চন্দন লাহিড়ী:
বাংলাদেশে নারী-পুরুষের সমতার সংগ্রামের অধ্যায়টি বহুল আলোচিত।সাম্প্রতিক সময়ে অন্যসব অর্জনের পাশাপাশি বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে একটিসম্মানজনক স্থানে অবস্থান করছে বলে বিভিন্ন তথ্যসূত্রে এবং জাতীয় ওআন্তর্জাতিক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে। বর্তমান সরকারকে তাইঅনেকে নারীবান্ধব বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। সরকারের ইতিবাচক নীতি,উদ্যোগের পাশাপাশি দেশের নারী আন্দোলন কর্মী ও বেসরকারি উন্নয়নসংস্থাসমূহের অক্লান্ত সংগ্রাম ও অব্যাহত চেষ্টার ফলে আজ দেশের প্রতিটিসেক্টরে নারীদের উপস্থিতি এবং অংশগ্রহণ ক্রমশ দৃশ্যমান হচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছেবাংলাদেশ, একইসাথে তাল রেখে এগিয়ে যাচ্ছিলো নারী-পুরুষের সমতারইতিবাচক সংগ্রাম। ইতিমধ্যে নারী-পুরুষ সমতার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়কআইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে; যদিও এসবের বাস্তবায়ন নিয়ে নানাসমালোচনা বাজারে চালু আছে। নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের জন্য মানুষেরসচেতনতা এবং প্রগতিশীলতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না থাকায় সরকারিউদ্যোগ সমূহ পুরোপুরি কার্যকর হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।নারীবান্ধব ও সংবেদনশীল প্রশাসনিক কাঠামো বা জনবল তৈরির দিকে আরোবেশি নজর দেয়া প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্ট সকলে মনে করেন।
এতোকিছুর পরও আমাদের অর্জন একেবারে কম নয়। সকলের একটি কথা মনেরাখা দরকার যে, নারী উন্নয়ন কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। জাতীয় এবংআন্তর্জাতিক দলিলে স্বাক্ষর করে সরকার এই ধারাটি অব্যাহত রাখতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।বাংলাদেশে মোট জনসংখার প্রায় অর্ধেক হচ্ছে নারী, তাই দেশের উন্নয়নকরতে হলে এ অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে ফেলে রেখে সম্ভব নয়। বাংলাদেশ তাই নারীপুরুষের সমান অধিকারে বিশ্বাস করে। বাংলাদেশের সংবিধানই “জাতীয়জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র নিশ্চিতকরিবেন” বলে প্রতিশ্রæতি দিয়েছে। এই ধারাবাহিকতায় সরকার নারীউন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। উন্নয়নের মূল ¯্রােতধারায় সকল স্তরেনারীকে সম্পৃক্ত করা ও তার সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করা জাতীয় নারী উন্নয়ননীতিমালার মূল লক্ষ্য। অন্যদিকে চলতি বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে বেইজিং ঘোষণার২৫ বছর। এ কথা সকলে স্বীকার করবেন যে, গত ২৫ বছর ছিল নারী আন্দোলনের জন্যএকটি সোনালী অধ্যায়, এর সূচনা হয়েছিল ১৯৯৫ সালে, জাতিসংঘেরউদ্যোগে বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে। এইসম্মেলনে নারীর সামগ্রিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির লক্ষ্যে ১২টি গুরুত্বপূর্ণইস্যুকে চিহ্নিত করে সেগুলির বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ ও উদ্যোগ নেয়ার জন্যজাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে আহŸান করা হয় এবং পরবর্তী সময়ে প্রতি৫ বছর পর পর গৃহীত উদ্যোগসমূহ মূল্যায়নের জন্য সভা আয়োজন করা হয়।চলতি ২০২০ সালে সারা বিশ^ যখন বেইজিং ঘোষণা পরবর্তী গত ২৫ বছরেরঅর্জন, চ্যালেঞ্জ আর করণীয় এর হিসাব নিয়ে ব্যস্ত, ঠিক এই সময়ে গোটাবিশ^কে থমকে দাঁড়াতে হলো। থেমে গেল নারী-পুরুষের সমতার সংগ্রাম।নানামুখি চলমান সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগসমূহ আজ কঠিন সংকটের
নারী-পুরুষের সমতার সংগ্রাম: চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই আগাতে হবে।
মুখোমুখি। অদৃশ্য শক্তি করোনা সারা পৃথিবীর মতো আমাদের সমস্ত উন্নয়নযাত্রাকে থামিয়ে দিয়েছে। গত তিনমাস ধরে চলা এই সংকট আমাদের কতোগুলিগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। নারী-পুরুষের সমতার ক্ষেত্রেঅর্জনগুলোর প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। আজ হোক আর কাল হোক আমরাহয়ত করোনা সংকট কাটিয়ে উঠবোই। আর তাই প্রয়োজন হচ্ছে যে সববিষয় আজ সংকটে পড়েছে সেগুলোর দিকে বিশেষ নজর দেয়া। পাশাপাশিবেইজিং ঘোষণা ও নারী উন্নয়ন নীতিমালার অগ্রাধিকার বিষয়সমূহের দিকেনজর দেবার সময় এসেছে। জেন্ডার ভিত্তিক সহিংসতা, রাজনৈতিক ওঅর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, নারী শিক্ষা এবং কাজ ইত্যাদি নানা বিষয় আজ পড়েছেআকস্মিক সংকটে। এখানে এরকম সাম্প্রতিক কিছু বিষয় যেগুলো সংকটজনকঅবস্থায় আছে তার চিত্র তুলে ধরা হলো। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য এটিসহায়ক হবে বলে আশা করি।
বাড়ছে জেন্ডার ভিত্তিক সহিংসতা।
করোনার সময়ে দেশব্যাপী বেড়েই চলছে জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা। পারিবারিকনির্যাতনের পাশাপাশি ধর্ষণ, তালাক এবং নারী নির্যাতনের নির্মম চিত্রেরমুখোমুখি হচ্ছে বাংলাদেশ প্রতিদিন। এসময়ে নারী নির্যাতনবিরোধীচলমান সামাজিক আন্দোলন না থাকায় নারীদের এগিয়ে চলার যে পদযাত্রা,গ্রামীণ অর্থনীতিতে তাদের যে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং পরিবারে তাদের যেঅবদান তা ক্রমান্নয়ে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গত মে মাসে ৭ হাজার গ্রামীণপরিবার নিয়ে স্টেপস্ধসঢ়; পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ৪ হাজার৫৫০টি পরিবারে নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। উল্লিখিত পরিবারেরমধ্যে প্রায় ৬৫ শতাংশ পরিবারের নারী ও শিশুরা বিভিন্ন ধরনের মানসিক ওশারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অন্য একটি সংগঠনের গবেষণায় দেখাগেছে যে, গত মে মাসে দেশে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৩,৪৯৪ জন নারী ওশিশু, এর মাঝে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৯৪.৪ শতাংশ। পুলিশ সদরদপ্তর থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত এক তথ্যে জানা গেছে গত মার্চ থেকে মেমাস পর্যন্ত দেশে ১,১৮০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, নারী নির্যাতনের ঘটনাঘটেছে ২,১৪০টি এবং শিশু নির্যাতনের ঘটনা হচ্ছে ৪৭৫টি। এধরনেরসহিংসতা বৃদ্ধির ফলে নারীদের সামনে এগিয়ে যাবার পথ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।এসময়ে নারীদের অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণ এবং গর্ভপাতের ঘটনাও ঘটছে বলেনানা পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। মানুষের কর্মহীনতা, আয়-রোজগার কমেযাওয়া, নিজেদের ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়া, খাবারের সংকট ও পরিবারেঋণের বোঝা বাড়ার কারণে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলছে নারীর প্রতি সহিংসতা।এছাড়াও আইনশৃখলা বাহিনী করোনা মোকাবেলায় ব্যস্ততায় এদিকে নজর দিতেপারছে না বলে জানা গেছে।
বিপদে আছেন গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তারা।
এই করোনাকালীন মহাদুর্যোগে সংবাদপত্রে খবর বের হচ্ছে, নারীদের শ্রমে গড়েওঠা বিভিন্ন উদ্যোগ এবং ব্যবসাসমূহ পুঁজির অভাবে প্রায় বন্ধ হবার পথে।প্রায় ৮০ শতাংশ গ্রামীণ ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা ইতোমধ্যে তাদের পুঁজিহারিয়েছেন বলে খবর বেড়িয়েছে। গত মার্চ ২০২০ থেকে দেশে কোভিড-১৯ভাইরাস প্রতিরোধে শুরু হওয়া লকডাউনের কারণে অন্যসব সরকারি-বেসরকারি
নারী-পুরুষের সমতার সংগ্রাম: চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই আগাতে হবে।
প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্যের মতো দেশের ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের কার্যক্রমওকার্যত অচল হয়ে পড়েছে। জুন থেকে সীমিত পরিসরে জরুরি পরিষেবাকার্যক্রম, অফিস-আদালত ও ব্যবসা-বাণিজ্য চালু হলেও পরিবর্তিতপরিস্থিতিতে গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের নানান প্রতিবন্ধকতা ও নতুন নতুনচ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হচ্ছে, যার ফলে তাদের এতদিনের শ্রমে গড়ে ওঠা ক্ষুদ্রউদ্যোগগুলি বন্ধ হয়ে যাবার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। দেশে কোভিড-১৯ সময়েপরিবারের সদস্যদের খাবার যোগান দেয়া, নিয়মিত নানাবিধ চাহিদামেটানোসহ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য গ্রামীণ পর্যায়ে ক্ষুদ্র নারীউদ্যোক্তারা তাদের দীর্ঘদিনের অর্জিত সম্পদ এবং পুঁজি হারিয়েছেন। ফলেথমকে গেছে তাদের উদ্যোগ ও ব্যবসা। অন্যদিকে তাদের ওপর বাড়ছে ঋণের বোঝা।গ্রামীণ অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের যে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবংপরিবারে তাদের যে অবদান তা ক্রমান্নয়ে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ঘাড়ে চেপেবসেছে ঋণের বোঝা। সামাজিক কর্মকাÐে কমেছে তাদের অংশগ্রহণ।অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে তাদের পরিবারের শিশুদের শিক্ষাজীবনে। নিজেদের ব্যবসাবন্ধজনিত জটিলতায় তারা সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাÐে যুক্ত হতে পারছেননা। তাদের চলাচল সীমিত হয়ে পড়ছে। স্থানীয় পর্যায়ের ক্ষমতা কাঠোমোয় তাদেরযুক্ততার সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে। এর মানে হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বীহবার মধ্যে দিয়ে তারা যে স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন কাঠামোতে যুক্ত হবার ক্ষেত্রতৈরি করছিলো সেখানেও তাদের থামতে হচ্ছে। বিভিন্ন সংগঠন থেকেসংগৃহিত ঋণের টাকা তারা কীভাবে পরিশোধ করবেন, সে বিষয়ে তারা পরিষ্কারনন। নিজেদের ব্যবসা বন্ধজনিত জটিলতায় তারা সামাজিক বিভিন্নকর্মকাÐে যুক্ত হতে পারছেন না। এই ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের পাশে যদি এখনইদাঁড়ানো সম্ভব না হয় তাহলে থমকে যাবে নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়নেরচাকা। ঘরে ঢুকে যেতে বাধ্য হবেন গ্রামীণ উদ্যোক্তা নারীদের একটা বড় অংশ ।স্থানীয় কাঠামোয় নারী
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গেøাবাল ‘জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২০’অনুযায়ী, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে সপ্তমঅবস্থানে রয়েছে। উল্লেখ্য ২০১৮ সালের এই একই সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়িবাংলাদেশের অবস্থান ছিল পঞ্চম। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ মাত্রদু’বছরের ব্যবধানে পিছিয়ে সপ্তম স্থানে চলে গেছে। এই ধারাবাহিকতায়করোনা সংকটকালিন সময়ে যদি প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণে আমার ব্যর্থহই তাহলে হয়তো আগামী বছরে আমাদের অবস্থান আরও পিছিয়ে পড়বে। স্থানীয়পর্যায়ের সিদ্ধান্ত-গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর কার্যকর অংশগ্রহণ মানুষকেআশাবাদী করে তুলেছিল। একই ধারাবাহিকতায় স্থানীয় সরকার সহ রাজনৈতিকদল ও স্থানীয় পর্যায়ের নানা প্রতিষ্ঠানে সিদ্ধান্ত-গ্রহণে নারীর অংশগ্রহণবেড়েছে, সরকারি নীতি আর বেসরকারি উদ্যোগের কারণে। কিন্তু বর্তমানেকরোনাকালিন সংকটের কারণে, নারীরা পড়েছে সবচেয়ে বড় বাধার মুখে।লকডাউনজনিত কারণে সকল মানুষের ঘরে আটকে পড়ার কারণে, স্থানীয় সরকারেরসাথে যুক্ত একটি বড় অংশের নারী প্রতিনিধিরা সরকারি, বেসরকারি উদ্যোগেরঅংশীদার হতে পারেনি বলে অভিযোগ উঠেছে। এলাকার গরীব মানুষকে সহায়তারকাজে তাদের যুক্ত করা হয়নি বলে নারীরা জানিয়েছেন। পরিবারের চাপের কারণেতারা ছিলেন ঘরবন্দি। এই সুযোগে তাদের উপেক্ষা করেই পুরুষ প্রতিনিধিরা
নারী-পুরুষের সমতার সংগ্রাম: চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই আগাতে হবে।
ত্রাণ বিতরণসহ সরকারি নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। ফলে একদিকেনারীরা তাদের এলাকার ভোটারদের নিকট গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন। ফলে যারাবর্তমানে স্থানীয় সরকারে আছেন, আগামী দিনে যারা স্থানীয় সরকারনির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক কিংবা রাজনৈতিক কর্মকাÐে যুক্ত হবারজন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তাদের থামতে হলো। তারা একরকম জনবিচ্ছিন্ন হয়েপড়লেন।
সবচেয়ে বড় আশার জায়গা ছিল রাজনৈতিক দলে ৩৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণনিশ্চিত করা বিষয়ে সরকারের নির্দেশনা। রাজনৈতিক দলগুলো এই নির্দেশনারফলে বাধ্য হচ্ছিলেন তাদের কমিটিতে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে। সেটিওএখন ভেস্তে যাবার উপক্রম। ইতিমধ্যে গত ১৮ জুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) দলনিবন্ধন আইনের খসড়া প্রকাশ করে আগামী ৭ জুলাইয়ের মধ্যে এর ওপর মতামতচেয়েছেন। এই খসড়ায় সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়টি হলো, রাজনৈতিক দলের সবপর্যায়ের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী পদ পূরণে যে সময়সীমা ছিল, তা আররাখতে চাইছেন না নির্বাচন কমিশন। উল্লেখ্য যে, রাজনৈতিক দল নিবন্ধনপাওয়ার অন্যতম শর্ত ছিল ২০২০ সালের মধ্যে দলের সব পর্যায়ের কমিটিতে ৩৩শতাংশ নারী পদ পূরণ করতে হবে। এমনিতেই রাজনৈতিক কর্মকাÐ না থাকায়স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কমিটি করা সহ সেখানে নারীরঅংশগ্রহণ নিশ্চিত করার বিষয়টি নিয়ে ছিল একরকমের অনিশ্চয়তা। নির্বাচনকমিশনের এ ধরনের উদ্যোগ যদি বাস্তবায়িত হয় অথবা আইনে পরিণত হয় তাহলেরাজনৈতিক দলে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্র সীমিত হয়ে যাবে। নারী উন্নয়নেবাংলাদেশ সরকারের যে উদ্যোগ তা নির্বাচন কমিশনের এ ধরনের আইন পাশেরমধ্যে দিয়ে ভেস্তে যাবে বলে সংশ্লিষ্ট সকলে মনে করেন। এছাড়া বাংলাদেশেরসংবিধান ও নারী উন্নয়ন নীতিমালার সাথে এ বিষয়টি সাংঘর্ষিক। কীভাবেএটি সংশোধনের জন্য নির্বাচন কমিশন উদ্যোগ নিলো ইতিমধ্যে এটিনিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তাই সময় এসেছে এর বিরুদ্ধে সম্মিলিত উদ্যোগগ্রহণ করার।
মেয়ে শিশুদের ঝরে পড়া এবং বাল্যবিবাহ।
গত মার্চ মাস থেকে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ হয়ে আছে করোনাসংকটের কারণে। তবে আশংকা আছে যে করোনা পরবর্তি সময়ে বিদ্যালয় খুলেদেওয়া হলেও অতি দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিশুরা পেটের দায়ে শিশুশ্রমেরদিকে ঝুঁকে পড়বে। ফলে শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ঝরে পড়াসহ, শিশুশ্রম বৃদ্ধিপাবে। মোট শিক্ষার্থীর অন্তত ৩০ শতাংশ বা এর বেশি ঝরে পড়তে পারে বলে শিক্ষানিয়ে কর্মরত সংগঠনসমূহ শংকা প্রকাশ করছে। এসব শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়েনা ফেরার সম্ভাবনাই বেশি। মহামারি-উত্তর পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক দুরবস্থারজন্য অনেক শিক্ষার্থীর পরিবারের পক্ষেই খাদ্য সংকট মেটানোর পাশাপাশি শিক্ষাউপকরণ ক্রয় এবং শিক্ষাব্যয় নির্বাহ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। আর তাই খাবারেরঅভাবের জন্য তাদের পরিবার, শিক্ষার্থীদের শ্রম দিতে বাধ্য করাবে। চলমানমহামারির ফলে অনেক গরিব পরিবার আরও বেশি অসহায় হয়ে পড়বে, কাজ হারাবে।সেক্ষেত্রে তাদের সন্তানদের স্কুলে না পাঠিয়ে আয়মূলক কাজে পাঠিয়ে সংসারেরআয় বাড়াতে চাইবে। এই ঝরে পড়া শিশুদের মধ্যে মেয়েশিশুই সবচেয়ে বেশিথাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। করোনাজনিত কারণে যে দারিদ্র্য বাড়বে, তাতেপরিবারের প্রতিদিনের ব্যয় নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়বে। এর ফলে মেয়েশিশুদের
নারী-পুরুষের সমতার সংগ্রাম: চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই আগাতে হবে।
শিক্ষা অব্যহত রাখা পরিবারের জন্য কঠিন হবে। পরিবারে মেয়েশিশুরা হয়ে উঠবেবোঝা। ফলে মেয়েশিশুদের বাল্যবিয়ের হার বাড়বে। পাশাপাশি করোনার কারণেছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পুষ্টিহীনতা বাড়বে বলেও ধারণা করাহচ্ছে। মোটকথা শিক্ষাব্যবস্থার একটি বড় অংশের শিক্ষার্থীরা পড়তে যাচ্ছেকঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। কিন্তু আমরা কেউ এটি প্রত্যাশা করি না যে,সরকারি এবং বেসরকারি দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার ফলে শিক্ষায় যে গতি এসেছেতা নিম্নমুখী হোক। শিশুশ্রমিক তৈরি হোক। ঝরে পড়া আর বাল্যবিবাহের হারবৃদ্ধি পাক। তাই সময় থাকতেই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং তার প্রস্তুতিশুরু করতে হবে এখন থেকেই।
নগরে দরিদ্র নারীর জীবন।
গ্রামীণ নারীরা যেমন নানাবিধ সংকটে পড়েছেন তেমনি নগরে দরিদ্র নারীদেরজীবনেও করোনার প্রভাবে সংকট তৈরি হচ্ছে। এসময়ে দেশের গার্মেন্টস সহনানা প্রতিষ্ঠানে শুরু হয়েছে ছাঁটাই প্রক্রিয়া। পুরুষের পাশাপাশি এরশিকার হচ্ছেন নারীরা, ফলে বড় অংশের নারী কর্মহীন হয়ে পড়ছেন বা পড়বেন।অন্যদিকে শহরে কর্মরত প্রায় ৮০ ভাগ নারী গৃহকর্মী ইতিমধ্যে তাদের কাজহারিয়ে ভিক্ষা বৃত্তিতে নামছেন বলে বিভিন্ন মাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। এরপাশাপাশি স্বল্প আয়ের পুরুষরা তাদের কাজ হারিয়ে ফিরে যাচ্ছেন গ্রামে।এভাবে আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাবার কারণে পরিবারে যে অস্থিরতা তৈরি হবে এরপ্রভাবে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়বে। বন্ধ হয়ে যাবে পরিবারের শিশুদেরশিক্ষাজীবন। একই সাথে, খাদ্য ও নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে নারীরা। এছাড়াকরোনার সার্বিক অভিঘাতে চলতি বছরের দ্বিতীয় তিনমাসে দেশে আরও ১কোটি ৬৪ লাখ মানুষ গরীব হয়েছে বলে ধারণা দিয়েছেন রাষ্ট্রের উন্নয়নগবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস। এর একটি বড় অংশ নারী বলে ধারণা করাহচ্ছে। অন্যদিকে পরিবারের আর্থিক সংকট এবং সরকারি হাসপাতাল সমূহকরোনা ইস্যুতে ব্যস্ত থাকার ফলে নারীরা তাদের প্রাত্যহিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণথেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এর পাশাপাশি দেশের সংখ্যালঘু, আদিবাসী এবংপ্রতিবন্ধি নারীরা সবচেয়ে সংকটে পড়বে বলে ধারনা করা হচ্ছে।
এই করোনাকালিন সময়ে দেশের প্রতিটি সেক্টরে বেড়ে চলছে সংকট ও বঞ্চনা।পুরুষের পাশাপাশি এর শিকার হচ্ছেন নারী, চ্যালেঞ্জে পড়ছে নারী উন্নয়ন ইস্যু।সকলের মনে রাখা দরকার, নারী-পুরুষের সমতা এটি শুধু শ্লোগান নয়, এটিএকটি রাজনৈতিক বিশ^াস ও দর্শন। এই ধারণাটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবংপ্রগতিশীলতাকে যেমন অগ্রগামী করে, ঠিক তেমনি প্রতিনিয়তমৌলবাদকে কোণঠাসা করে রাখে তার নিজস্ব ক্ষমতা দিয়ে। নারীর কার্যকরঅংশগ্রহণের ফলে শাসন প্রক্রিয়ায় বৃদ্ধি পায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা;শক্তিশালি হয়ে ওঠে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, জনগণ ভোগ করে এর সুফল। আর তাইএতোদিনের সকল অর্জন যাতে এই অনাহুত শক্তি করোনা গিলে ফেলতে না পারেএর জন্য এখনই সকলকে শক্তভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। হাত লাগাতে হবে এখনই।যদি আমরা ব্যর্থ হই তাহলে প্রতিক্রিয়াশীলরাই জিতবে। নারী-পুরুষের সমতারসংগ্রাম মুখ থুবড়ে পড়বে।
লেখক পরিচিতি: চন্দন লাহিড়ী। মুক্ত সাংবাদিক এবং উন্নয়ন কর্মী।