স্বাধীনতার মাত্র পৌনে চার বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করার পর টানা ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ফের ক্ষমতায় আসে। এর মাত্র দুই বছর পর স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের সঙ্গে জোট বাঁধে বিএনপি। ১৯৯৮ সালে গড়া সেই রাজনৈতিক ঐক্য এখনো আছে। জামায়াতের ব্যাপারে নিজেদর অবস্থান বিন্দুমাত্র বদলায়নি বিএনপি।
অতি সম্প্রতি অবশ্য রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে গুঞ্জন ওঠে, জামায়াত ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বেশিরভাগ সদস্য একমত হয়েছেন। এ ব্যাপারে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ারও সম্মতি আছে।
তবে খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেছে, জামায়াত ছাড়ার ব্যাপারে দলীয় ফোরামে আলোচনা বা সিদ্ধান্ত— কোনো কিছুই হয়নি। গত শনিবার (১৮ জুলাই) বিএনপির স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভায় এ প্রসঙ্গটা ওঠেইনি। কয়েকটি শোক প্রস্তাব, করোনা ও বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা এবং সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের হালনাগাদ তথ্য বিশ্লেষণেই সীমাবদ্ধ ছিল ওই সভা।
সেদিনের সেই সভায় জামায়াত ছাড়ার ব্যাপারে কোনো আলোচনা হয়েছিল কি না?— এমন প্রশ্নের জবাবে বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য, ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান সারাবাংলাকে পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘এসব খবর আপনারা পান কোথায়?’
‘জামায়াত ছাড়া তো দূরের কথা, এ প্রসঙ্গে কোনো আলোচনাই সেদিনের বৈঠকে হয়নি। ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়ক হিসেবে বিষয়টি আমি জানলাম না, আর আপনারা সব জেনে গেলেন! যাদের কাছ থেকে জেনেছেন, তাদের প্রশ্ন করুন। তারাই ভালো বলতে পারবেন। ২০ দলীয় জোট যেমন ছিল, তেমনই আছে। জোটের ব্যাপারে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি,’— বলেন নজরুল ইসলাম খান।
দলীয় সূত্রমতে, গত ২২ বছরের সম্পর্ক হঠাৎ করে ছিন্ন করার মতো কোনো কারণ দেখছে না বিএনপির হাইকমান্ড। সম্পর্ক ছিন্ন করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা থাকলে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবিতে ২০১৩ সালে শাহবাগে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের দিনগুলোতেই জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করত বিএনপি। স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলার জন্য সেটাই ছিল সবচেয়ে মোক্ষম সময়। সেই উত্তাল সময়টাতে গোটা দেশের মানুষ যখন জামায়াতবিরোধী অবস্থান নিয়েছিল, তখনো জামায়াত ছাড়ার ঘোষণা দেয়নি বিএনপি। আর এখন জামায়াত ছাড়ার ঘোষণা কেন আসবে?— প্রশ্ন বিএনপি নীতিনির্ধারণী ফোরামের বেশ কয়েকজন সদস্যের।
কেউ কেউ বলছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’-এ যোগ দেওয়ার আগেও জামায়াত ছাড়ার বিষয়টি ভাবতে পারত বিএনপি। কারণ, ওই সংকটময় মহূর্তে ড. কামাল হোসেন, অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী (বি চৌধুরী), বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম, আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্নার তরফ থেকে জামায়াত ছাড়ার শর্ত আরোপ করা হচ্ছিল।
শেষ পর্যন্ত জামায়াত না ছাড়ায় বিকল্প ধারা নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেননি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসিচব সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। বরং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটে যোগ দেন তিনি। আর বিএনপির সঙ্গে জামায়াত থাকা অবস্থায় তাদের সঙ্গে নির্বাচনি জোট করে সমালোচনা মুখে পড়েন স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন। তারপরও জামায়াত ছাড়েনি বিএনপি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি এখনো মনে করে— ভোটের রাজনীতিতে ড. কামাল হোসেন, বি চৌধুরী, কাদের সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না অথবা বাম রাজনৈতিক দল— সবাই মিলে একত্রিত হলে যা হবে, জামায়াত একা তাদের পাশে থাকলে তার চেয়ে বেশি কিছু হবে। ফলে কোনো অবস্থাতেই জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার কোনো প্রয়োজন তারা বোধ করছে না। কৌশলগত কারণে মাঝে-মধ্যে হয়তো জামায়াতের সঙ্গে ‘লোক দেখানো’ দূরত্ব তৈরি করার কথা ভাবতে পারে বিএনপি, যেমনটি তারা ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের সময় করেছিল।
এদিকে, জামায়াতের ব্যাপারে মুখে ‘কুলুপ’ এঁটে বসেছেন বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বেশিরভাগ সদস্য। জামায়াত ইস্যুতে ভালো-মন্দ— কোনো কথাই মিডিয়াতে বলতে চান না তারা।
জামায়াতের ব্যাপারে দলের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য সাবেক মন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ ব্যাপারে দলের মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কথা বলবেন।’
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য মির্জা আব্বাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘জামায়াত নিয়ে নতুন করে কথা বলার মতো কিছু ঘটেনি। আপনারা (মিডিয়া) মাঝে মধ্যে অনেক কিছুই লেখেন, সেখান থেকে আমরা ধারণা নিই। এখন আপনাদের কাছেই আমরা জানতে চাইতে পারি, কোথায় কী হচ্ছে।’
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি ফোনে কাউকে কমেন্ট দিই না। কথা বলতে চাইলে সরাসরি আসতে হবে।’
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘জামায়াতের ব্যাপারে আমি একটা কথাও বলব না। এ ব্যাপারে আমাকে প্রশ্ন করে কোনো লাভ নেই।’