব্যক্তির পরিবার এই পরিমাণ অর্থ রাষ্ট্র থেকে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার হকদার। যদিও সড়ক পরিবহন আইনে নিহত ব্যক্তির পরিবারকে পাঁচ লাখ এবং আহত ব্যক্তিকে তিন লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সেই ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধানও এখন পর্যন্ত কার্যকর হয়নি।
আইনের যে সংশোধনের কথা পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের দিক থেকে বলা হচ্ছে তা কতটুকু যুক্তিসংগত—এমন প্রশ্নে পরিবহন বিশেষজ্ঞ মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘আইন প্রয়োগ করার আগেই পরিবর্তন করা যৌক্তিক নয়। আইন মানুষের কল্যাণের জন্যই। তবে সেটা প্রয়োগের পর ত্রুটি দেখা দিলে সংশোধন হতেই পারে। ’
কতটা নিরাপদ হলো সড়ক
নিরাপদ সড়ক চাই সংগঠনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত চার বছরে ১৫ হাজার ৬৯০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৮ হাজার ৯২৪ জন মানুষ মারা গেছে। এ সময় আহত হয়েছে আরো ২৪ হাজার ৮৮৭ জন। ২০১৮ সালে মারা গেছে চার হাজার ৪৩৯ জন আর ২০২১ সালে চার হাজার ২৮৯ জন। ২০১৯ ও ২০২০ সালে করোনা মহামারির কারণে বেশির ভাগ সময় সড়কে স্বাভাবিক হারে যান চলাচল ছিল না। তবু এই দুই বছরে চার হাজার ৭০২ জন এবং চার হাজার ৯২ জন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।
শুধু চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসেই পাঁচ হাজার ৫৭ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। সংগঠনটির তথ্য বলছে, এ সময়ের মধ্যে চার হাজার ২২৪টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে আহত হয়েছে অন্তত সাত হাজার ৪১৪ জন। এর মধ্যে এক হাজার ৮৩১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় এক হাজার ৯১১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
দুর্ঘটনায় সড়কে মৃত্যু কেন কমছে না, জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সড়কে দুর্ঘটনা বাড়ার মূল কারণ হচ্ছে, সড়কে যত ধরনের ঝুঁকি ছিল সেই ঝুঁকিগুলো রেখেই আমরা গতি বাড়ানোর চেষ্টা করছি। আমরা অবকাঠামো করছি, দুই লেন থেকে চার লেন করছি, এক্সপ্রেসওয়ে করছি, উড়ালপথ করছি; সব কিছুই গতি বাড়ানোর জন্য। ঝুঁকি রেখে গতি বাড়ানো হিতে বিপরীত হিসেবে কাজ করছে। ’