দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আইন ও বিচার বিভাগ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় এক যুগ ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকারও নানা ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ করেছে। এতে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং বিভাগের পাশাপাশি আইন মন্ত্রণালয় ও বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও অভাবনীয় সাফল্য এসেছে।
করোনাভাইরাসের সময় উচ্চ আদালত ও অধস্তন আদালতে ভার্চুয়াল আদালত গঠন করে বিচার জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে গেছে এই সরকার। গত ১১ মে থেকে সারাদেশে ভার্চুয়াল আদালতের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ৫০ হাজারের বেশি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে। বিচার বিভাগের ইতিহাসে এই প্রথম সর্বোচ্চ আদালতে এখনও ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে বিচারকাজ পরিচালিত হচ্ছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে ভার্চুয়াল আদালতে অনেক সাফল্য পাওয়া গেছে।
গত এক দশকে সারাদেশে মামলা নিষ্পত্তির পরিমাণ বাড়াতে বিচারক নিয়োগ, আইন প্রণয়ন, জনবল কাঠামো বৃদ্ধি, আদালত ভবন নির্মাণসহ নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেলহত্যা মামলার বিচার, যুদ্ধাপরাধের বিচার, বিডিআর হত্যা মামলার বিচার, ২১ আগস্ট হত্যা মামলার বিচারসহ অনেক দুর্নীতি এবং গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর হত্যার বিচার সম্পন্ন হয়েছে এই সরকারের আমলে। আধুনিক ও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর বিচার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে এই সরকার, যা সারাদেশের মানুষের কাছে প্রশংসিত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, বর্তমান সরকার বিচারপ্রার্থী জনগণের ভোগান্তি লাঘবের জন্য একটি আধুনিক বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সারাদেশে বিচারাধীন মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে কার্যকর ও দৃশ্যমান উন্নয়ন সাধিত হয়েছে।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, গত ১১ বছরে আইন অঙ্গন ও বিচার বিভাগে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। এটা সরকারের অনেক বড় সাফল্য। বিচার বিভাগ যে স্বাধীনভাবে কাজ করছে, এটাই তার বড় প্রমাণ।
বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ন বলেন, সরকার বিচার বিভাগে কী উন্নয়ন করেছে, তা দৃশ্যমান। মহামারি করোনার সময় সরকার ভার্চুয়াল আদালত গঠন করে বিচার ব্যবস্থা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক প্রচেষ্টার কারণে জুডিশিয়ারিতে যথেষ্ট উন্নয়ন ঘটেছে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এএম আমিনউদ্দিন বলেন, সরকারের অনেক সাফল্যের মধ্যে বিচার বিভাগের বিভিন্ন সাফল্য অন্যতম। তিনি বলেন, ১৭ কোটি মানুষের দেশে বিচার বিভাগকে আরও উন্নত ও আধুনিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ই-জুডিশিয়ারি বাস্তবায়ন করতে হবে।
ভারপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে বিচার বিভাগ বহুদূর চলে এসেছে। ভার্চুয়াল আদালত এর বড় প্রমাণ। এটা বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন ও যুদ্ধাপরাধীর বিচার: স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরে বর্তমান সরকারের অন্যতম সাফল্য হচ্ছে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করা। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে বিচার করতে ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এ পর্যন্ত আটটি মামলা সর্বোচ্চ আদালতে চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে। ছয় যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত ৪১টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, যা দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য ও প্রশংসিত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা ও জেলহত্যা মামলার বিচার: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার করা হয়েছে। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনি এবং গত এপ্রিল মাসে একজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। বিদেশে পলাতক আরও পাঁচ খুনিকে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।
চাঞ্চল্যকর মামলা নিষ্পত্তি: বর্তমান সরকারের আমলে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, বিডিআর বিদ্রোহ ও হত্যার বিচার, সিলেটের শিশু রাজন হত্যা, খুলনার শিশু রাকিব হত্যা, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলা, জাপানি নাগরিক কুনিও হোশির হত্যা মামলা, সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তা খালাফ হত্যা, ২১ আগস্ট বোমা হামলার মামলা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর ঈশ্বরদীতে বোমা হামলা, গুলশানে হলি আর্টিসান বেকারিতে বোমা হামলা, পুরান ঢাকার বিশ্বজিৎ হত্যা, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা, তারেক রহমানের দুর্নীতির মামলা, গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের দুর্নীতির মামলা, উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ছাত্রী রিশা হত্যা মামলা, সড়ক দুর্ঘটনায় দিয়া খানম মিম ও রাজীবের মামলা, গাইবান্ধার এমপি লিটন হত্যা মামলা, ফেনীর নুসরাত জাহান রাফি হত্যাসহ অসংখ্য আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ মামলার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। যা সবার কাছে প্রশংসনীয় হয়েছে।
মামলা নিষ্পত্তি: ২০০৯ সাল থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশের আদালতগুলোতে এক কোটি ৪২ লাখ মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এই সময় নতুন মামলা দায়ের ও পুনর্জীবিত হয়েছে এক কোটি ৬৩ লাখ মামলা।
আইন প্রণয়ন: ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিভাগের সহযোগিতায় ৫০১টি আইন, ৪৩টি অধ্যাদেশ, চার হাজার ৩৪৭টি এসআরও ইত্যাদি প্রণয়ন করা হয়েছে।
বিচারক নিয়োগ: ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১১ বছরে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ২৪ জন, হাইকোর্ট বিভাগে ৮৭ জন এবং অধস্তন আদালতে এক হাজার ১২৮ বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই সময়ে দুই হাজার ১৪৪ জন বিচারককে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
অবকাঠামো উন্নয়ন: সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের এজলাস ও চেম্বারের অবকাঠামোগত অপ্রতুলতা দূর করতে ২০১৭ সাল থেকে সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় ১৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ১২ তলা ভবন নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। ১১৭ কোটি ৬৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৫ তলাবিশিষ্ট নান্দনিক বার কাউন্সিল ভবন নির্মাণকাজ চলছে। এই সময়ে ১৬২ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে ৪২টি জেলায় জেলা জজ আদালত ভবনগুলোর ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ করা হয়েছে। একাধিক সিজিএম ভবন নির্মাণের পাশাপাশি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ফরিদপুর ও মুন্সীগঞ্জ জেলায় চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনাল বা আদালত স্থাপন: নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ৫৪টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পাশাপাশি আরও ৪১টি ট্রাইব্যুনালে বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সন্ত্রাসবিরোধী মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে সাতটি বিভাগীয় শহরে ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা হয়েছে। ঢাকায় একটি সাইবার ট্রাইব্যুনালও গঠন করা হয়েছে। এভাবে গত ১১ বছরে শতাধিক আদালত বা ট্রাইব্যুনাল সৃজন করা হয়েছে। আরও সহস্রাধিক আদালত বা ট্রাইব্যুনাল সৃজনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। তৃণমূল বিচারপ্রার্থীর দোরগোড়ায় ন্যায়বিচার পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে ৯টি জেলার ১৩টি উপজেলায় ১৯টি চৌকি আদালত স্থাপন করা হয়েছে।
ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্প: দেশের উচ্চতর ও অধস্তন আদালতকে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তিসম্পন্ন হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ‘ই-জুডিশিয়ারি’ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের সহায়তায় আইন মন্ত্রণালয় দুই হাজার ৮৭৬ কোটি টাকার পাঁচ বছর মেয়াদি একটি উন্নয়ন প্রকল্প পরিকল্পনা (ডিপিপি) প্রণয়ন করেছে। প্রস্তাবটি গত ২৩ জুলাই পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) কাছে পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে (একনেক) যাবে। বিচার বিভাগের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় উন্নয়ন প্রকল্প হচ্ছে ই-জুডিশিয়ারি।
বিচারক ও আইন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ: মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে সাড়ে চার হাজার বিচারক, জিপি-পিপি, আদালত কর্মচারীসহ মোট ছয় হাজার ১৭০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জাপান ও চীনে ছয় শতাধিক বিচারক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার সাফল্য: গত ১০ বছরে পাঁচ লাখ ২১ হাজার ৪৮১ জন দরিদ্র-অসচ্ছল মানুষকে বিনামূল্যে আইনগত সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত আইন মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার মাধ্যমে এ সহায়তা দেওয়া হয়। একই সময়ে সংস্থাটি ৫২৫ জন দরিদ্র-অসহায় মানুষের জন্য ৩৮ কোটি ২৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করেছে। পাশাপাশি ৭৯ হাজার আর্থিকভাবে অসচ্ছল কারাবন্দিকে আইনি সহায়তা দেওয়া হয়েছে। একই সময়ে সংস্থাটি এক লাখ ৩০ হাজার ৪৯২টি মামলা নিষ্পত্তি করেছে।
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন: বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের অনুমোদন সাপেক্ষে আইন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আবক্ষ ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। বিশ্বের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ভাস্কর্য স্থাপন এটিই প্রথম।
পরিদপ্তর থেকে অধিদপ্তর ও রাজস্ব আয়: ২০১৮ সালে নিবন্ধন পরিদপ্তর উন্নীত হয়েছে অধিদপ্তরে। সৃজন হয়েছে ৪৯১টি নতুন পদ। এ ছাড়া জেলা রেজিস্ট্রি অফিস এবং সাব-রেজিস্ট্রি অফিসগুলোকে ভৌত অবকাঠামো সুবিধা দিতে ১৮টি জেলা রেজিস্ট্রি অফিস, ৪২টি সাব-রেজিস্ট্রি অফিস ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ২৬৮ জনকে সাব-রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। গত ১১ বছরে নিবন্ধন অধিদপ্তরের মাধ্যমে মোট রাজস্ব আয় হয়েছে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে শক্তিশালী করা: ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন সংসদে পাস করে। এ আইন অনুযায়ী ২০১০ সালে সাত সদস্যবিশিষ্ট কমিশন পুনর্গঠিত হয়। এরপর সরকার মানবাধিকার সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও নিশ্চিত করার সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে কমিশনকে আরও শক্তিশালী করেছে।