- ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে মাতারবাড়িতেই নির্মাণ করা হচ্ছে
- এই মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এর আগেই মাদার ভেসেল ভেড়ানোর টার্গেট জাপানের পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এ মাসেই চুক্তি এরপর ঠিকাদার নিয়োগ
হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ আকার বাড়ছে দেশের অর্থনীতির, বাড়ছে আমদানি-রফতানির পরিমাণ, গড়ে উঠছে অনেক অর্থনৈতিক অঞ্চল। ক্রমবর্ধমান আমদানি-রফতানির চাপ সামাল দিতে প্রয়োজন বড় বন্দর। বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে সরকার হাত দিয়েছে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ কাজে। কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে উঠছে গভীর সমুদ্র বন্দর। এই বন্দর হবে আগামীর বন্দর, যা দিয়ে সেবা প্রদান করা যাবে প্রতিবেশী দেশগুলোকেও। মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রক্রিয়ায় পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়ে যাবে এই মাসে। এরপর হবে ঠিকাদার নিয়োগ। এগোচ্ছে বন্দরের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া। ২০২৬ সালের মধ্যে গভীর সমুদ্র বন্দর চালু করার টার্গেট নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে সরকার। করোনা দুর্যোগের কারণে কয়েক মাসের জন্য কার্যক্রম পড়ে যায় স্থবিরতার আবর্তে। কিন্তু পরিস্থিতি কাটিয়ে প্রকল্পের কাজে ফের গতি সঞ্চার হচ্ছে।
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (এডমিন এন্ড প্ল্যানিং) জাফর আলম জনকণ্ঠকে বলেন, করোনার কারণে কয়েক মাসের জন্য স্থবিরতা থাকলেও কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া সন্তোষজনক। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনুমোদন পেয়েছে জাপানের প্রতিষ্ঠান নিপ্পন কোয়ি। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর হয়ে যাবে এই মাসের মধ্যে। এরপরই ডিটেইল প্ল্যান বা বন্দরের ডিজাইন করবে নিপ্পন। তারপর ঠিকাদার নিয়োগের মাধ্যমে কাজ শুরু হয়ে যাবে। তবে এখনও মাঠ পর্যায়ের কাজ থেমে নেই। বিশেষ করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য কোল জেটি নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে, যা গভীর সমুদ্র বন্দরকেই এগিয়ে নিচ্ছে। ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ। তবে আমাদের টার্গেট এর আগেই মাতারবাড়িতে জাহাজ ভেড়ানো।
প্রসঙ্গত, দেশের অর্থনীতির আকার বাড়ার কারণে আমদানি-রফতানি যে গতিতে বাড়ছে তাতে চট্টগ্রাম বন্দরের একার পক্ষে চাপ সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। বর্তমানে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ৯২ ভাগ সম্পাদিত হয়ে থাকে এই বন্দর দিয়ে। দেশে গড়ে উঠছে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল, যার মধ্যে চট্টগ্রামে মীরসরাই, সীতাকুন্ড ও ফেনীর সোনাগাজী মিলিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর হবে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম। এই শিল্প নগরে গড়ে উঠতে শুরু করেছে দেশী-বিদেশী অনেক শিল্প কারখানা। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান উৎপাদন শুরু করার কাছাকাছি পর্যায়ে। অনেক সুদূরপ্রসারী চিন্তায় একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার, যা এখন আর স্বপ্ন নয় বরং দৃশ্যমান হতে চলেছে। গভীর সমুদ্র বন্দর, অতীতে যা ছিল কথার কথা তা এখন বাস্তবে রূপ নিচ্ছে।
গভীর সমুদ্র বন্দরের জন্য শুরুতে মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপকে ঘিরে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু মাতারবাড়িতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য জেটি ও চ্যানেল নির্মাণের কাজ শুরু হতেই দেখা দেয় এক অপার সম্ভাবনা। অর্থাৎ সোনাদিয়া নয়, এই মাতারবাড়িতেই হবে গভীর সমুদ্র বন্দর। এতে ব্যয় সাশ্রয়, সহজ কানেক্টিভিটি, পরিবেশ রক্ষা, অধিক গভীরতা সবই পাওয়া যাচ্ছে। ফলে সার্বিক চিন্তায় সরকার সোনাদিয়া থেকে সরে এসে মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে।
গভীর সমুদ্র বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক জাফর আলম জানিয়েছেন, এতে ব্যয় হবে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা, যার বেশিরভাগই দেবে জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা। বাকি অর্থের যোগান দেবে সরকার এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। অগ্রগতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত হয়ে গেছে। এই মাসের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়ে গেলে ডিজাইন ঠিক হওয়ার পর কালক্ষেপণ না করেই ঠিকাদার নিয়োগ করা হবে। ভূমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে চূড়ান্ত অনুমোদনের পর আমরা ভূমি পেয়ে যাব। সেখানে বেশিরভাগ ভূমিই খাস, তবে কিছু ব্যক্তি মালিকানার জমিও রয়েছে, যা অধিগ্রহণ করতে হবে। প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেয়ার পথে আর কোন বাধা নেই বলে জানান চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অন্যতম শীর্ষ এই কর্মকর্তা।
গভীর সমুদ্র বন্দর প্রয়োজন যে কারণে ॥ বাংলাদেশ আয়তনের দিক থেকে বেশি বড় না হলেও জনসংখ্যার দিক থেকে ক্ষুদ্র নয়। এ দেশের পাশেই রয়েছে বিশাল একটি ভূমিবদ্ধ অঞ্চল, যার সমুদ্র বন্দর সুবিধা নেই। দেশে শিল্পায়ন এবং আমদানি-রফতানি ক্রমশ বেড়েই চলেছে। পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশগুলোও বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের সুবিধা গ্রহণে আগ্রহী। দেশে তিনটি সমুদ্র বন্দর থাকলেও চট্টগ্রাম বন্দরের ওপরই মূল চাপ। কারণ ৯২ ভাগ পণ্য এই বন্দর দিয়েই আমদানি-রফতানি হয়ে থাকে। কর্ণফুলী চ্যানেলে অবস্থিত এ বন্দর সমুদ্র থেকে বেশ উজানে। জেটি পর্যন্ত পৌঁছতে একটি জাহাজকে দুটি বিপজ্জনক বাঁক অতিক্রম করতে হয়। ঝুঁকির কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে ১৯০ মিটারের বেশি দৈর্ঘ্যরে জাহাজ ভিড়তে পারে না। তাছাড়া যে ড্রাফটের জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়ে তাতে সর্বোচ্চ ২২শ’ থেকে ২৩শ’ কন্টেনার বহন করা যায়। গভীর সমুদ্র বন্দরে আসতে পারে একসঙ্গে ১২-১৩ হাজার টিইইউএস কন্টেনার ধারণ করা জাহাজ। এই বন্দরে চীন ও সিঙ্গাপুর থেকে সরাসরি বড় জাহাজ আসতে পারবে।
সোনাদিয়া ছেড়ে গভীর সমুদ্র বন্দর মাতারবাড়িতে যে কারণে ॥ স্বপ্নের গভীর সমুদ্র বন্দরের জন্য প্রথমে নির্ধারণ করা হয়েছিল মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপকে। ২০১২ সালে এই প্রকল্পের অনুমোদন হয়। তবে কাজের অগ্রগতি তেমন ছিল না। তখন মাতারবাড়িতে কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য কোল জেটি নির্মাণের কাজটি শুরু হয়নি। কিন্তু সেখানে কয়লা জেটি এবং চ্যানেল নির্মাণের কাজ মাঠ পর্যায়ে গড়াতেই বেরিয়ে আসে সম্ভাবনার উঁকি। সোনাদিয়াতে যেখানে গভীরতা ১৪ মিটার, সেখানে মাতারবাড়ি চ্যানেলের গভীরতা পাওয়া যাবে ১৮ মিটার। অর্থাৎ সোনাদিয়ার চেয়ে অনেক বড় জাহাজ এই বন্দরে ভেড়ানো যাবে। প্রসঙ্গত, ১২ মিটার ড্রাফটের বেশি জাহাজ যে বন্দরে ভেড়ানো যায় সেই বন্দরকে গভীর সমুদ্র বন্দর হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। চট্টগ্রাম বন্দরে সর্বোচ্চ সাড়ে ৯ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে। জাপানী সংস্থা জাইকা ২০১৬ সালে যে সার্ভে করে তাতেই মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করা সম্ভব বলে বেরিয়ে আসে। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সম্ভাব্যতা পরীক্ষাও মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের জন্য ইতিবাচক হিসেবে উঠে আসে।
মাতারবাড়িতে বর্তমানে জাপানের অর্থায়নে কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্রের জেটি নির্মাণের কাজ চলছে। এই জেটি এবং চ্যানেলই সম্প্রসারণ এবং আরও উন্নয়নের মাধ্যমে গভীর সমুদ্র বন্দরে রূপ পাবে। সোনাদিয়ার চেয়ে বেশি গভীরতার জাহাজের জন্যই শুধু নয়, একেবারে কাছাকাছি জায়গায় বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে দুটি সমুদ্র বন্দর করার যৌক্তিকতাও নেই। মাতারবাড়িতে এখন ৩৫০ মিটার চওড়া এবং ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। জেটি নির্মাণের কাজও চলছে। চ্যানেল নির্মাণের এই কাজ এগিয়ে নিচ্ছে মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুত উন্নয়ন প্রকল্প। সেখানে জাহাজ ভিড়বে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অধীনে।
নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী গত ৩১ আগস্ট মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে সিদ্ধান্তের আলোকে জানিয়ে দিয়েছেন, সোনাদিয়া নয়, মাতারবাড়িতেই হবে গভীর সমুদ্র বন্দর। প্রকল্পের ব্যয়, চ্যানেলের গভীরতা, পরিবেশগত বিষয়সহ সামগ্রিক দিক বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে বলে জানান তিনি। এ সময় তিনি সরকারের পরিকল্পনা এবং অগ্রগতির বিভিন্ন দিকও তুলে ধরেন।
গভীর সমুদ্র বন্দর সোনাদিয়া থেকে সরিয়ে মাতারবাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কারণের মধ্যে রয়েছে পরিবেশগত দিকও। সোনাদিয়াকে ‘ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া’ হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেছে পরিবেশ অধিদফতরও। সেখানে বন্দর নির্মিত হলে পরিবেশের আরও ক্ষতি হবে। তাছাড়া সোনাদিয়াতে জনবসতি তুলনামূলকভাবে বেশি। সে তুলনায় মাতারবাড়ি কম জনসংখ্যার এলাকা। ফলে সেখানে পরিবেশের ক্ষতির ঝুঁকিও কম। মাতারবাড়িকে খুব সহজেই জলপথ, স্থলপথ ও রেলপথের সঙ্গে সংযুক্ত করা সম্ভব হবে। সেখানে বন্দর হলে ত্রিমুখী যোগাযোগ অপেক্ষাকৃত সহজ হবে।