স্বপ্না রানী শীল। নাটোর সদর উপজেলার ছাতনী ইউনিয়নের মাঝদিঘা হিন্দুপাড়ার দিনমজুর তপন কুমার শীলের এক মাত্র মেয়ে। গ্রামের নরসুন্দর সম্প্রদায়ের দিনমজুরের পরিবারে সুন্দর ফুটফুটে একটি মেয়ে। এরপরও সে লেখাপড়ায় বেশ মনোযোগী। পিইসি পরীক্ষায় ভালো ফল পাওয়ায় তাকে গ্রামের মির্জাপুরদীঘা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করনো হয়। সেখানেও জেএসসি পরীক্ষায় তার ফলাফলও বেশ ভালো। মেয়ের এমন পাড়াশুনার আগ্রহ এবং ইচ্ছায় মেয়েকে নিয়মিত স্কুলে পাঠানো শুরু করেন তার পরিবার। এরই মাঝে স্কুলে যাতায়াত করা অবস্থায় স্বপ্না শীলের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার।
একই গ্রামের আব্দুল জব্বারের বখাটে ছেলে মজনুর কুনজরে পড়ে যায় স্বপ্না শীল। প্রথম দিকে স্বপ্না সেগুলো সহ্য করলেও পরে তা পরিবারের সকলকে জানিয়ে দেয়। কিন্তু গ্রামের দরিদ্র দিনমজুর বাবা তার মেয়েকেই বুঝিয়ে শুনিয়ে রাখে তারা গ্রামের ক্ষমতাধর ব্যক্তি । এদর বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে তাদের গ্রাম ছাড়া হতে হবে। গ্রাম ছাড়া হওয়ার ভয়ে স্বপ্না মজনুর সকল অত্যাচার সহ্য করে আসছিল। এভাবে বেশ কিছু দিন কাটার পর রাস্তায় চলাচলের সময় মজনুর অত্যাচার বেড়ে যায়। তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি ধামকিসহ বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখাতে শুরু করে। এবার আর সহ্য করতে না পেরে স্বপ্না তার বাবা ও মাকে জানায় বিষয়গুলো। বাবা ও মা বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে আলোচনা করেন। সেই সাথে মজনুর ভয়ে স্বপ্নার স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয় তার পরিবার। এরপর স্বপ্নার বাবা ঘটনাটি মজনুর পরিবারকে জানায়। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে যায় মজনু। মজনু নিয়মিত স্বপ্না সহ তার পরিবারের সদস্যদের হুমকি ধামকি দিতে শুরু করে। এনিয়ে দুই পরিবারের মাঝে প্রায় ঝগড়া বিবাদ হতে থাকে। এরপর বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছে মজনুর বিচার চেয়ে অভিযোগ করেন তপন কুমার শীল।
এরপর বিষয়টি নিয়ে গ্রাম্য সালিশ বসে। সালিশে উভয় পক্ষের কথা শুনে মজনু শেখের বাবা আব্দুল জব্বারকে নিজের ছেলেকে সংযত হওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। সেই সাথে আগামীতে আর কোন দিন গ্রামের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোন মেয়েকে যেন বিরক্ত না করে সেজন্য তাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার করিয়ে নেওয়া হয়। এরপর স্বপ্নাকে পুনরায় স্কুলে পাঠানো হয়। কিন্তু এতো কিছুর পরও মজনু পিছু ছাড়েনি স্বপ্নার। শুরু করে আবারো বিরক্ত করা সহ বিভিন্ন ভাবে ভয় দেখানো। ফলে স্বপ্নার বাবা তপন শীল মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয় পুনরায়। এভাবেই কেটে যায় আরো দুইটি বছর। এরপর গ্রামের মানুষদের কথায় তাল মিলিয়ে মেয়ের বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নেয় তপন শীল। এবার স্বপ্নার বয়স ১৮ হলে তার পরিবারের পক্ষ থেকে তার বিয়ে ঠিক করা হয়। গত ৩০ জানুয়ারি নাটোরের সিংড়া উপজেলার চকপুর গ্রামের আনন্দ সরকারের ছেলে সুজন সরকারে সাথে সনাতন রীতিতে দুটি পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে দেওয়া হয় স্বপ্নার।
স্বপ্না বিয়ে কোন ভাবেই মেনে নিতে পারেনি মজনু শেখ। সে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে এবং স্বপ্নাকে তার শ্বশুড় বাড়ী থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসার হুমকি দেয়। সে আরও প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে উঠে। মজনু বিভিন্ন সময়ে স্বপ্নার শশুড়বাড়ী সিংড়ার চকপুর এলাকায় গিয়েও স্বপ্নাকে ভয়ভীতি দেখানো সহ অশ্লীল গালিগালাজ করে আসতো। এভাবেই চলছিল তাদের জীবন। এরই মধ্যে গত ২২ ফেব্রুয়ারি স্বপ্না তার বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসে। বখাটে মজনুও সুযোগ পেয়ে যায়। একদিন ২৭ ফেব্রুয়ারি ওই এলাকায় মন্দিরে নাম কীত্তন চলকালীন সময়ে স্বপ্না বাড়ী ফেরার পথে বন্ধুদের সহযোগীতায় মজনু শেখ স্বপ্নাকে অপহরন করে নিয়ে যায়। এরপর থেকে এখনো স্বপ্নার কোন খোঁজ নাই। ঘটনার রাতেই স্বপ্নার বাবা ও মা নাটোর সদর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে বিষয়টি জানিয়ে মামলা করতে চাইলে তারা নিজেদের খোঁজাখুজি করতে বলেন। এরপর থেকে পুলিশ প্রশাসনসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গন্যমান্য ব্যক্তিদের কাছে ধরনা দিয়ে আসছেন। কিন্তু কোন ভাবেই মেয়েকে ফিরে পাননি তারা। পরে বাধ্য হয়ে ০২ মার্চ নাটোরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বখাটে মজনু শেখকে প্রধান আাসমীসহ মোট ৭ জনের নামে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ০৭/৩০ ধারায় একটি অপহরণ মামলা করেন। পরবর্তীতে নাটোরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারক মোস্তফা কামাল মোকদ্দমাটি এফ আই আর হিসাবে গ্রহন করার জন্য নাটোর সদর থানাকে নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ঘটনার অধিকতর তদন্তের জন্য থানার উপ পরিদর্শক (এসআই) নজরুল ইসলামকে দ্বায়িত্ব দেন।
স্বপ্নার বাবা তপন কুমার শীল বলেন, তিনি এখন আর কারো নামে অভিযোগ করবেন না। তিনি শুধু তার মেয়েকে ফিরে পেতে চান। তিনি জানতেন এখানে তাদের জন্য কোন ন্যায় বিচার নাই। দিনের পর দিন তার মেয়েকে সহ তাদের পরিবারের ওপর অণ্যায় অত্যার করলো ওই ছেলে তার বিচার চেয়েও কোন বিচার হল না। তার মেয়ের পড়াশুনা বন্ধ করে বিয়ে দিয়ে দিলেন তবুও মজনুর কুনজর থেকে রক্ষা হলো না। তারা সংখ্যালঘু সেজন্য তারা কোন বিচার পাবেন না। পুলিশের এসআই নজরুল স্যারের কাছে কতবার গেলাম কিন্তু সেও কোন কথা শোনে না। প্রতিবার তাকে ফিরিয়ে দেয় আর বলে অন্য সময় আসেন। এভাবে প্রতিদিন নজরুল পুলিশের কাছে ঘুড়ে ঘুড়ে এখন তিনি হাল ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি মনে করেন মজনুর বাবা ক্ষমতাধর মানুষ ও তাদের অরেক টাকা রয়েছে সেকারনে পুলিশ সহ কেই তার কোন কথা শুনছেন না। তিনি বলেন তার মেয়েকে ফিরত দিলে তিনি স্বপরিবারে গ্রাম ছেড়ে চলে যাবেন অন্য কোথাও তবুও তার মেয়েকে ফিরিয়ে দেওয়া হোক। তিনি সহ তার পরিবারের সকলের মনে হচ্ছে তার মেয়েকে হয়তো অপহরন করে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তিনি ঘটনার একটি সঠিক তদন্ত করার দাবী জানান।
এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সদর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) নজরুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, মামলায় এজাহারভুক্ত ৭ জন আসামীর মধ্যে ৬ জন আদালতে আত্নসমর্পন করে জামিনের প্রার্থনা করেন। আদালতের বিচারক তাদের মধ্যে থেকে ৩ জন নারী আসামীর জামিন মঞ্জুর করেন। অপর তিন আসামীকে কোট ওয়ারেন্টে জেল হাজতে প্রেরন করা হয়। বর্তমানে মুল আসামীকে গ্রেফতারের জন্য তার মোবাইল (০১৭৩৪২৮৭৬৪১) নম্বার অনুসন্ধানের কাজ চলছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে মুল আসামীকে ধরার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।