কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল ও চায়না ইকোনমিক জোন ঘিরে বদলে যাওয়া দক্ষিণ চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও আসছে বড় পরিবর্তন। চট্টগ্রামের শিকলবাহা ওয়াই জংশন থেকে আনোয়ারা কালা বিবির দীঘি পর্যন্ত সাড়ে ১১ কিলোমিটারের একটি সংযোগ সড়কের মাধ্যমে ঢাকা-কক্সবাজারের দূরত্ব ৫০ কিলোমিটার কমিয়ে আনার চিন্তা চলছে। নিরাপদ, দ্রুত, সময় ও ব্যয় সাশ্রয়ী সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনে কর্ণফুলী টানেল সংযোগ সড়ক নামে এই প্রকল্পের দরপত্র আহবান হচ্ছে ১০ সেপ্টেম্বর। ২০২২ সালের জুনের মধ্যে শেষ হবে প্রকল্পের কাজ।
পরিকল্পনাধীন এই প্রকল্পে ৪০৭ কোটি টাকা ব্যয়ে আনোয়ারা উপজেলা সংযোগ সড়কসহ কর্ণফুলী টানেল সংযোগ সড়ককে ছয় লেনে উন্নীত করা হবে। এছাড়া টানেল হয়ে আনোয়ারা-বাঁশখালী-পেকুয়া হয়ে কক্সবাজার সদর পর্যন্ত কক্সবাজার বিকল্প সড়ক নামে আরো একটি সড়ক প্রকল্পের ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোফাইল (ডিপিপি) তৈরি করা হয়েছে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) সূত্র বলছে, কর্ণফুলী টানেল চালু হলে প্রথম বছরেই ৬৩ লাখ গাড়ি টানেলের ভেতর দিয়ে চলাচল করবে। এই চাপ সামলাতে হবে সংযোগ সড়ক গুলোকে। শিকলবাহা-আনোয়ারা সড়কটি সরাসরি কোন বিভাগীয় সদরকে সংযুক্ত না করলেও অর্থনৈতিক গুরত্ব বিবেচনায় এটি বিশেষ প্রাধান্য পাচ্ছে। একটি জাতীয় মহাসড়ক, একটি আঞ্চলিক সড়ক ও কর্ণফুলী টানেল হয়ে এটি চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে যুক্ত হবে। পাশাপাশি ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের মাধ্যমে মাতারবাড়ি পাওয়ার হাব, মহেশখালী গভীর সমুদ্র বন্দর ও টেকনাফ স্থল বন্দরের সঙ্গে যুক্ত হবে। কর্ণফুলী টানেল হয়ে যে সড়ক কক্সবাজার যাবে তা কোনো একসময় মিয়ানমার হয়ে প্রসারিত হবে চীনের কুনমিং সিটি পর্যন্ত। মহাপরিকল্পনার আওতায় চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে বিদ্যুৎ হাব। মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে হচ্ছে এলএনজি টার্মিনাল। তাই চট্টগ্রাম হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বার খুলে দেওয়ার যে স্বপ্ন সরকার দেখছে সেটি অন্যতম সংযোগ হয়ে উঠবে সাড়ে ১১ কিলোমিটারের বিকল্প সড়কটি।
সওজের দোহাজারী সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সুমন সিংহ জানান, শিকলবাহা-আনোয়ারা সড়কটি হবে ৬ লেন। এটি টানেল সড়কের সংযোগ সড়ক হিসাবে ব্যবহৃত হবে। শিকলবাহা-আনোয়ারা সড়ক বলা হলেও এটি হবে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-কক্সবাজার সড়কের হাব (সংযোগস্থল)। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ৪০৭ কোটি টাকা। সড়কটি ১৬০ ফুট প্রশস্ত হবে, মাঝখানে ডিভাইডার থাকবে। এর মধ্যে জমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। তবে রাস্তার দুই পাশের জমির মালিক সওজ কর্তৃপক্ষ হওয়াতে খুব বেশি জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন পড়ছে না। ১০ সেপ্টেম্বর দরপত্র গ্রহণ করা হয়েছে। অন্যান্য প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ৩ মাসের মধ্যে কাজ শুরু করা যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, সড়কটি নির্মিত হলে টানেল কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিশাল পরিবর্তনের পাশাপাশি চট্টগ্রাম কক্সবাজার দূরত্ব কমবে ৩৫ কিলোমিটার আর ঢাকা কক্সবাজার দূরত্ব কমবে ৫০ কিলোমিটার। বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের দূরত্ব প্রায় ৪৪৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রামের দূরত্ব ৩০০ কিলোমিটার এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের দূরত্ব ১৫০ কিলোমিটার। বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ হলে ঢাকার যানবাহনগুলো ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট হয়ে বন্দর টোল রোড-নির্মাণাধীন আউটার রিং রোড-পতেঙ্গা হয়ে কর্ণফুলী টানেল ব্যবহার করলে পথ কমবে প্রায় ১৫ কিলোমিটার। তাছাড়া কর্ণফুলী টানেল হয়ে আনোয়ারা উপজেলার সিইউএফএল ঘাট-চাতরি চৌমুহনী-বাঁশখালী-পেকুয়ার মগনামা হয়ে সরাসরি কক্সবাজার সদরে যুক্ত হতে সড়ক কমবে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। দুই দিকে দূরত্ব কমবে প্রায় ৫০ কিলোমিটার সড়ক।
বর্তমানে টানেল ঘিরে দক্ষিণ চট্টগ্রামে চলছে বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ। টানেল প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। যা চট্টগ্রাম প্রান্তের নেভাল একাডেমি থেকে শুরু হয়ে সড়কের কালাবিবি দীঘি নামক স্থানের কাছে মিলিত হবে। টানেলের কাজ শেষ হলে ঢাকা থেকে কক্সবাজারমুখি ৯০ শতাংশ গাড়ি চলাচল করবে কর্ণফুলী টানেল হয়ে। সবমিলিয়ে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ স্বপ্নের কাছাকাছি দক্ষিণ চট্টগ্রাম। কিন্তু এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সড়কের উপর যে চাপ পড়বে তা সামাল দিকে সড়ক উন্নয়ন কাজে হাত দিতে যাচ্ছে এ মাসেই।
সড়কটির পশ্চিম পাশে কোরিয়া রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা এবং ৭৮১ একর জায়গার উপর বাস্তবায়নাধীন চায়না ইকোনমিক জোন, ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ইউনিট-১, ইউনিট-২, মেরিন একাডেমিসহ অসংখ্য গার্মেন্টস ও শিল্প কারখানা অবস্থিত। চায়না ইকোনমিক জোন প্রকল্পের জন্য রাস্তাঘাট এবং ইউটিলিটির জন্য ২৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করা হচ্ছে। তাছাড়া ১৫টি বিদেশি কোম্পানি ইতোমধ্যে এখানে বিনিয়োগের জন্য আগ্রহ দেখিয়েছে । বর্তমানে সড়কটি দিয়ে প্রতিদিন এসব শিল্প কারখানার কর্মকর্তা কর্মচারীসহ পটিয়া, কর্ণফুলী, আনোয়ারা-বাঁশখালী ও কক্সবাজার জেলার জনসাধারণ চলাচল করে থাকেন। কিন্তু পিএবি (পটিয়া-আনোয়ারা-বাঁশখালী) সড়কে বড় যানবাহন চলাচলের সক্ষমতা না থাকায় বিষয়টি নিয়ে সরকার আগেভাগে ভাবনা-চিন্তা শুরু করে।
এদিকে শিকলবাহা-আনোয়ারা সংযোগ সড়কটি প্রকল্প বাস্তবায়নে পিএবি সড়কের দুই পাশে কাটা পড়বে প্রায় ১৭০০ গাছ । প্রায় ২৫ বছর আগে লাগানো এসব গাছ এতদিন ক্ষয়রোধ ছাড়া সড়কের সৌন্দর্যবর্ধনে বড় ভূমিকা রেখেছিল। গাছগুলো কেটে ফেলার জন্য সওজ থেকে বৃক্ষপালন বিভাগের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে গাছগুলোর মার্কিং সম্পন্ন হয়েছে।
আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ জোবায়ের আহমদ বলেন, টানেল সংযোগ সড়ক নির্মাণে জোরালো প্রস্তুতি চলছে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের অন্যতম চাতরী চৌমুহনী বাজারের মাঝখান দিয়ে সড়কটি যাবে। পর্যাপ্ত জমি অধিগ্রহণ থাকায় বাজার সরানোর প্রয়োজন পড়বে না। ঝামেলা ছাড়াই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা যাবে।