ডেস্ক নিউজ
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে থাকছে বিশেষ বরাদ্দ অপ্রত্যাশিত খাতের বরাদ্দে আসছে বড় পরিবর্তন আকার হতে পারে ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা
করোনাভাইরাসের কারণে আগামী (২০২০-২১) অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাত বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। বাড়ছে এ খাতের আওতা এবং বরাদ্দ। এছাড়া বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্য, কৃষি, চিকিৎসা এবং কর্মসংস্থানের মতো খাতগুলোতে। করোনার জন্য থাকছে পৃথক বিশেষ বরাদ্দ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, করোনাভাইরাসের কোপে প্রায় সবকিছু স্থবির থাকলেও আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের কাজ চলছে পুরোদমে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ১১ জুন বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে এ বাজেট উপস্থাপন করার কথা রয়েছে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের। নতুন বাজেটের আকার হতে পারে ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার মতো। তবে শেষ মুহূর্তে এ আকার আরও বাড়তে পারে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত দশকে দারিদ্র্য হ্রাসে বাংলাদেশ যে সাফল্য দেখিয়েছে করোনাভাইরাস মহামারি সেটা ম্স্নান করে দিয়েছে। এ জন্য সরকার আসন্ন বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা ও কষি খাতে বিশেষ দৃষ্টি দেবে। এসব খাতে বরাদ্দ বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ হতে পারে।
জানা গেছে, দেশে এখন ৭৪ লাখ লোক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধা পান। এই কর্মসূচির আওতায় সরকার বিধবা ভাতা, দরিদ্র নারীদের মাতৃত্বকালীন ভাতা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসা ভাতা ইত্যাদি দিয়ে থাকে। এছাড়া টেস্ট রিলিফ, ভালনারেবল গ্রম্নপ ফিডিং (ভিজিডি), কাজের বিনিময়ে টাকাসহ (কাবিটা) বিভিন্ন কর্মসূচিও আছে। তবে বাংলাদেশের সব নাগরিক পায়, এমন কোনো সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি নেই।
অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, আগামী বাজেটের সব কিছুর সঙ্গেই করোনার প্রভাবকে বিবেচনায় রাখা হবে। অতি জরুরি খাত ছাড়া অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হবে না। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ও এরই মধ্যে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে জানিয়ে দিয়েছে, আগামী বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাত স্বাস্থ্য ও কৃষি খাত বেশি গুরুত্ব পাবে এবং তারা যেন এই দুই খাতের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলো মাথায় রেখেই প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে পাঠায়।
এদিকে, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক প্রতিবেদনে ওঠে এসেছে সামাজিক সুরক্ষা খাতে খরচের দিক থেকে বাংলাদেশ এশিয়ার নিচের দিককার পাঁচটি দেশের একটি। বাংলাদেশের পেছনে আছে শুধু মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, ভুটান ও লাওস। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ২১তম।
এডিবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) মাত্র ১ দশমিক ২ শতাংশ পরিমাণ অর্থ সামাজিক সুরক্ষায় খরচ করে বাংলাদেশ। তালিকার শীর্ষে থাকার জাপান খরচ করে জিডিপির ২১ শতাংশের বেশি। তবে বাংলাদেশে নারীদের চেয়ে পুরুষরা বেশি সুরক্ষা পান। আবার সামাজিক সুরক্ষার জন্য গরিব মানুষের পেছনে যতটা খরচ হয়, এর চার গুণ বেশি খরচ হয় ধনীদের পেছনে।
এডিবির প্রতিবেদন ধরে জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জাপানে গরিব লোক নেই বললেই চলে। তবু সব নাগরিককে তাদের জীবদ্দশায় অন্তত একটি সামাজিক সুরক্ষা সুবিধা দেয় তারা। ২০১৫ সালে বাংলাদেশের চেয়ে ৩৬৪ গুণ বেশি অর্থ খরচ করেছে জাপান। বাংলাদেশের মাত্র ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ সামাজিক সুরক্ষার কোনো না কোনো সুবিধা পান।
এডিবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে মাথাপিছু জিডিপির মাত্র দশমিক ২ শতাংশ গরিব মানুষের পেছনে খরচ হয়। আর ধনীদের পেছনে খরচ হয় দশমিক ৮ শতাংশ। এর মানে, গরিবের পেছনে যত টাকা খরচ হয়, এর চার গুণ বেশি টাকা ধনীদের জন্য খরচ হয়।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের এক সদস্য বলেন, অসমতা ও দারিদ্র্য দূর করতে সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়াতেই হবে। এই খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিতে হবে। এখনো জিডিপির ২ শতাংশের কম বরাদ্দ দেওয়া হয়। এটি অন্তত ৩-৪ শতাংশে উন্নীত করা উচিত। এছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অনুযায়ী দারিদ্র্য নির্মূল করতে হলে এসব গরিব মানুষের জন্য সামাজিক সুরক্ষা জোরদারে নজর দিতেই হবে।
বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তামূলক বিভিন্ন কর্মসূচিতে প্রতিবছর খরচ বাড়ালেও তা পর্যাপ্ত নয়। গত ১০ বছরে সামাজিক সুরক্ষায় সরকার খরচ বাড়িয়েছে প্রায় তিনগুণ। প্রতি বছরই সুবিধাভোগীর সংখ্যা ও ভাতা বাড়ানো হয়েছে। গত অর্থবছরে ১৬ ধরনের কর্মসূচিতে ২৭ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া আছে। ১০ বছর আগে বরাদ্দ ছিল মাত্র ৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।
চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ৭৪ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা জিডিপির ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এই হিসাবের মধ্যে অবশ্য সরকারি পেনশনভোগীদের জন্য বরাদ্দ করা টাকাও আছে। সরকারি চাকরির পর অবসরভোগীদের প্রায় শতভাগই দারিদ্র্যসীমার ওপরে বাস করেন। তাই পেনশন বাবদ খরচ বাদ দিলে সামাজিক নিরাপত্তায় খরচ জিডিপির ২ শতাংশের মতো হয়।
চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট ছিল ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এরই মধ্যে তা সংশোধন করে ২০ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছে। বরাবরই বাজেটের একটি বড় অংশজুড়ে থাকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)। আগামী বাজেটেও এডিপির আকার ধরা হচ্ছে ২ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার মতো। চলতি অর্থবছরের এডিপির তুলনায় তা মাত্র ১ হাজার কোটি টাকা বেশি। তবে করোনাভাইরাসের কারণে চলতি অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়ন ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, করোনাকে মাথায় রেখে আগামী বাজেটটি করা উচিত ছয় মাসের জন্য, যাকে বলা হবে করোনা বাজেট। মানুষের জীবন, জীবিকা ও পুনর্বাসনকে কেন্দ্র করেই ছয় মাসের সেই বাজেট করা উচিত।
অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, ৫ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা ধরে নিয়ে আগামী বাজেট প্রণয়নের কথা ভাবা হয়েছিল। পরে তা কমিয়ে ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার কথা চিন্তা করা হয়। করোনার নেতিবাচক প্রভাব সব খাতে পড়ায় শেষ পর্যন্ত বাজেটের আকার কম ধরা হচ্ছে।
জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয় ‘করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে বাংলাদেশে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাব ও উত্তরণের পরিকল্পনা’ শীর্ষক একটি ধারণাপত্র তৈরি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে বাজেটে ঘাটতি ৬ শতাংশের কাছাকাছি হবে। সে হিসাবে অর্থবছর শেষে বাজেট ঘাটতি দাঁড়াবে ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। ওই ধারণাপত্রে অবশ্য ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশ রাখা হবে বলে উলেস্নখ করা হয়েছে।
প্রাক্-বাজেট আলোচনা না হওয়ায় আগামী বাজেটের জন্য দেশের সরকারি-বেসরকারি সব গবেষণা সংস্থা, অর্থনীতিবিদ, চিন্তাবিদ, সাবেক অর্থসচিব এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা শিক্ষকদের কাছ থেকে লিখিত পরামর্শ চেয়েছে অর্থ বিভাগ। এ বিষয়ে অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদার ২১ এপ্রিল ৫০ জনের কাছে একটি অভিন্ন চিঠি পাঠান। সেই চিঠিতে বলা হয়, করোনার কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ও সামাজিক ঝুঁকি মোকাবিলায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নির্ধারণ করে আগামী ৫ মের মধ্যে তাদের মতামত অর্থ বিভাগে পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয় চিঠিতে।
এদিকে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি শিখিয়েছে অপ্রত্যাশিত খাতের প্রয়োজনীয়তা। তাই নতুন বাজেটে অপ্রত্যাশিত খাতের বরাদ্দেও আসতে পারে বড় পরিবর্তন। চলতি অর্থবছরে সরকার অপ্রত্যাশিত খাতের জন্য দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখে। আগামী বাজেটে তার পরিমাণ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এগুলো ছাড়াও সরকার কর্মসংস্থানেরও আলাদা গুরুত্ব দেবে।