ডেস্ক নিউজ
প্রায় প্রতি বছরই বোরো মৌসুমে হাওরসহ ময়মনসিংহ অঞ্চলে আকস্মিক বন্যা ও ঝড়বৃষ্টি এবং উচ্চ তাপমাত্রায় বিস্তীর্ণ জমির ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এসব জমিতে স্বল্প জীবনকালীন উচ্চফলনশীল নাবি জাত বিনাধান-১৪ এবং আগাম জাত বিনাধান-১৬ আবাদ করলে চিটা হওয়ার আশঙ্কা নেই বলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে ফসল রক্ষা পাবে এবং বোরো ধানের উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এই দু’টি জাত সারা দেশে বোরো মৌসুমে আবাদ করার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) গবেষকরা।
গত ৪ এপ্রিল হাওরসহ ময়মনসিংহ অঞ্চলের ফসলি জমির ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া গরম বাতাসে কয়েক হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান চিটায় পরিণত হয়েছে। গবেষকদের মতে, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মার্চ ও এপ্রিল মাসে তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রির ওপরে চলে যায় এবং পরাগায়নের সময় উচ্চ তাপমাত্রা ও গরম বাতাস বা হিটশকে বিস্তীর্ণ জমির বোরো ধানের শীষ চিটায় পরিণত হয়। আকস্মিক বন্যা ও ঝড়বৃষ্টিসহ এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন স্বল্প জীবনকালীন উচ্চফলনশীল বিনাধান-১৪ এবং বিনাধান-১৬ আবাদ করলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে ফসল রক্ষা পাবে বলে দাবি গবেষকদের।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) পরিচালক ও বিনাধান-১৪ এর গবেষক (উদ্ভাবক) ড. আবুল কালাম আজাদ জানান, বিনাধান-১৪ বোরো মৌসুমে নাবিতে (বিলম্বে) আবাদযোগ্য একটি উচ্চফলনশীল ধানের জাত। এটি পরাগায়নের সময় ৩৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের চেয়েও বেশি তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। এই ধানের জীবনকাল ১১০ দিন থেকে ১১৫ দিন। একরপ্রতি ৭০ মণ ফলন পাওয়া যায়। উচ্চ তাপদাহ মোকাবেলায় বিনাধান-১৪ একটি উপযোগী জাত এবং সরকারের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের প্রধান গবেষক ড. শামসুন্নাহার বেগম জানান, বিনাধান-১৬ একটি স্বল্প জীবনকালীন ধানের জাত। বোরো মৌসুমে ১২৫ থেকে ১২৭ দিনের মধ্যে ফলন কর্তন করা যায়। অথচ অন্যান্য বোরো ধানের ফলন কর্তন করতে ১৫০ থেকে ১৫৫ দিন লেগে যায়। এ দিক থেকে বিনাধান-১৬ উচ্চফলনশীল ও আগাম জাতের ধান। এ ধানের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি। এই ধান চিটা হয় না। প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়লেও ঝড়-তুফানে ঝড়ে পড়ে না। গত তিন-চার বছর পরীক্ষামূলকভাবে আবাদ করে দেখা গেছে বিনাধান-১৬ বোরো মৌসুমে হাওর অঞ্চল বা নিচু এলাকায় চাষাবাদ করা যায় তাহলে কৃষকরাও লাভবান হবে এবং দেশের খাদ্য উৎপাদন বাড়বে।
বিনার জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড প্রকল্পের পরিচালক ও প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শহিদুল ইসলাম জানান, বোরো মৌসুমের ঝুঁকি কমাতে উপযোগী বিনাধান-১৬ ও ১৭ স্বল্প জীবনকালীন দু’টি উচ্চফলনশীল এবং বিনাধান-১৪ উচ্চতাপ সহিষ্ণু জাত। সরিষা ও আলুজাতীয় ফসলের পর বিনাধান-১৪ নাবিতে চাষ করা যায়। জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে এই জাতগুলো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চাষ করে ভালো ফলন পাওয়া গেছে। এই ধান বোরো মৌসুমে চাষ করা হলে কৃষকরা আর্থিকভাবে লাভবান হবেন। যদি ক্রপ প্যাটার্নে এই ধান চাষ করা যায় তাহলে এক ফসলি জমিতে দুই ফসল, দুই ফসলি জমিতে তিন ফসল আবাদ করা যায়।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম জানান, হাওর অঞ্চলের একটি মাত্র ফসল বোরো মৌসুমে আবাদ করা হয়। প্রায়ই আকস্মিক বন্যা ও ঝড়বৃষ্টি এবং উচ্চ তাপমাত্রায় হাওরের বিস্তীর্ণ জমির ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এ জন্য হাওর অঞ্চলে আগাম জাতের কোনো বিকল্প নেই। এ লক্ষ্যে গত তিন-চার বছর ধরে সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া কৃষকপর্যায়ে চাষ করে ১২৫ থেকে ১২৭ দিনের মধ্যে কর্তন করা সম্ভব হয়েছে। যদিও বিনাধান-১৬ আমনের একটি জাত। এটি আলোক অসংবেদনশীল হওয়ার কারণে বোরো মৌসুমেও কৃষকরা স্বপ্রণোদিত হয়েই চাষাবাদ করে হেক্টরপ্রতি সাড়ে সাত টন থেকে সাড়ে আট টন ফলন পেয়েছেন। আগামী বোরো মৌসুমে হাওর অঞ্চলসহ সারা দেশে উচ্চফলনশীল বিনাধান আবাদের জন্য জাতীয় বীজ বোর্ডের মাধ্যমে মৌসুমের জন্য ছাড়পত্র নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিনাধান-১৪ ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে রোপণ করলেও ১১০ থেকে ১১৫ দিনের মধ্যেই কর্তন করা যায়। বিনাধান-১৭ অন্যান্য ধানের মতোই ১৪৫ থেকে ১৫০ দিনে পরিপক্বতা লাভ করলেও এই ধানের ফলন অনেক বেশি। হেক্টরপ্রতি সাড়ে সাত টন থেকে সাড়ে ৯ টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। এসব ধান চাষে চাষিরা অধিক লাভবান হবেন। এ জন্য আগামী বোরো মৌসুমে এসব ধান চাষিপর্যায়ে আবাদ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। ফসলের প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ ঝুঁকি কমাতে হাওরসহ ময়মনসিংহ অঞ্চলে আগাম ও স্বল্প জীবনকালীন উচ্চফলনশীল বিনাধান আবাদ করলে কৃষকদের ধান উৎপাদনে নতুন দিগন্তের উন্মোচন হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, দেশে মোট চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ৮১ লাখ হেক্টর। হাওর অঞ্চলে জমির পরিমাণ ৮ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টর, যা মোট চাষযোগ্য জমির প্রায় ৭%। হাওরে চলতি বছর ৪ লাখ ৫১ হাজার ৭৭০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। হাওর অঞ্চলে উৎপাদিত ধান দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আগাম বন্যা, ঝড়বৃষ্টি ও উচ্চ তাপমাত্রার কারণে হাওর এলাকায় ধান উৎপাদন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।