করোনার প্রভাবে বৈশ্বিক মন্দার পূর্বাভাস দিয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। এ মন্দার ঢেউ বাংলাদেশেও লাগবে বলে নানা মহল থেকে আশঙ্কা করা হয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শিতায় করোনার ক্ষতি কাটিয়ে অর্থনীতি স্বাভাবিক ধারায় ফিরছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিল্প-কারখানা খুলে দেওয়া ছিল সাহসী পদক্ষেপ। এরপর বড় চমক ছিল লক্ষাধিক কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা। এরই মধ্যে উদ্যোক্তারা এ প্যাকেজের টাকা নেওয়া শুরু করেছেন। এ প্যাকেজের টাকা নিয়ে শ্রমিকদের বেতন দিয়েছেন গার্মেন্ট মালিকরা। পাশাপাশি করোনার মধ্যেও কারখানা চালু রাখায় ইতিমধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে তৈরি পোশাক খাত। পাড়া-মহল্লার দোকান থেকে শুরু করে সুপারশপ, শপিং মল, বড় শিল্প-কারখানার চাকা সচল আছে। এতে ভেঙে পড়েনি উৎপাদনপ্রক্রিয়া। আমদানি-রপ্তানি, উৎপাদন, সরবরাহ, বিপণন, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং পরিবহন চলাচল অনেকটাই স্বাভাবিক হচ্ছে। অর্থনীতি স্বাভাবিক রাখতে প্রধানমন্ত্রীর সহসী পদক্ষেপ বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালসহ অনেকে।
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের মধ্যে বিশ্বের অনেক দেশের প্রবৃদ্ধি যেখানে ঋণাত্মক, সেখানে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী বহুজাতিক সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। ম্যানিলাভিত্তিক সংস্থাটি জানিয়েছে, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৬.৮ শতাংশ। সংস্থাটি জানিয়েছে, চলতি বছর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম মানুষের নাগালের মধ্যেই থাকবে। এডিবি জানিয়েছে, চলতি বছর বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৫ শতাংশের মধ্যেই থাকবে। এডিবি মনে করে, বর্তমান সরকারের সুচিন্তিত সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি করোনা মোকাবেলায় প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
বাংলাদেশে নিযুক্ত এডিবির আবাসিক প্রধান মনমোহন প্রকাশ বলেন, ‘মহামারি থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার পেতে শুরু করেছে। চলমান মহামারির মধ্যেও সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ ও সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা অর্থনীতিকে সুসংহত করেছে।’ করোনাভাইরাসের মধ্যেও বিশ্বব্যাংক, জাইকা, এডিবি, আইডিবিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে করোনার কারণে রাজস্ব আদায় কমলেও উন্নয়ন সহযোগীদের সহযোগিতায় স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কেনাসহ সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড গতিশীল রাখা গেছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কোরবানির ঈদের আগে সরকারের নিষেধাজ্ঞা শিথিল ও গণপরিবহন সচল থাকায় অর্থনীতির সব কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক হচ্ছে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর থেকে প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ের কার্যক্রম সমন্বয় করে আসছেন।
গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন, তা দেশের মোট জিডিপির ৩.৭ শতাংশ। দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, এর সুফল পাচ্ছে ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তা থেকে শুরু করে ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলো। এর ফলে করোনা মহামারির মধ্যে অনেকটাই স্বাভাবিক ধারায় ফিরেছে দেশের অর্থনীতি। সচল হয়ে উঠেছে অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অর্থনীতিতে করোনাভাইরাসের প্রভাব যাতে দীর্ঘস্থায়ী না হয়, সে জন্য অর্থমন্ত্রীকে দিকনির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। প্রণোদনা প্যাকেজে কোনো খাতই যেন বাদ না যায়, সে ব্যাপারে বিশেষ নির্দেশনা ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পেয়ে অর্থমন্ত্রী প্রণোদনা প্যাকেজের পরিকল্পনা করেন। প্যাকেজ ঘোষিত হওয়ার পর তা কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রতিনিয়ত খোঁজখবর নিচ্ছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, শিল্প খাত তথা রপ্তানি খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সও আসছে রেকর্ড পরিমাণ, ঘুরে দাঁড়িয়েছে শেয়ারবাজার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বলছে, চলতি (২০২০-২১) অর্থবছরের শুরুতে ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে প্রবৃদ্ধি। সর্বশেষ গত আগস্টে রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭.৮৫ শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধি গত দুই বছরের একই সময়ের তুলনায় বেশি।
নতুন অর্থবছরের শুরুতে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের রপ্তানি খাতও। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩৪৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার। অথচ এই খাতে আয় হয়েছে ৩৯১ কোটি ডলার। প্রথম মাসেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ১৩.৩৯ শতাংশ।
করোনার মধ্যেও আমদানিতে ইতিবাচক ধারা দেখা যাচ্ছে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় গত জুন মাসে আমদানিতে প্রায় ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী চিহ্নিত হলে শেয়ার বিক্রি বাড়ে, যাতে পুঁজিবাজারে বড় পতন ঘটে। বিনিয়োগ বাড়ানো হলেও পতন থামছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থার তৎকালীন কমিশন শেয়ার দামে ফ্লোরপ্রাইস বেঁধে দেওয়া হয়। এ সিদ্ধান্তে স্বস্তি পায় বিনিয়োগকারীরা। মে মাসে নিয়ন্ত্রক সংস্থার শীর্ষ পদে বড় রদবদল ঘটলে গত আগস্ট থেকে উড়ন্ত গতি পেয়েছে পুঁজিবাজার। নতুন বিনিয়োগকারী প্রবেশের পাশাপাশি বাড়ছে মূলধন। শেয়ারের দামেও উন্নতি হয়েছে।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়্যারম্যান ড. শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দায়িত্ব নেওয়ার পর বিনিয়োগকারীর আস্থা ফেরানো ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জোর দেওয়া হয়। অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে বিনিয়োগকারীরা এখন আবারও পুঁজিবাজারে আসছে।’
করোনাকালে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বড় ভূমিকা রেখে চলেছে কৃষি। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ১৫.৪৪ শতাংশ অবদান কৃষি ও সেবা খাতের। কর্মসংস্থানেও বড় ভূমিকা রাখছে খাতটি। আয় কমে যাওয়ায় শহরত্যাগী মানুষগুলোকেও ধারণ করেছে গ্রামীণ অর্থনীতি।
করোনাভাইরাসের ধাক্কা কাটিয়ে আবাসন খাত ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। অনেক আবাসন প্রতিষ্ঠানের ফ্ল্যাট বিক্রি বেড়েছে। অনেকের বিক্রি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ২০-৩০ শতাংশ কম। আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজেটে বিনা প্রশ্নে কালো টাকা বিনিয়োগের সুবিধা দেওয়ায় করোনাকালের মধ্যেই ফ্ল্যাট বিক্রিতে গতি এসেছে।’
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঈদুল আজহার সময় ১২ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। এ বছর আমাদের মাত্র ৮০০ থেকে এক হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। করোনার মধ্যে এই ঈদে কাঙ্ক্ষিত বিক্রি না হলেও আমরা আবার চালু করতে পেরেছি, এটাই আমাদের স্বস্তি দিয়েছে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ।’
এদিকে করোনাকালে মোবাইলে কেনাকাটার আহ্বান জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর লকডাউনের মধ্যেও মানুষের কাছে নিত্যপণ্য পৌঁছে গেছে ই-কমার্সের মাধ্যমে।
অর্থনীতিবিদ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা যাদের পাওয়ার কথা তারা যাতে পায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। যাঁরা কাজ হারাচ্ছেন, তাঁদের আয়-রোজগারের ব্যবস্থা করতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তার প্রকল্পগুলোকে আরো জোরদার করতে হবে এবং বণ্টনের ক্ষেত্রে যাতে দুর্নীতি না হয়, সেটি দেখতে হবে।’