- ২১ সালে ৫ বিলিয়ন ডলার আয়ের টার্গেট
ফিরোজ মান্না ॥ তথ্যপ্রযুক্তি সেক্টর এখন বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় মাধ্যম হিসাবে কাজ করছে। দেশে তৈরি হার্ডওয়্যার-সফটওয়্যার ও প্রযুক্তি পণ্য বিদেশে রফতানির হার দিন দিন বেড়েই চলেছে। দেশে গত দুই বছরে এই খাত থেকে দেড় থেকে দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় এসেছে। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশে মোবাইল ও ল্যাপটপ রফতানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। বিশ্বের ১৮০ দেশে বাংলাদেশের সফটওয়্যার ও হার্র্ডওয়্যার রফতানির বাজার তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে আউটসোসিংয়ে তরুণরা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন। এখন ভারতের কাছাকাছি টাকায় তরুণ প্রজন্ম আউটসোসিংয়ের কাজ পাচ্ছেন। ফলে এই সেক্টরের ভবিষ্যত অনেক উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ২০২১ সালের মধ্যে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয়ের টার্গেট নিয়েছে সরকার। টেলিযোগাযোগ ও বেসিস সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার এ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) সূত্র জানিয়েছে, দেশের অভ্যন্তরীণ সফটওয়্যারের বাজারও বড় হচ্ছে। দেশের বাজার দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশই আবার দেশী সফটওয়্যার নির্মাতারা দখলে রেখেছেন। তবে বড় প্রতিষ্ঠানের কাজগুলোর ক্ষেত্রে এখনও বিদেশী সফটওয়্যারের ওপর নির্ভরতা রয়েছে। দেশের ৬০ ব্যাংকের মধ্যে ২৭টি ব্যাংকেই দেশী সফটওয়্যার ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশের সফটওয়্যার খাতে বেশি চাহিদা রয়েছে ইআরপি, বিভিন্ন এ্যাপ্লিকেশন তৈরিসহ, ডিজিটালাইজেশনের কাজে ব্যবহৃত সফটওয়্যার। দেশের বাজারে চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি এখন সফটওয়্যার নির্মাতারা বিদেশেও রফতানি করছে। তবে দেশ থেকে বড় ধরনের একক সফটওয়্যার রফতানি হাতে গোনা। এখন পর্যন্ত আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিপিও, সার্ভিস রফতানি হচ্ছে। বিপিওর ক্ষেত্রে ব্যাংকের নানা কাজ, নানা রকম সেবা দেয়া হচ্ছে। ফ্রিল্যান্সিংয়ে গ্রাফিক্স, ওয়েবের কাজ হচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে সফটওয়্যার এখনও রফতানির সব অর্থ ব্যাংকের মাধ্যমে আসে না। ফলে প্রকৃত তথ্য পাওয়া কঠিন যে কত ডলার বাংলাদেশ আয় করেছে।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ভবিষ্যত নিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার আশাবাদী। তিনি বলেন, তৈরি পোশাক যেমন ধীরে ধীরে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় একটি খাত হিসাবে বেড়ে উঠেছে। একইভাবে তথ্য প্রযুক্তি খাত এগিয়ে যাচ্ছে। একদিন এই খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় উৎস হবে। ২০২১ সালে আমরা এই শিল্পের প্রথম ধাপটি পার করব। ২০২১ সালে বাংলাদেশ ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করবে। ২০৪১ সালের মধ্যে এই সেক্টর থেকে তৈরি পোশাক শিল্পের চেয়ে বেশি আয় হবে। এই খাতে দেশের তরুণ প্রজন্ম আশার আলো দেখতে শুরু করেছে। তারা এখনই আউটসোসিংয়ের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন। এই শিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত তারা হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার রফতানি করছেন। দেশে তৈরি মোবাইল ল্যাপটপ বিদেশে রফতানি হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেন এমন তথ্যপ্রযুক্তিবিদরাও এই সেক্টর নিয়ে আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত দেশী সফটওয়্যার ব্যবহার করা হবে। আমরা ইতোমধ্যেই বিদেশী ‘সফটওয়্যারকে রিপ্লেস’ করছি। বিদেশী সফটওয়্যারের জায়গায় দেশী সফটওয়্যার প্রতিস্থাপন করতে পেরেছি। আমাদের সফটওয়্যার ১৮০ দেশে রফতানি হয়। আমাদের সফটওয়্যার আয়ারল্যান্ডের পুলিশ ব্যবহার করছে, সিকিউরিটি জন্য আমাদের সফটওয়্যার আছে, মোবাইল অপারেটররা ব্যবহার করছে।
তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও বেসিসের সাবেক সভাপতি হাবিবুল্লা এন করিম জনকণ্ঠকে বলেন, গত কয়েক বছরে তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে বিলিয়ন ডলার আয় হচ্ছে। দিন দিন ‘ইমার্জিং চেন’ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা আরও বড় ‘স্কেলে’ করতে হলে ইন্টারনেট স্পীড বাড়াতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক, সুইডেন, হল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের ৭০ থেকে ৮০ দেশে আমাদের তরুণরা আউটসোসিং করছে। ১০ বছর আগেও এটা ভাবা যেত না। ভারতে আউটসোসিংয়ের জন্য হায়দারাবাদের নামই হয়ে গেছে ‘সিলিকন ভ্যালি’। তখন থেকেই দেশটির যুবসমাজ বিলিয়িন বিলিয়ন ডলার আয় করছে। এখন আমাদেরও এমন সুযোগ তৈরি হয়েছে। পৃথিবীর অনেক বড় কোম্পানিগুলো আমাদের তরুণদের কাজ দেয়ার জন্য আগ্রহী। কারণ এখানে প্রতি ঘণ্টা কাজ ৩ থেকে ৪ ডলারে করে নিতে পারে। অন্য যে কোন দেশ থেকে এই দামে তারা কাজ করাতে পারে না। তাই তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প একদিন বড় একটা স্থান করে নেবে। তৈরি পোশাক শিল্পকে অতিক্রম করতে পারবে কিনা বলা মুশকিল। তবে তথ্যপ্রযুক্তির ভবিষ্যত অনেক সম্ভাবনাময়। এবারের ডিজিটাল মেলায় ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক প্রদর্শন হয়েছে। ফাইভ-জি এলে ব্যবসা বাণিজ্য থেকে শুরু করে সব সেক্টরে বড় ধরনের উন্নয়ন ঘটবে।
তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সুমন সাব্বির জনকণ্ঠকে বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি সেক্টরটি নিঃসন্দেহে সম্ভাবনার একটি বিষয়। কারণ এই সেক্টরের ভবিষ্যত অনেক আশা জাগায়। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে এটা একটা বড় ক্ষেত্র। এখান থেকে তারা আয় রোজগার করতে পারবে। তবে সেবার ক্ষেত্রে সম্ভাবনা যেমন বাড়ছে তেমনি তৈরি হচ্ছে নানা চ্যালেঞ্জ। বেসিস, বাক্যসহ দেশে দেড় হাজার আইটি ও আইটিইএস কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের পাঁচ শ’ কোম্পানি রফতানিতে রয়েছে। শুধু বেসিসে এক হাজারের বেশি সদস্য কোম্পানি রয়েছে। অটোমেশন, প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি ও নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনের সঙ্গে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর টিকে থাকার জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এবারের ডিজিটাল মেলায় কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানের সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। এখানে অনেক সম্ভাবনার কথা বলা হয়। বাস্তবেও অনেক বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাও বলেছেন, এই সেক্টর একদিন তৈরি পোশাক শিল্পকে ছাড়িয়ে যাবে। এটা ঠিক যে, এই সেক্টরে অনেক কাজ আছে। ইন্টারনেটের উচ্চগতি সবার আগে প্রয়োজন। তাহলে কিন্তু আমাদের প্রযুক্তিবিদরা বড় ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারে।
দেশে সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা খাতে রফতানি ২০১৮ সালে ১ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে। টাকার হিসেবে প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশে সফটওয়্যার খাতের সংগঠন বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার এ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) ও সফটওয়্যার রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। সরকারের টার্গেট বা লক্ষ্য ছিল, ২০১৮ সালের মধ্যে এক বিলিয়ন রফতানি আয় করা। এছাড়া ২০২১ সালের মধ্যে ৫ বিলিয়ন ডলারের সফটওয়্যার ও সেবাপণ্য রফতানি করা। সফটওয়্যার রফতানিতে ক্যাশ ইনসেনটিভ দেয়াসহ, এ খাতের উন্নয়নে নেয়া নানা পদক্ষেপের কারণে ২০১৮ সালে সফটওয়্যার রফতানি বেড়েছে। গত দুই বছরে এই খাতে আয় বেড়ে দেড় বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, শুরুতে তথ্যপ্রযুক্তি খাত নিয়ে মানুষের মনে এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব কাজ করত। এখন আর সেই নেতিবাচক ধারণাটি নেই। দেশের মানুষ বুঝতে পেরেছে তথ্যপ্রযুক্তি ছাড়া উন্নত বিশ্বের সঙ্গে একসঙ্গে চলা যাবে না। এ কারণেই এই খাত থেকে এক বিলিয়ন ডলারের রফতানি করা সম্ভব হয়েছে। এখনও হয়ত কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না, ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয়ের বিষয়টি। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে রফতানি মানে শুধু সফটওয়্যারে মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বাংলাদেশ হার্ডওয়্যারেও উন্নতি করছে। ভারত, চীন ও ইউরোপের দেশগুলোর পাশাপাশি এখন ফিলিপিন্স, পাকিস্তানের মতো দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। তবে দেশে শিক্ষার মানোন্নয়ন ও দক্ষ জনশক্তি তৈরির মাধ্যমে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।