বা, লা, নাটোর:
নারী ও পুরুষ-জীব জগতের মূল বিন্যাস এ দুয়ে মিলে। এ বিন্যাস প্রকৃতির চলেও প্রকৃতির নিয়মেই। আবার প্রকৃতিতেই রয়েছে এ বিন্যাসের ব্যতিক্রম। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। মানুষ সমাজে এমন অনেক ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটছে অহরহ, সে খবর রাখে ক’জনা। নারী-পুরুষের বাইরে তৃতীয় লিঙ্গের সরব অবস্থান এখন আর লুকোছাপার বিষয় নয়। বিষয়টিকে ঘিরে রয়েছে হাজারও কৌতুহল- প্রশ্ন। আধুনিক সমাজ ব্যবস্থাও খুলতে পারেনি সে কৌতুহলের খিড়কি। তাচ্ছিল্য আর কটাক্ষের দেয়াল তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলোকে রেখেছে আড়াল করে। ভারতীয় উপমহাদেশে বিচ্ছিন্নভাবে সমাজের অন্তরালে বসবাস করলেও এদের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। ইংরেজীতে এদের বলা হয়, By born incomplete sextual organ. বাংলায় বলা হয় হিজড়া। তবে হিজড়া বলে সমাজে যারা চিহ্নিত বা রাস্তাঘাটে যাদের আমরা দেখে থাকি, তাদের সবাই incomplete sextual organ নিয়ে জন্ম নেয়নি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, শারীরিকভাবে এদের অনেকেই পরিপূর্ণ পুরুষ। কেবলমাত্র মানসিকভাবে মেয়ে হওয়ার কারণেই এরা নারী সেজে থাকে। গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে হিজড়াদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এদের অনেকেই বিবাহিত। ছেলে মেয়েও আছে এদের। তারপরও এরা বেশবাসে-আচরণে নারী। শাড়ি কিংবা সালোয়ার কামিজ পরতে এরা সাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এদের মনেও জন্ম নেয় ভালবাসা। তবে সে ভালবাসা মনের কোণে জমতে থাকে কোন না কোন পুরুষের হাতছানির অপেক্ষায়। সুঠামদেহী নিরাপদ পুরুষের কাছে এরা প্রেম পর্যন্ত নিবেদন করে থাকে। পারিবারিক অবস্থান ভেদে হিজড়াদের তিন শ্রেণীতে বিন্যাস করা যায়। প্রথম সারিতে রয়েছে দৃশ্যমান হিজড়া। দ্বিতীয় সারিতে দৃশ্যমান নয়, তবে অনুমান করা যায় এবং শেষ সারিতে পুরোপুরি লুকায়িত। আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করেই শ্রেণী বিন্যাসটি ঘটে থাকে। নিম্নবিত্ত বা বিত্তহীন পরিবারে জন্ম হলে এদের নির্যাতনের শিকার হতে হয়। উঠতে-বসতে কটুক্তি, তাচ্ছিল্য, কটাক্ষে বিক্ষুব্ধ হয়ে এরা মানসিকভাবে পৃথক জগতে বসবাস করতে শুরু করে। শারীরিক গঠন যাই হোক, মানসিকভাবে নিজেদের পূর্ণাঙ্গ মেয়ে ভেবে এরা ঘরের মেয়েলী কাজ- যেমন ঘর গোছানো, থালা-বাসন মাজা, কাপড় ধোয়া, রান্না-বান্না করতে পছন্দ করে। সুযোগ পেলেই সকলের অলক্ষ্যে মেয়েদের মতো এরা সাজতে বসে। এদের মেয়েলী আচরণ অনেককেই তখন অবাক করে। পরিবারের অন্য সদস্যরা এদের আচরণে হাসাহাসি ও ঠাট্টা-মশকরা করায় এরা আরও সঙ্কুচিত হয়ে নিজেকে সরিয়ে-গুছিয়ে রাখে সযতেœ। ছোটবেলা থেকেই ছেলেদের এড়িয়ে মেয়েদের সঙ্গে খেলাধুলা করতে এরা আগ্রহী হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনের কুঠুরীতে লুকিয়ে থাকা মেয়েটি সঙ্কোচের বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে আসে। মেয়েলী পোশাক তখন তার হয়ে ওঠে প্রিয়। মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে দৃশ্যটি অন্যরকম। এসব পরিবারে মানসিক মেয়েদের প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্বেও পুরুষ সেজে থাকতে হয়। পরিবারের সদস্যরা এদের আচরণে বিরক্ত হয়। তবে এদের কদর বাড়ে পারিবারিক আচার-অনুষ্ঠানের দিনে। এদিন মেয়েলী কাজগুলো ঘরের মেয়েদের সামনে পাহাড় ডিঙানো কষ্টের সমান হয়ে দাঁড়ায়। তখন পরিবারের ওই ‘‘মানসিক মেয়েটি’’ এগিয়ে এসে তাদের উদ্ধার করে। শারীরিক গঠনে এরা শক্ত-পোক্ত পুরুষ হওয়ায় কঠিন কাজগুলো অনায়াসে সেরে ফেলতে পারে। নিম্ন মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের মানসিক মেয়েদের বিয়ে দিয়ে আচার-আচরণ বদলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়। এতে স্বামী-স্ত্রী দু’জনকেই কাটাতে হয় অতৃপ্ত জীবন। দাম্পত্য জীবনের সার্থকতা খুঁজতে দু’নারী (একজন শারীরিক ও অন্যজন মানসিক) একে অপরের চোখে দেখে বিদ্বেষের বিচ্ছুরণ। শুধু সামাজিক মর্যাদা ও পারিবারিক সম্মান বজায় রাখার স্বার্থে দু’টি অতৃপ্ত নারী দিনের পর দিন, বছরের পর বছর বাস করে একই ছাদের নিচে। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে পরিবারের পুত্রবধুটি সংসারের মুখে ঝাঁটা মেরে চলে যায় বাবার বাড়ি। সংসার ভাঙার গোপন এ কাহিনীটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে থাকে অনুচ্চারিত। তবে অনেক সময় নেহায়েত বাধ্য প্রশ্নের মুখে ওই বধুকে উল্টো প্রশ্ন করতে শোনা গেছে, দু’মেয়ে মিলে কী সংসার হয়? অর্থাৎ এ থেকে স্পষ্ট হয় যে, মধ্যবিত্ত পরিবারের হিজড়াদের শনাক্ত করা যায় না। এরা দৃশ্যমান নয়, তবে উপলব্ধি করা যায়। অন্যদিকে উচ্চবিত্ত পরিবারের সামাজিক মর্যাদা, পারিবারিক সম্মান, প্রভাব-প্রতিপত্তি বেশি বলে এখানে এরা থাকে পুরোপুরি লুকায়িত।
আর্থ-সামাজিক অবস্থা ভেদে মানসিক নারীদের সামাজিক অবস্থানের ভিন্নতা থাকলেও একটি ক্ষেত্রে রয়েছে দারুণ মিল। যে পরিবারেই জন্ম হোক না কেন, তাচ্ছিল্য আর কটাক্ষের আঘাত সয়ে এদের বেড়ে উঠতে হয়। অথচ সহমর্মিতা ও মানসিক চিকিৎসা পেলে এরা হয়ত দেহ-মনে পরিপূর্ণ পুরুষ হয়ে উঠতে পারে। এদিক দিয়ে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে নিম্নবিত্ত বা বিত্তহীন পরিবারের হিজড়া অর্থাৎ মানসিক মেয়েরা। সাজে-পোশাকে-আচরণে মেয়ে হয়ে থাকতে তাদের সামনে তেমন জোরালো কোন বাধা নেই। তাই এদের মানসিক কষ্ট অনেক কম। কিন্তু নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের মানসিক মেয়েদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পুরুষ সেজে থাকতে হয়। পুরুষের মতো আচরণ করতে হয়। মানসিকভাবে মেয়ে হয়েও বিয়ে করতে হয় অপর একটি মেয়েকে। এতে তাদের মনের গভীরে দিনের পর দিন জমতে থাকে কষ্টের পাহাড়। এ কষ্ট থেকেই দেখা দেয় দাম্পত্য কলহ, অমিল, কাজ-কর্মের প্রতি অনীহা। এমনকি পুরো জগতের ওপর বিক্ষুব্ধ হয়ে এরা আত্মহত্যা পর্যন্ত করে থাকে। দীর্ঘ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য। নিম্নবিত্ত বা বিত্তহীন পরিবারের হিজড়াদের পারিবারিক সম্পদ থেকে বঞ্চিত করা হয়। ভোটাধিকার থেকেও এরা বঞ্চিত। কারণ ভোটার তালিকায় তৃতীয় লিঙ্গের কোন অস্তিত্ব নেই। এদের জন্য নাগরিক সুবিধার দরজাও বন্ধ। হাসপাতাল, পৌরসভাসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যাতায়াতের পথে এদের জন্য অপেক্ষা করে বিদ্রুপ আর অশ্লীল কটুক্তি। তাই এরা এসব স্থান এড়িয়ে চলে। অথচ দেশের মোট জনসংখ্যার বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে এদের অবস্থান। সহায়-সম্পদ বঞ্চিত হিজড়াদের আয়ের উৎস খুবই সীমিত। অন্যের অনুকম্পা নিয়ে এদের খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে হয়। কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় হিজড়াদের ৭০ ভাগই যৌনকর্মী। অবাধ যৌনাচার এদের রেখেছে এইচআইভি এইডস ঝুঁকির মধ্যে। অনেকের রয়েছে নির্দিষ্ট যৌনসঙ্গী। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরা একাধিক যৌনসঙ্গীর সঙ্গে যৌনাচারে অভ্যস্ত। সমাজ-সংসারে সঙ্কুচিত-এতটুকু হয়ে থাকলেও নিজেদের গণ্ডিতে এদের উচ্ছাস বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতো উপচে পড়ে। সেখানে কে কোন পরিবার থেকে এসেছে, তার কথা এরা ভাবে না। ভাবের আদান-প্রদানে তখন কথা যেন আর ফুরাতেই চায় না। ভারতীয় উপমহাদেশে এরা একই ভাষায় কথা বলে। ফলে এদের মিলন মেলায় কে ভারতীয়, কে পাকিস্তানী কিংবা কে বাংলাদেশী- সে প্রভেদের কথা এদের মনে থাকে না। এদের ভাষায় এরা তখন সবচেয়ে ‘‘চিসা’’ থাকে। হিজড়াদের ভাষায় চিসা অর্থ সুন্দর। বছরে একবার এরা মিলন মেলায় মিলিত হয়। এ মিলন মেলার আয়োজন হয় ভারতে। হিজড়ারা এখন আর একা নয়। বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করলেও এরা ধীরে ধীরে সংগঠিত হচ্ছে। দেশের কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা এদের সংগঠিত করছে মূলত স্বাস্থ্য সচেতন করে তুলতে। এইডস ঝুঁকি থেকে সতর্ক করতেই বেসরকারি সংস্থাগুলো এদের জন্য মাঠে নেমেছে। সংগঠিত হওয়ার সুবাদে হিজড়ারা এখন প্রতিবাদ করতেও শিখেছে। এদের এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন- কর্মসংস্থান। কর্মসংস্থানের সুযোগ পেলে এরা সুস্থ জীবনে ফিরে আসতে পারে।