ডেস্ক নিউজ
বৃষ্টি বা বন্যার পানির অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে দেশের সব হাওড়সহ নিচু অঞ্চলসমূহে আর কোনো সড়ক বা রাস্তা নির্মাণ করা হবে না। প্রয়োজনে সাধারণ সড়কের পরিবর্তে উড়াল সড়ক নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে তিনি এই নির্দেশনা দেন। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহণ, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণনে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদন্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দন্ডের বিধান রেখে একটি নতুন আইনের খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।
বৈঠক শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, মন্ত্রিসভা বৈঠকে হাওড় পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষ আলোচনা হয়েছে। পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী, মৎস্যমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী এবং পরিকল্পনামন্ত্রী কথা বলেছেন। বছরে প্রায় পাঁচ হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয় ওইসব এলাকায়। কিন্তু এবার ১-৬ এপ্রিলের মধ্যেই এক হাজার ২০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ওপর থেকে পানি চলে এসেছে। প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানে প্রায় দুই লাখ ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়। সোমবার জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে কথা বলেছি। নতুন করে ভারি বৃষ্টি না হলে হাওড় ভালো অবস্থায় থাকবে।
হাওড়ে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে মোটামুটি সব ধান কাটা হয়ে যায় জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এদিকে একটু দেরিতে হয়। হাওড়ে এপ্রিলের শেষ থেকে মে মাসের প্রথমেই পানি চলে আসে, এটা আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। আগামী ৮-১০ দিন যদি বৃষ্টি না হলে আশা করা যায়, বড় কোনো ক্ষতি হবে না।
তিনি বলেন, সোমবার সুস্পষ্ট নির্দেশনা (ক্লিয়ার ইন্সট্রাকশন) দিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, হাওড় এলাকায় কোনো রকমের সাধারণ রাস্তাঘাট এখন থেকে আর করা যাবে না। এখন থেকে হাওড়ে কোনো সড়ক হলে সেটি এলিভেটেড (উড়াল) হতে হবে। যেন বৃষ্টি বা বন্যার পানি চলাচলে বাধা না আসে। পারটিকুলারলি এটা দেখতে বলা হয়েছে।
খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম আরও বলেন, সম্প্রতি একনেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প পাস হয়েছে, সুনামগঞ্জের সেই প্রকল্পেও এলিভেটেড হচ্ছে। শুধু হাওড় না, নিচু এলাকায় কোনো সড়ক হলে সেগুলো অবশ্যই এলিভেটেড সড়ক করতে হবে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, সিলেটের পানিটা মূলত নামে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলা হয়ে। এখানে যে রাস্তাটা করা হয়েছে, মিঠামইন থেকে অষ্টগ্রাম, সেটাতে কোনো ইফেক্ট হলো কিনা, এটাও দেখতে বলা হয়েছে। আমরা নিজেরাও রোডস অ্যান্ড হাইওয়েকে বলেছি, এটা রিভিউ করে প্রতি আধা কিলোমিটার পরপর দেড়শ থেকে দুইশ মিটার ব্রিজ করে দেওয়া যায় কিনা, তা দেখতে। এরই মধ্যে যেসব রাস্তা হয়ে গেছে, সেখানেও দেখতে বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, দেশের হাওড়াঞ্চলে আর্লি ভ্যারাইটি সোয়িং করা যায় কিনা, এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় চেষ্টা করছে। যেন এপ্রিল মাসের ১০-১২ তারিখের দিকেই ধান কেটে ফেলা যায়।
বৈঠকের বরাত দিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব আরও বলেন, পরিকল্পনামন্ত্রী অনুরোধ করেছেন, হাওড় বা নিচু এলাকায় যেসব বাঁধ দেওয়া হয়েছে, সেগুলো ফ্রুটফুল কিনা বা কোয়ালিটি ঠিক আছে কিনা, তা যেন খতিয়ে দেখা হয়। এই বর্ষায় তো আর কিছু করা যাবে না। আগামী বর্ষার আগে যেন এটা রিভিউ করে সংস্কার করা হয়।
খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, দেশের যেসব নদী-নালা ও হাওড়ে অতিরিক্ত পলি পড়েছে, সেগুলোকে পুনর্খনন করতে আগামী বর্ষার আগেই প্রকল্প গ্রহণ করে কাজ শুরুর বিষয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।
এ ছাড়া মন্ত্রিসভা বৈঠকে খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহণ, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন এবং ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ আইন-২০২২ এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব। তিনি বলেন, ‘এই আইনে বাজারে অনিরাপদ বা ভেজাল খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করলে অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর কারাদন্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা করার বিধান রাখা হয়েছে। এই আইন কেউ লঙ্ঘন করলে তার শাস্তি হবে ভ্রাম্যমাণ এবং নিরাপদ খাদ্য আদালতে।’
তিনি আরও বলেন, ‘খাদ্যদ্রব্যে অস্বাভাবিক কোনো কিছু মেশানো, কৃত্রিম সংকটের জন্য মজুত করা, বিক্রয়ের ক্ষেত্রে কম দেওয়া হলে এসব অপরাধের জন্য একইরকম শাস্তি দেওয়া হবে।’
তিনি বলেন, খসড়াটি খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে এসেছে। দুটি আইন একসঙ্গে করে নতুন আইনটি আনা হয়েছে। সামরিক শাসনমালের জারি করা অধ্যাদেশগুলোর বিষয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ‘দ্য ফুড গ্রেইন সাপস্নাই প্রিভেনশন অব প্রিজুডিশিয়াল অ্যাকটিভিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৯’ এবং ‘ফুড স্পেশাল কোর্ট অ্যাক্ট, ১৯৫৬’ দুটি আইনকে একসঙ্গে করে নতুন আইন করা হচ্ছে। খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহণ, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণনে ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ করা যায়, যাতে সিস্টেমের মধ্যে আনা যায়- সে জন্য আইনটি করা হচ্ছে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এর মাধ্যমে বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে না, বাজারে মান যাতে নিশ্চিত থাকে। কেউ যাতে অনৈতিক কাজ করতে না পারে, ক্রেতারা যাতে ঠকে না যায়। খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহণ, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন এবং এ সংক্রান্ত অন্যান্য কাজের ক্ষেত্রে কোনো অপরাধ যাতে না হয়, সেগুলো প্রতিরোধ করা করার জন্য এই আইনটি আনা হয়েছে।
তিনি বলেন, আরেকটি সুন্দর জিনিস করা হয়েছে, কোনো খাদ্যদ্রব্য যদি জব্দ করা হয়, সেই খাদ্য যদি পচনশীল হয়, তবে সেই খাদ্যদ্রব্য নিলাম ডেকে বিক্রি করে শুধু স্যাম্পল হিসেবে অল্প একটু রাখা যাবে। খাদ্যপণ্য যদি পচনশীল নাও হয়, তবেও ৪৫ দিনের মধ্যে নিলাম করে দিতে হবে, টাকাটা কোর্টের কাছে থাকবে। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি যদি খালাস পান, তবে টাকাটা তিনি পেয়ে যাবেন। আর দন্ড পেলে আদালত যেভাবে আদেশ দেবে, সেভাবে হবে।
আইনের অধীনে বিভিন্ন অপরাধ তুলে ধরে খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে অতিরিক্ত ক্ষতিকর কিছু মিশিয়ে উপাদন করা, নির্দিষ্ট সময়ের বেশি মজুত করা, সরকারি কর্মসূচির নামাঙ্কিত বা বিতরণকৃত এমন চিহ্ন যুক্ত ছাড়া সরকারি খাদ্যগুদাম থেকে খাদ্যশস্য ভর্তি বস্তা গ্রহণ, স্থানান্তর, মজুত করা, হাত বদল বা পুনরায় বিক্রি করাও অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।
তিনি বলেন, সরকারি কোনো কর্মসূচির আওতায় নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে কম বিতরণ করা, সরকারি খাদ্যসামগ্রী বিক্রি বা বিতরণের জন্য বিএসটিআই নির্ধারিত বাটখানা বা মাপ ব্যবহার না করে হেরফের করলেও শস্তি পেতে হবে।
চলতি মেয়াদে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত
বাস্তবায়ন হার ৮৯ শতাংশ
বর্তমান সরকারের চলতি মেয়াদে (২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত) গত প্রায় ৩৯ মাসে মন্ত্রিসভার বৈঠকে নেওয়া সিদ্ধান্তসমূহের ৮৯ দশমিক ০৪ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। মন্ত্রিসভা বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন বিষয়ে চলতি বছরের প্রথম ত্রৈমাসিক (জানুয়ারি-মার্চ) প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মন্ত্রিসভা বৈঠক শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত মন্ত্রিসভার মোট ৮৯টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। মন্ত্রিসভার এসব বৈঠকে সিদ্ধান্ত আসে ৭৪৮টি। এর মধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছে ৬৬৬টি। সে হিসাবে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের হার ৮৯ দশমিক ০৪ শতাংশ। একই সময় নেওয়া সিদ্ধান্তসমূহের মধ্যে বর্তমানে ৮২টি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নাধীন।
সরকারের চলতি মেয়াদে ৮১টি আইন এবং পাঁচটি অধ্যাদেশ জারি হয়েছে। এছাড়া বৈঠকে অনুমোদনের পর প্রক্রিয়াধীন আইনের সংখ্যা ৫২টি। চলতি মেয়াদে ২৮টি নীতি/নীতিমালা/কর্মকৌশল/কর্মপরিকল্পনা অনুমোদন, ৪০টি দ্বিপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক চুক্তি/প্রটোকল অনুমোদন/অনুসমর্থন করা হয়েছে। এ ছাড়া এ সময় মন্ত্রিসভার জন্য উপস্থাপিত সারসংক্ষেপের সংখ্যা ৫২৬টি।
অন্যদিকে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে অনুষ্ঠিত সাতটি মন্ত্রিসভা বৈঠক থেকে ৫৯টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর মধ্যে ৩৬টি। বাস্তবায়নের এই হার ৬১ দশমিক ০২ শতাংশ। এ ছাড়া এ সময় নেওয়া সিদ্ধান্তসমূহের মধ্যে ২৩টি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নাধীন।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব আরও জানান, ২০২১ সালের একই সময় (জানুয়ারি-মার্চ) পাঁচটি মন্ত্রিসভা বৈঠকে সিদ্ধান্ত আসে ৪১টি। এর মধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছিল ২০টি। গত বছর প্রথম তিন মাসে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের হার ছিল ৪৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
তিনি আরও জানান, গত তিন মাসে (জানুয়ারি থেকে মার্চ) মন্ত্রিসভা বৈঠকে চারটি নীতি বা কর্মকৌশল এবং চারটি চুক্তি বা প্রটোকল অনুমোদিত হয়েছে। এ সময় সংসদে আইন পাস হয়েছে চারটি।
গত বছর একই সময় (জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত) মন্ত্রিসভা বৈঠকে নীতি বা কর্মকৌশল অনুমোদিত হয়েছিল একটি। এ ছাড়া চুক্তি বা প্রটোকল অনুমোদিত হয় চারটি এবং সংসদে আইন পাস হয়েছিল ছয়টি।