ডেস্ক নিউজ
সারা দেশ থেকে গত এক বছরের কিছু বেশি সময়ে জঙ্গি সংগঠনের সদস্য বা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ৪৪২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। তাঁদের মধ্যে হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের (হুজিবি) প্রথম সারির ১১ জনসহ ৪৭ জন রয়েছেন। সর্বশেষ গত ১৪ এপ্রিল ভৈরব থেকে গ্রেপ্তার হন হুজিবির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মুফতি শফিকুল ইসলাম।
শফিকুল ২১ বছর আত্মগোপনে ছিলেন।
রমনা বটমূলে বোমা হামলা মামলায় তিনি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তাঁর যাবজ্জীবন সাজা হয়। হবিগঞ্জে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলায়ও তিনি অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি।
র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে শফিকুল বলেছেন, মাঠ পর্যায়ে এখনো তাঁদের দাওয়াতি কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চলছে। অনেক নেতাকর্মী এখনো সক্রিয়। সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় আছেন তাঁরা।
গ্রেপ্তার হওয়া হুজিবির শীর্ষ পর্যায়ের বাকি নেতারা হলেন মুন্সি ইকবাল, মুফতি শফিকুল ইসলাম, আজিজুল হক রানা, শরিফুজ্জামান ওরফে মিন্টু, মুনসি ইকবাল হোসেন, শরিফুজ্জামান, মো. আতিকুল্লাহ, ইব্রাহিম খলিল, শেখ সোহান স্বাদ ওরফে আব্দুল্লাহ ও মুরাদ হোসেন কবির। ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত এঁরা সবাই সামনে থেকে হুজিবিকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন।
দেশ থেকে জঙ্গিগোষ্ঠী নির্মূলে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কাজ করছে র?্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটলিয়ন (র?্যাব), ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট ও পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ)। ২০২১ সালে র্যাবের হাতে ২৮৫ জঙ্গি, সিটিটিসির হাতে ১০৪ জঙ্গি এবং এটিইউর হাতে ৫৬ জঙ্গি গ্রেপ্তার হয়।
হুজিবি আবার সংগঠিত হচ্ছে জানিয়ে এক শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ১৭ বছর আগে নিষিদ্ধ করা হয়েছে হুজিবিকে। বর্তমানে তাদের বেশির ভাগ নেতা কারাগারে। এর পরও বহুল আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার নেপথ্যে থাকা হুজিবির তৎপরতা থেমে নেই। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের হত্যার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়ও হামলার পরিকল্পনা থেকে বেরিয়ে আসেনি তারা। শুধু মাঠ পর্যায়েই নয়, অনলাইন প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে জঙ্গি ও উগ্রবাদী তৎপরতা চালাচ্ছেন এর সদস্যরা।
গোয়েন্দা সূত্রের দাবি, গ্রেপ্তার না হওয়া অন্তত ১৬ জন শীর্ষ পর্যায়ের নেতা নতুন করে হুজিবি পুনর্গঠন, পূর্ণাঙ্গ শুরা কমিটি করা, তহবিল, নতুন সদস্য, অস্ত্র ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম সংগ্রহ, কারাগারে আটক সদস্যদের জামিনের ব্যবস্থা করা, বান্দরবান-নাইক্ষ্যংছড়ির পাহাড়ি এলাকাসহ দুর্গম চর এলাকায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন।
সদস্য করা বা সংগঠনের কাজে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে উত্তরাঞ্চলে ২৬টি পরিবারকে হুজিবি আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে আসছে বলেও তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। হুজিবির একটি বড় অংশ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এনজিওভিত্তিক কাজও করছে।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও সিটিটিসিপ্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, হুজিবির মাধ্যমে দেশে জঙ্গি তৎপরতার শুরু। মূলত ১৯৯২ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত হুজিবির বিস্তার ছিল ব্যাপক। বর্তমানে তাদের কর্মকাণ্ড কিছুটা স্তিমিত, তবে থেমে নেই। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে।
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা বলেছেন হুজিবি এখনো সংগঠিত
গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর হুজিবির রাজশাহী ও খুলনা অঞ্চলের আঞ্চলিক কমান্ডার মুফতি ইব্রাহিম খলিল ও হুজিবির সমন্বয়কারী আব্দুল আজিজ নোমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। ইব্রাহিম খলিল দুবাই ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে অর্থ এনে হুজিবিকে গতিশীল করতে তৎপর ছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে রাজশাহী এলাকার আরো কয়েকজন হুজিবি সদস্যের নাম পেয়েছে স্থানীয় পুলিশ। কিন্তু তাঁরা এখনো গ্রেপ্তার হয়নি।
গত ১১ মার্চ ঢাকার সাভারের রাজাশন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় হুজিবির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা মুন্সি ইকবাল আহমেদকে। তিনি হুজিবির সাবেক প্রধান মুফতি হান্নানের ভাই। ধরা পড়ার আগে তিনি হুজিবির মাঠ পর্যায়ের সদস্যদের সংগঠিত করছিলেন। পাশাপাশি নিষিদ্ধঘোষিত অন্য জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের অন্যতম সংগঠক হিসেবেও দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে র্যাব-৪-এর পরিচালক অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক বলেন, হুজিবির অর্ধশতাধিক মাঠকর্মী ইকবাল নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাঁরা যেকোনো সময় সক্রিয় হতে পারেন। তাঁদের ধরার চেষ্টা চলছে।
গত ১৭ এপ্রিল রাজধানীর খিলক্ষেত বাজার মসজিদের সামনে থেকে হুজিবি নেতা আজিজুল হক রানা ওরফে শাহনেওয়াজ ওরফে রুমানকে গ্রেপ্তার করে ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)। তিনি ২০০০ সালে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা ও বোমা বিস্ফোরণের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। গ্রেপ্তার এড়াতে দীর্ঘ ২১ বছর বিভিন্ন ছদ্মবেশে আত্মগোপনে থেকে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে আসছিলেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ হুজিবির বোমা তৈরির কারিগর মো. ইউসুফ ওরফে মোসহাব, মেহেদী হাসান ওরফে আ. ওয়াদুদ, ওয়াসিম আক্তার ওরফে তারেক হোসেন, মো. মহিবুল ওরফে মফিজুর রহমান, শেখ মো. এনামুল হক, আনিসুল ইসলাম ওরফে আনিসসহ আরো কয়েকজন এখনো ধরা পড়েননি বলে জানিয়েছেন অভিযানে নিয়োজিত কর্মকর্তারা।
গত ৫ মার্চ রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার সায়েদাবাদ এলাকা থেকে হুজিবি নেতা মাইনুল ইসলাম ওরফে মাহিন ওরফে মিঠু ওরফে হাসান ও তাঁর সহযোগী শেখ সোহান স্বাদ ওরফে আব্দুল্লাহ ও মুরাদ হোসেন কবিরকে গ্রেপ্তার করে সিটিটিসি।
গত ১০ মার্চ রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে হুজিবির সংগঠক শরিফুজ্জামান মিন্টুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট। তিনি ২০১৩ সালে তুরাগ থানায় বিস্ফোরক দ্রব্যাদি আইনের মামলায় ১০ বছর ছয় মাস সাজাপ্রাপ্ত আসামি। তাঁকে ধরার আগে রাজধানীর তুরাগের আশুলিয়া বাইপাইল রোডে অভিযান চালিয়ে হুজিবির সংগঠক খলিলুর রহমান শাহরিয়ার, আ. কাদের মুয়াক্ষের, শরিফুজ্জামান মিন্টু ওরফে ওবায়দুল্লাহ মাহি শরিফ ও মাকছুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সিন্টুর বিষয়ে অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের মিডিয়া অ্যান্ড অ্যাওয়্যারনেস শাখার পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ আসলাম খান বলেন, গ্রেপ্তারকৃতরা সবাই হুজিবিকে সংগঠিত করছিলেন। এরই মধ্যে তাঁরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় নতুন সদস্য সংগ্রহের কথা স্বীকার করেছেন।
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত পলাতক আসামি ইকবাল হোসেনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তিনি জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নানের নির্দেশে ২১ আগস্টে আওয়ামী লীগের সমাবেশ মঞ্চে গ্রেনেড ছুড়েছিলেন। ঝিনাইদহের এই ইকবাল একসময় ছাত্রদল করতেন। পরে জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদে (হুজি) জড়িয়ে পড়েন। ২০০৮ সালে তিনি বিদেশে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ২০২০ সালের শেষ দিকে তিনি দেশে ফিরে ফের হুজিবিকে সংগঠিত করার চেষ্টা করছিলেন।
গত ৪ মার্চ রাজধানীর সায়েদাবাদ এলাকা থেকে হুজিবির অপারেশন শাখার প্রধান মাইনুল ইসলাম ওরফে মাহিনসহ তিন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে দুই দফা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে পাহাড়ে মাদরাসার আড়ালে হুজিবির প্রশিক্ষণশিবিরের অস্তিত্ব পায় সিটিটিসি। পরে ওই মাদরাসা থেকে ২৪ শিশুকে উদ্ধার করে সিটিটিসি। শিশুদের তাদের অভিভাবকদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
পাহাড়ি এলাকার অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের এসব শিশুকে টাকা-পয়সার বিনিময়ে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল বলেও তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানতে পেরেছেন। ইজারা নেওয়া জমিতে মাদরাসা স্থাপন করে তারা এই কর্মকাণ্ড চালাচ্ছিল।
গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, ওই মাদরাসার কয়েকটি নথি থেকে ৪০ জনের নাম পাওয়া যায়। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন নতুন করে হুজিবিতে যোগ দেন। এঁদের অনেকেই মাদরাসায় তহবিলও দিয়েছেন। পাহাড়ে তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।