নিউজ ডেস্ক:
১৯০৮ সালে ফাঁসি কার্যকরের সময় বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর বয়স ছিল ১৮ বছর, ৭ মাস এবং ১১ দিন। সেই দিন, ১১ আগস্ট সারা ভারত ফেটে পড়েছিল ক্ষোভে। দুঃখে শোকে চুলো জ্বালানো বন্ধ ছিল বাড়িতে বাড়িতে।
ওই ঘটনার ১১১ বছর পর সৌদি আরবে শিরোশ্ছেদ হতে চলেছে কিশোর মুর্তাজা কুরেইসির। তার ১০ বছর বয়েসে করা অপরাধের জন্য এই শাস্তির ব্যবস্থা।
সারা বিশ্ব উত্তাল হলেও আশ্চর্যজনকভাবেই শান্ত সৌদি রাজতন্ত্র। যে রাজতন্ত্র উপড়ে ফেলার ডাক দিয়েছিল এক কিশোর। আরব কাঁপিয়ে দেওয়া বসন্ত বিপ্লবের অন্যতম মুখ মুর্তাজা কুরেইরিস। যাকে আমরা হয়তো কেউ চিনি না। শিরোশ্ছেদের আগে তাকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিশ্ব, তার জন্য কাঁদছে আরব মায়েরা।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দিক থেকে বিশ্বের প্রথম পাঁচটি দেশের মধ্যে তৃতীয় স্থানে সৌদি আরব। বাকি দেশগুলো হলো চীন, ইরান, ভিয়েতনাম ও ইরাক। সৌদি আরবে শুধু গতবছর ১৪৯ জনের শিরোশ্ছেদ করা হয়েছে।
চলতি বছর এখন পর্যন্ত ১০০ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে সৌদি আরব। এর মধ্যে শুধু এপ্রিলেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ৩৭ জনের। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বেশ কয়েকজনের দেহ প্রকাশ্যে রাস্তায় টাঙিয়ে রাখা হয়েছিল। জনগণের মধ্যে ভীতি সঞ্চারই ছিল এর উদ্দেশ্য।
২০১০, আরব দুনিয়ায় বসন্ত এসেছিল ডিসেম্বরেই। আরব বসন্তে উত্তাল হয়েছিল আরব দুনিয়া। রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের অবসান চেয়ে রাস্তায় নেমেছিল আরব বিশ্বের লক্ষ লক্ষ শোষিত ও বঞ্চিত মানুষ। গণজাগরণের জোয়ারে ভেসে গিয়েছিল একের পর এক আরব দেশ। নিপীড়ন, বঞ্চনা, বেকারত্ব, দুর্নীতির অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র আনতে চেয়েছিলেন আরব দুনিয়ার সাধারণ মানুষ। ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে আরব বসন্তের মশাল জ্বালেন তিউনিসিয়ার ফেরিওয়ালা বাওয়াজিজি।
বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে আরব ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে। এদের মধ্যে রয়েছে তিউনিসিয়া, মিসর, লিবিয়া, ইয়েমেন, বাহরিন, সিরিয়া, ইরান, জর্ডন, আলজেরিয়া, মরক্কো, ইরাক, কুয়েত, মৌরিতানিয়া, ওমান, সোমালিয়া, সুদান এমনকি সৌদি আরবও। আরব বসন্তের ঝড়ে সিংহাসনচ্যুত হন তিউনিশিয়ার স্বৈরশাসক জয়নাল আবেদিন বেন আলি, মিশরের হোসনি মোবারক, ইয়েমেনের আলি আবদুল্লাহ সালেহ, লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফিসহ বিভিন্ন দেশের একনায়ক।
ঢেউ আসে সৌদিতেও
সৌদি রাজতন্ত্রের অবসান চেয়ে রাস্তায় নামেন সৌদির সাধারণ মানুষ। তৎকালীন সৌদি আরবের রাজা ফাহাদ নির্মম দমন পীড়ন চালান তারই দেশের নাগরিকদের ওপর। আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন আলি কুরেইরিস নামে এক ১৭ বছরের কিশোর। ওই বয়েসেই নেতৃত্ব দেন জনগণকে। রাতের অন্ধকারে পোস্টার মারেন সৌদি আরবের প্রশাসনিক ভবনগুলোতে। ঘরে বসে পোস্টার লিখতে সাহায্য করেন তার ১০ বছর বয়সী ভাই মুর্তাজা।
একদিন, মুর্তাজার দাদা আলিকে বিক্ষোভরত অবস্থায় গুলি করে হত্যা করে সৌদি পুলিশ। আলির দাফন কাজ শেষ হতেই, ক্ষোভে প্রতিবাদে নেমে পড়েছিলেন ১০ বছরের বালক মুর্তাজা। ৩০ জন বালকের একটি সাইকেল বাহিনী নিয়ে অংশ নেন বিক্ষোভে। মুর্তাজার তোলা ‘রাজতন্ত্র নিপাত যাক’ স্লোগানে মুখরিত হয়েছিল এলাকা।
সেদিন থেকেই সৌদি প্রশাসনের দুই চোখের বিষ হয়ে উঠেছিল বালক মুর্তাজা। ওইটুকু বয়সেই তিনি সঙ্গীদের বোঝাতেন যতদিন রাজতন্ত্র থাকবে ততদিন সৌদি আরবের জনসাধারণের ভবিষ্যৎ বলতে কিছু নেই। তার কথায় অনুপ্রাণিত হতে থাকেন সমবয়সীরা, তাদের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হতে থাকেন তাদের পরিবারের সদস্যরা। বিষয়টির ওপর নজর রেখেছিল সৌদি গোয়েন্দারা।
ধরা পড়ে যান মুর্তাজা
মুর্তাজাকে পৃথিবী থেকে সরানোর ছক তৈরি হয়। মুর্তাজার পরিবার সৌদি আরব ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৪ সালে লুকিয়ে বাহরিন পালিয়ে যাওয়ার পথে সৌদি সীমান্তে গ্রেপ্তার করা হয় ১৩ বছর বয়সী মুর্তাজাকে। রাষ্ট্রদ্রোহিতা, দাদার দাফনে উপস্থিত থাকা, থানায় ককটেল নিক্ষেপ ও সন্ত্রাসবাদী সংঘঠনে যোগ দেওয়ার মতো মারাত্মক সব অভিযোগ আনা হয় মাত্র ১৩ বছর বয়সী একজন বালকের বিরুদ্ধে।
এরপর মুর্তাজাকে রাখা হয় দাম্মামের জুভেনাইল ডিটেনশন সেন্টারে। বিচার শুরু হতে সময় লাগে চার বছর। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে মুর্তাজার বিচার শুরু হওয়ার আগে তাঁকে আইনজীবী নিতেও দেওয়া হয়নি। এই চার বছর কিশোর মুর্তাজাকে জেলের একটি সেলে একলা রাখা হয়েছিল।
জিজ্ঞাসাবাদ চলাকালে মুর্তাজার ওপর অকথ্য অত্যাচার করা হয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, তদন্তকারী দল মুর্তজাকে বলেছিল, তিনি দোষ স্বীকার করলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। এভাবে তাঁকে তাঁর উপর চাপিয়ে দেওয়া দোষ স্বীকারে বাধ্য করা হয়।
বাঁচানো যাবে কী মুর্তাজাকে!
বিচারের নামে প্রহসন ঘটিয়ে গত বছরের আগস্ট মাসে তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে সৌদি আরব। মুর্তাজাকে বাঁচানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ সারা বিশ্বের মানবাধিকার সংগঠনগুলো। সৌদি আরবের কাছে তারা আবেদন জানিয়েছে মুর্তাজা কুরেইরিসের মৃত্যুদণ্ড রদ করার জন্য। কিন্তু সত্যিই কী মুক্তি পাবেন আরব বসন্তের অন্যতম মুখ মৃত্যুদণ্ডের দিন গুণতে থাকা মুর্তাজা কুরেইরিস!
বিশ্বের আবেদনে আজ পর্যন্ত সাড়া দেয়নি সৌদি আরব। তাই আশঙ্কিত বিশ্বের মানবাধিকার সংঘঠনগুলো। তারা জানে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিদ্রোহ দমনের জন্য সৌদির প্রধান হাতিয়ার মৃত্যুদণ্ড। সেই মানুষটি যে বয়েসেরই হোক না কেন। তবু চেষ্টা চলছে সর্বস্তরে। সেই কিশোরকে বাঁচাতে, মাত্র ১০ বছর বয়সে যে হাতে তুলে নিতে চেয়েছিল গণতন্ত্রের বিজয় পতাকা। এবং যে চলে গেলে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে বিশ্বের।
সূত্র : দি ওয়াল