কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে এবং ভোক্তাদের বিষমুক্ত ভাল পণ্য দিতে দেশের ৬৪ জেলায় গড়ে উঠছে কৃষকের বাজার। রাজধানী মানিক মিয়া এভিনিউর মতো সপ্তাহে নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট স্থানের এসব বাজারে শতভাগ নিরাপদ বিষমুক্ত কৃষিপণ্য পাবেন মানুষ। এসব বাজারে সরাসরি কৃষক বিক্রি করবে এজন্য দিতে হবে না কোন ধরনের টোল। প্রয়োজনে কৃষকের বাড়ি থেকে পণ্য বাজারে নিয়ে আসতে পরিবহন সহায়তা দেবে সরকার। ইতোমধ্যেই ৪৫ জেলায় গড়ে উঠেছে কৃষকের বাজার। দ্রুতই বাকিগুলোর কাজও শেষ হবে।
ইতোমধ্যেই রাজধানীবাসীর কাছে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে কৃষকের বাজার। প্রতি সপ্তাহে শুক্র ও শনিবার দুইদিন এই হাট বসে রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউতে অবস্থিত সেচ ভবনে।
যেখানে সপ্তাহে দুই দিন লাখ টাকার উপরে কৃষিপণ্য বিক্রি করেন কৃষকরা। আশপাশ জেলায় যারা সার বিষমুক্তভাবে শাকসবজি উৎপাদন করে তাদের পণ্য পরিবহন দিয়ে নিয়ে আসে কৃষি বিপণন অধিদফতর। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে কৃষি বিপণন অধিদফতর নিয়মিত বাজার দেখাশুনা করছেন। প্রতি সপ্তাহের এই বাজারে অর্গানিক বিভিন্ন সবজি নিয়ে এ বাজারে অংশগ্রহণ করেছেন কৃষকরা। অধিক জনপ্রিয়তার কারণে একদিকে বাড়ছে ক্রেতার সংখ্যা আবার বাড়ছে বিক্রিও।
রাজধানীর আদলে সারাদেশে কৃষক বাজার করার উদ্যোগ নেয়া হয়। কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি বিপণন অধিদফতর থেকে আরও জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে অস্থায়ী ভিত্তিতে এসব বাজার স্থাপন করে চালু হচ্ছে। এরপর হালকা অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে। পরবর্তী সময়ে স্থায়ী রূপ পাবে এসব বাজার। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তদারকির মাধ্যমে নিরাপদ সবজিসহ কৃষিপণ্য উৎপাদনে নজর দিচ্ছে সরকার। কৃষকের বাজারে নিরাপদ কৃষিপণ্য বিক্রির বিষয়েও জোর দেয়া হচ্ছে।
এর আগে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক জনকণ্ঠকে বলেন, শুধু জেলা পর্যায়েই নয় আমরা এটিকে এক সময় উপজেলা পর্যায়ে নিয়ে যাব। মানুষের মধ্যে একটি সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং এটির আগ্রহ বাড়ানোর জন্য। যাতে মানুষ সচেতন হয়। নিরাপদ খাদ্যের ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করতে হবে। যারা যত্ন নিয়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করবে তারা অবশ্যই দামও ভাল পাবে। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের সঠিক দাম পাক সেটি চাই।
কৃষি মন্ত্রণালয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশের সব জেলায় গড়ে উঠবে কৃষকের বাজার। এটা হবে নিরাপদ কৃষিপণ্যের মার্কেট। মার্কেট করার জন্য জায়গা দরকার। মন্ত্রণালয়েল উধর্তন এক কর্মকর্তা বলেন, দেখা গেল সিটি কর্পোরেশনের কাছ থেকে জায়গা নিলাম, কদিন পর তারা এসে সেখান থেকে টোল আদায় করল। তাহলে সেটা আর ফার্মার্স মার্কেট থাকবে না। তখন সেটা অন্যান্য মার্কেটের মতো হয়ে যাবে। আমরা এমন কিছু করতে চাই না। আমরা চাই কৃষকদের জন্য একটি মার্কেট। জানা গেছে, নিরাপদ কৃষিপণ্য উৎপাদনের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় প্রত্যেক উপজেলায় দুটি করে গ্রাম নির্বাচন করেছে। নিরাপদ সবজি চাষ হচ্ছে কি-না, সেটা কৃষি অফিসার মনিটরিং করে থাকেন। ফসল রোপণ থেকে শুরু করে কাটা পর্যন্ত মনিটরিং হয়।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব নাসিরুজ্জামান এর আগে জানিয়েছেন, আমি সচিব থাকা অবস্থায় রাজধানীতে কৃষকের বাজার চালু হয়। সাধারণত কৃষকদের কাছ থেকে পাইকাররা পণ্য নিয়ে যান। কিন্তু কৃষকের বাজার হলে চাষীরা জেলাপর্যায়ে নিজেই পণ্য নিয়ে সরাসরি বিক্রি করতে পারবেন। তাকে কোন ধরনের টোল দিতে হবে না। আমরা সেফ ফুড মার্কেট করতে চাচ্ছি এজন্য যে, সবজি সরাসরি এসে আমাদের রান্না ঘরে ঢোকে। সেচ ভবনে আমরা যে নিরাপদ সবজি বাজার করেছি, এখানে কী কী ত্রুটি ছিল তা চিহ্নিত করছি। এভাবে আমরা সারাদেশে মার্কেট গড়ে তুলার উদ্যোগ নেয়া হয়।
জানা গেছে, সবজি চাষে রাসায়নিক সার প্রয়োগ ও পোকামাকড় দমনে কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। তাছাড়া অধিক মুনাফার জন্য সবজির মাঠে কীটনাশক প্রয়োগ করে অল্প সময়ের মধ্যে সবজি সংগ্রহ করে বিক্রি করা হয়ে থাকে। সঠিক সময়ে কীটনাশক প্রয়োগ ও প্রয়োগমাত্রা সম্পর্কে ধারণা না থাকায় নিরাপদ সবজি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকারক উপাদান মানুষের দেহে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টির কারণ। জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার, সঠিকমাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগ, উপযুক্ত সময় ও নির্ধারিত মাত্রায় কীটনাশকের ব্যবহার এবং সঠিক সময়ে সবজি সংগ্রহের মাধ্যমে নিরাপদ সবজি উৎপাদনের গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। তাই বছরব্যাপী নিরাপদ সবজি উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টির চাহিদা পূরণে সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে।
গত বছরের ৬ ডিসেম্বর সংসদ ভবনের সামনের এই কৃষকের বাজার উদ্বোধন করেছিলেন কৃষিমন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক। সাভার, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করেন রাজধানীর এই বাজারে। এই বাজারে দুটি লাভ- এক, কৃষক সরাসরি অর্থ পাচ্ছে। আরেকটি, আমরা ক্রেতারা ভাল সবজির নিশ্চয়তা পাচ্ছি। বাজার উদ্বোধন করে কৃষিমন্ত্রী বলেন, এই কৃষকের বাজারে যে কৃষকরা অংশগ্রহণ করেছেন তাদের আমরা এক বছর ধরে প্রস্তুত করেছি। সম্পূর্ণরূপে কীটনাশকমুক্ত সবজি এখানে নিয়ে আসছেন তারা। স্বল্প পরিসরে হলেও এটি অব্যাহত থাকবে এবং ভবিষ্যতে এটি বৃহৎ পরিসরে করার উদ্যোগ আমরা নেব।
সেই ধারাবাহিকতায় এবার জেলায় জেলায় ছড়িয়ে যাচ্ছে কৃষক বাজার। এতে করে জেলার মানুষও নিরাপদ সবজি পাবে। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তদারকির মাধ্যমে নিরাপদ সবজিসহ কৃষিপণ্য উৎপাদনে নজর দিচ্ছে সরকার। কৃষকের বাজারে নিরাপদ কৃষিপণ্য বিক্রির বিষয়েও জোর দেয়া হচ্ছে।
কৃষি বিপণন অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ বলেছেন, আপাতত অস্থায়ীভিত্তিতে কৃষকের বাজার স্থাপন করতে যাচ্ছি। পরবর্তী সময়ে আমরা এর স্থায়ী রূপ দেব। এজন্য ২০০ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প নেয়া হবে। এভাবেই আমরা এগোচ্ছি। এছাড়া ঢাকায় মানিক মিয়া এভিনিউকে এফএও-এর (জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা) সহায়তায় কেন্দ্রীয়ভাবে কৃষকের বাজার করব আমরা। কৃষক বাজারে এসে কৃষক তার পণ্য ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে পারবেন। ভোক্তা সঠিক দামে নিরাপদ পণ্যটি কিনে নিতে পারবেন। এই উদ্দেশ্যেই কৃষকের বাজার প্রতিষ্ঠা করা। কৃষি বিপণন অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, প্রত্যেক জেলায় কৃষক বাজার গড়ে তুলতে জেলা প্রশাসকদের চিঠি দেয়া হয় গত ৭ মে করোনাকালীন সময়ের মধ্যেই। একই চিঠি দেয়া হয় কৃষি সম্প্রাসারণ অধিদফতরকেও। তারই ধারাবাহিকতায় কাজ এগিয়ে ইতোমধ্যেই অধিকাংশ জেলায় গড়ে উঠেছে এই কৃষক বাজার। যেখানে সপ্তাহে নির্দিষ্ট দিনে কৃষকরা তাদের পণ্য সরাসরি বিক্রি করছেন। কৃষি বিপণন অধিদফতরের সর্বশেষ নবেম্বর মাসের তথ্য অনুযায়ী এরই মধ্যে ঢাকা বিভাগের মধ্যে রাজধানীর সেচ ভবনসহ ১ জেলায় স্থাপন করা হয়েছে। ময়মনসিংহ বিভাগে দুই জেলায়, চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলায়, রাজশাহী বিভাগের ৭ জেলা, খুলনা বিভাগের ৮ জেলা, রংপুর বিভাগের ৬ জেলা এবং সিলেট বিভাগের এক জেলায় গড়ে উঠেছে এই বাজার।
রাজধানীর বাজারে আগ্রহ ক্রেতাদেরঃ এদিকে গত বছরের ৬ ডিসেম্বর সংসদ ভবনের সামনের এই কৃষকের বাজার উদ্বোধন হয়। সেই থেকে দিন যত গড়িয়েছে ক্রেতার সংখ্যা যেমন বেড়েছ সেই সঙ্গে বিক্রিও বাড়ছে বিক্রেতাদের। মাঝে করোনার আঘাত থাকলেও বাজার বন্ধ হয়নি। সাভার, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি বিক্রি করেন রাজধানীর এই বাজারে। প্রতি শুক্র ও শনিবার লাখ টাকার উপরে বিক্রি হচ্ছে কৃষিপণ্য। সপ্তাহে দু’দিন করে বাজার অনুষ্ঠিত হলেও গত এক বছরে এই বাজার থেকে বিক্রি হয়েছে এক কোটি টাকারও বেশি কৃষিপণ্য। বিপণন অধিদফতরের তথ্যে জানা গেছে, সর্বশেষ গত ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজধানীর কৃষক বাজারে মোট বিক্রি হয়েছে ১ কোটি ১৬ লাখ ১১ হাজার ২৫০ টাকা। শুরুর পর থেকে এক বছরের মধ্যে গত ১৩ নবেম্বর একদিনের বিক্রিতে রেকর্ড করে। ওইদিন ৩ লাখ টাকার উপরে বিক্রি করেন কৃষকরা। কৃষি বিপণন অধিদফতরের সহকারী পরিচালক তৌহিদ মোঃ রাশেদ খান বলেন, আমাদের করোনার মধ্যেও বাজার চালু কিছু যদিও ক্রেতা কিছুটা কম হয়েছে। তবে এই কৃষক বাজারের প্রতি মানুষের চাহিদা দিন দিন বেড়েছে। রাশেদ খান আরও বলেন, যদিও আমাদের তালিকাভুক্ত কৃষক সংখ্যা ১৫ জন এছাড়াও গৃহ পর্যায়ে কৃষিপণ্য পক্রিয়াজাত করেন এমন উদ্যোক্তাদেরও সম্পৃক্ত করা হয়েছে।