ঢাকার যাত্রাবাড়ী মোড় থেকে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ঘাট ৩৫ কিলোমিটার এবং শরীয়তপুরের জাজিরার পাঁচ্চর মোড় থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গার মোড় ২০ কিলোমিটার। মোট ৫৫ কিলোমিটারের রাস্তা। রাস্তাটির নাম এখন ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে। এটিই দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে, যার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১২ মার্চ। অনেকদিন পর হঠাৎ করে কেউ এই এক্সপ্রেসওয়েতে প্রবেশ করলে চমকে উঠতে পারেন। কারণ এই ৫৫ কিলোমিটার রাস্তাকে রাস্তা মনে হবে না, মনে হবে এ যেন বিছানো কোনো কার্পেট।
শুধু তাই নয়, সড়ক পথটির পুরো অংশের মাঝখানের ডিভাইডারে যে হরেক রকমের ফুল গাছ লাগানো হয়েছে, তাতে এর শোভা আরও বেড়ে গেছে। এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে যারা যাতায়াত করছেন তারা এখনও এর পুরো সুফল ভোগ করতে পারছেন না। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কাজ সম্পন্ন হলেই কেবল এই এক্সপ্রেসওয়ের প্রকৃত সুফল মিলবে। এজন্য দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ এখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন পদ্মা সেতু চালু হওয়ার। কারণ পদ্মা সেতু চালু হলে ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলে যাতায়াতের সময় অনেক কমে আসবে। ঢাকা থেকে ভাঙ্গার মোড় পর্যন্ত যাওয়া যাবে মাত্র ৪৫-৫০ মিনিটে। অথচ ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে চালু হওয়ার আগে ঢাকা থেকে ভাঙ্গার মোড় পর্যন্ত যেতে সময় লেগে যেত ৫-৬ ঘণ্টা। এখন ঢাকার হানিফ ফ্লাইওভার থেকে নেমে মাওয়া যেতে ৩৫ কিলোমিটার রাস্তা পার হতে সময় লাগছে মাত্র ৩০ মিনিট। আর জাজিরার পাঁচ্চর মোড় থেকে ভাঙ্গার মোড় পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার রাস্তা যেতে সময় লাগছে মাত্র ১৫ মিনিট। সুতরাং পদ্মা সেতুর পাশাপাশি এই এক্সপ্রেসওয়েটি দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে আরেক গর্বের বিষয়।
এক্সপ্রেসওয়েটির সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন অংশটি হচ্ছে ফরিদপুরের ভাঙ্গার মোড়। এই মোড়ে ওপর থেকে দাঁড়িয়ে দেখলে মনে হবে এটি ইউরোপ-আমেরিকার মতো কোনো উন্নত দেশের সড়ক। একেবারে ঝকঝকে-তকতকে রাস্তা। ওপর থেকে বেঁকে-বেঁকে রাস্তা নেমে গেছে নিচের দিকে। গোল চক্করের মতো ঘুরে ঘুরে যেতে হবে চালককে যে যার গন্তব্যে। তবে নতুন চালক এখানে এলে ধাঁধায় পড়ে যাবেন। যদি সে চালক বরিশাল বা খুলনার দিকে যেত চান তাহলে মোড়ে এসে কোন রাস্তা ধরে যেতে হবে তিনি তা সহজে ঠিক করতে পারবেন না। তাকে অন্যের সাহায্য নিতেই হবে অর্থাৎ অন্যকে জিজ্ঞেস করে তবেই মোড় পার হয়ে যেতে পারবেন নিজ গন্তব্যে।
ভাঙ্গার মোড়ে এঁকে-বেঁকে একেক রাস্তা চলে গেছে একেক দিকে। ঢাকার দিক থেকে ভাঙ্গার মোড়ে নামতে বামের রাস্তা চলে গেছে বরিশাল বিভাগের দিকে। নাক বরাবর সোজা চলে গছে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। ডান পাশের রাস্তা দিয়ে যাওয়া যাবে খুলনা বিভাগ এবং ফরিদপুর জেলাসহ ওই অঞ্চলে। মোড়টি পার হতে কোনো বাহনকে এক সেকেন্ডের জন্যও থামার দরকার পড়বে না। কারণ এখানে কোনো সিগন্যাল পয়েন্ট নেই। তবে ভাঙ্গা মোড়ে ওভার পাসের নিচে বাস থামিয়ে যাত্রী তোলার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তবে নিচের অংশে ছোট ছোট টং দোকান এবং হকারদের উপস্থিতি এই সুন্দর সড়কটির সৌন্দর্য নষ্ট করছে। এখানে চা-বিস্কিটের দোকান, ডাবের দোকান, বাদাম বিক্রেতা এমনকি মুদি দোকানও রয়েছে। যা এখানে থাকার কোনো অনুমতি নেই।
স্থানীয় প্রভাবশালীরা তাদের বসার সুযোগ করে দিয়েছে এবং তারা এদের কাছ থেকে প্রতিদিন মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করছেন। এমনটিই জানালেন ভাঙ্গার বাসিন্দা সলিম মাতুব্বর। ভাঙ্গার মোড়ে দাঁড়িয়ে যখন তার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের তখনও চাঁদাবাজ গ্রুপটির উপস্থিতি দেখা যায়। সলিম মাতুব্বর জানান, এই চাঁদাবাজ গ্রুপটি শুধু দোকানগুলো থেকেই চাঁদা ওঠান তা নয়, এখানে এসে যত যাত্রীবাহী বাস, অটোরিকশা বা ট্রাক থামবে তার সব চালককেই এদের চাঁদা দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এলাকায় এত সুন্দর একটি সড়ক হয়েছে, এটি নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি। কিন্তু এভাবে যদি এখানে অব্যবস্থাপনা দেখা দেয় তাহলে গর্বের স্থাপনাটি নষ্ট হয়ে যাবে। এর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের দাবি জানাচ্ছি সরকারের কাছে।’
দৃষ্টিনন্দন চার লেনের এক্সপ্রেসওয়ের পাশাপাশি ধীরগতির গাড়ি চলার জন্য দুই পাশে রাখা হয়েছে দুটি করে আরও চারটি লেন। ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের নকশাও করা হয়েছে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য। এক্সপ্রেসওয়েটিতে গাড়ি প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য রাখা হয়েছে আটটি পথ। ঢাকার বাবুবাজার, যাত্রাবাড়ী, পোস্তগোলা, কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ, আব্দুল্লাপুর, আব্দুল্লাপুর সংলগ্ন টোলপ্লাজা, শ্রীনগর ফ্লাইওভার ও মুন্সীগঞ্জের মাওয়া মোড়ে রয়েছে এসব প্রবেশ-নির্গমণ পথ। আর এক্সপ্রেসওয়ের ভেতরে কিছুদূর পর পর নির্মাণ করা হয়েছে যাত্রী ছাউনিসংবলিত বাস-বে।
মাওয়ায় সড়কের পাশে থাকা মা-বাবার দোয়া রেস্টুরেন্টের মালিক হাবিব মোল্লা বলেন, এক্সপ্রেসওয়েতে কোনো যানজট না হওয়ার ফলে মাওয়া থেকে ঢাকা যেতে এখন দুই ঘণ্টার জায়গায় বরং ৩০ মিনিট সময় লাগছে। পোস্তগোলা রেলওয়ে ক্রসিং অতিক্রম করতে সময় লাগত ৩০-৬০ মিনিট। এখন এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে তা অতিক্রম করা ৫-১০ সেকেন্ডের ব্যাপার। এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় অনেকে আমাদের এলাকায় বাড়ি ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করতে চাচ্ছেন। আমার বিশ^াস এলাকাটি ক্রমেই আরও দৃষ্টিনন্দন হবে এবং একটি ভালো পর্যটন স্পটে রূপ নেবে।
এক্সপ্রেসওয়েটি ঘুরতে আসা ঢাকার ধানমন্ডির শাফায়েত হোসেন বলেন, এখানে এসে মনেই হচ্ছে না যে এটি বাংলাদেশের কোনো সড়ক। আমার কাছে মনে হচ্ছে উন্নত বিশে^র কোনো সড়ক দিয়ে আমরা যাচ্ছি। ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের মান ও সৌন্দর্য দেখে আমি গর্বিত। তবে মাঝেমধ্যেই কিছু পরিবহন রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠাচ্ছে এবং নামাচ্ছে। এই সড়কে এমনটি করা মোটেই মানায় না। এতে করে দ্রুতগতির যেকোনো গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পড়তে পারে।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে নির্বিঘ্নে যান চলাচল নিশ্চিত করার জন্যই এ এক্সপ্রেসওয়েতে দুটি সার্ভিস লেন, পাঁচটি ফ্লাইওভার, ১৯টি আন্ডারপাস, দুটি ইন্টারচেঞ্জ, চারটি রেলওয়ে ওভারব্রিজ, চারটি বড় সেতু, ২৫টি ছোট সেতু ও ৫৪টি কালভার্ট রয়েছে। দ্রুতগতির এ সুপার মহাসড়ক ঢাকা শহরের সঙ্গে পুরো খুলনা ও বরিশাল এবং ঢাকা বিভাগের কিছু অংশের যোগাযোগে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে রাখবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
আগামী ২০ বছর পর্যন্ত যানবাহন বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ১১ হাজার ৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে এ এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। এ মহাসড়ক এশিয়ান হাইওয়ের অংশ হয়ে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ঢাকা ও কলকাতাকে যুক্ত করে আন্তর্জাতিক যাতায়াতকে করবে আরও আরামদায়ক।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে একনেকে অনুমোদন পাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের তত্ত্বাবধানে সড়ক ও জনপথ অধিদফতর এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বাস্তবায়ন করে। ২০২০ সালের জুনে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তিন মাস আগেই গত মার্চ মাসে কাজ সম্পন্ন হয়ে যাওয়ায় এ এক্সপ্রেসওয়ের দ্বার খুলে দেওয়া হয়।