নাটোর প্রতিনিধি:
বাবার মৃত্যুর পর ৩৫ বছর ধরে একাকিত্ব কুরে কুরে খাচ্ছে নাটোরের বাগাতিপাড়ার আনূরা বেগমকে। রক্তের সম্পর্কের কেউ বেঁচে নেই। কর্ম ক্ষমতাহীন বৃদ্ধ এই নারীর দিন চলে অর্ধাহারে অনাহারে। সম্মানহাণীর ভয়ে ভিক্ষাও করেননা। বিয়ের এক মাসের মাথায় জীবনের প্রথম সংসার ভেঙ্গে যাওয়ায় অভিমানে দ্বিতীয় বিয়েও করেননি। এখন জীবন যুদ্ধে আর পেরে উঠছেন না। উপার্জন নেই, নেই খাবার কেনার অর্থ, রাতে প্রদীপ জ্বালানোর তেল কেনারও টাকা নেই। তাই ৩৫ ধরে অন্ধকারেই বসবাস আনূরা বেগমের। জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে অসহায় এই বৃদ্ধার কপালে জোটেনি কোন সরকারী ভাতা। তিনি উপজেলার জামনগর ইউনিয়নের দেবনগর গ্রামের মৃত ময়েন উদ্দিনের মেয়ে।
সম্প্রতি কথা হয় তার সাথে। তিনি জানালেন তার দুঃখ ভরা জীবনের গল্প। চৌদ্দ বছর বয়সে পার্শ্ববর্তী গ্রাম রহিমানপুর টিকর পাড়ায় আদরের মেয়ে আনূরার বিয়ে দিয়েছিলেন বাবা-মা। বিয়ের এক মাসের মাথায় স্বামীর পরিবারের অমানবিক নির্যাতন সহ্য করতে না পারায় সংসার ভাঙ্গে আনূরা বেগমের। এরপর মনের ক্ষোভ আর অভিমানে ৪৬ বছর পেরোলেও আর কখনও বিয়ে করেননি। এখন তার বয়স ৬০ বছর। একে একে পৃথিবী ছেড়ে রক্তের সম্পর্কের সবাই বিদায় নিয়েছেন। গর্ভ ধারিণী মায়ের বিদায়ের পর বাবাও মারা যান ৩৫ বছর পূর্বে। এরপর থেকে একাকী জীবন সংগ্রামে কর্মক্ষমতাহীন নারী আনূরা বেগম। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া বাড়ির দুই শতাংশ জমি ছাড়া আর কিছুই নেই তার। আজ পর্যন্ত স্বামী পরিত্যক্তা-বিধবা ভাতা জোটেনি তার কপালে। আত্ম সম্মানের চিন্তায় মানুষের বাড়িতে তিনি ভিক্ষা করেন না। ছোট্ট ঝুপড়ি ঘরের বাড়িতে নেই কোন খাবার পানির ব্যবস্থা, নেই টয়লেট সুবিধা। এমনকি রাতের বেলায় আলো জ্বালেনা। এভাবে অন্ধকার ঘরে সাপ-পোকা মাকড়ের ভয়ের মধ্যেই রাত কাটে আনূরা বেগমের। বাড়িতে প্রবেশের রাস্তাটিও খুবই সরু। পাশের জমির মালিক বেড়া দেয়ায় স্বাভাবিক ভাবে হেঁটে যাওয়া যায়না। অপ্রতুল খাবার, কঠোর পরিশ্রম, ও ক্লান্ত- শ্রান্ত শরীরটা নিয়ে কোন রকমে দিনে দুই-একবার খেয়ে না খেয়ে জীবন অতিবাহিত করছেন তিনি। তবুও ভাগ্যে জোটেনি সরকারি কোন ভাতা। তিনি আরও জানান, প্রতিবেশীদের উচ্ছ্বিষ্ট খাবার খেয়েই জীবনের বেশিরভাগ খাবারের চাহিদা পুরণ করেন। তাছাড়া অন্যের জমিতে ফসল কাটার পর পড়ে থাকা এবং ইদুরের গর্ত থেকে ধান বা গমের শীষ কুড়িয়ে জমা করে তাই দিয়ে বাকিটুকুও চালিয়ে নেন। মানুষের জমিতে মুগ কালাই ও মটরের ফল উঠিয়ে যে সামান্য টাকা পাওয়া যায় তা দিয়ে সারা বছর তেল, লবন কেনেন। সামান্য টাকায় এসবের পর কেরোসিন কেনার টাকা থাকে না। তাই অন্ধকারের মধ্যেই রাত কাটিয়ে দেন। জীবন সায়াহ্নে এখন শরীরে বেঁধেছে নানা ধরনের ব্যাধি। বছর চারেক পূর্বে স্থানীয় বিপ্লব নামের এক শিক্ষকের দেওয়া এক বান টিন ও তিন হাজার টাকায় কোন রকমের একটি ঘর করেছেন। প্রতিবেশী রবিউল ইসলাম বলেন, এই দুনিয়ায় তার আপন বলতে আর কেউ নেই। দূঃখের জীবনে তারও খারাপ লাগে। তিনি আনূরা বেগমের জন্য সরকারি সহায়তার দাবি জানান। এব্যাপারে জামনগর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল কুদ্দুস বলেন, আনূরা বেগম কখনও তাকে এ বিষয়ে আবেদন জানাননি। এবারের বরাদ্দেই তাকে সরকারি ভাতার আওতায় আনা হবে বলে তিনি জানান।