আধিপত্যবিস্তার নিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফ-উখিয়ার ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবিরে এখন সংঘর্ষে জড়াচ্ছে অন্তত ১৩টি সশস্ত্র দল, যারা মাদক-বানিজ্য, অপহরণ আর চাঁদাবাজিতেও জড়িত। এরা আগে দা, ছুরি, বলম্বের মতো সাধারণ অস্ত্রশস্ত্র নিয় চলাফেরা করলেও এখন অনেকেরই হাতে দেখা যাচ্ছে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল আর একে-৪৭ এর মতো মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র। অবশ্য পুলিশের দাবি, সবকিছুই আছে তাদেরই নিয়ন্ত্রণে।
২০১৭ সালে সবশেষ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পর প্রথম বছর কিছুটা স্থিতিশীল ছিলো রোহিঙ্গা শিবিরগুলো। কিন্তু বছর ঘুরতেই ক্রমশ শক্তি অর্জন করে নানা অপরাধে যুক্ত হতে শুরু করে রোহিঙ্গারা। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, টেকনাফ ও উখিয়ার ক্যাম্পগুলোতে তৈরি হয়েছে অন্তত ১৩টি সশস্ত্র দল।
সাধারণ রোহিঙ্গাদের অভিযোগ এসব সশস্ত্র গোষ্ঠীর কাছে অনেকটা জিম্মি তারা। দিনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নানামুখী তৎপরতায় কিছুটা চুপচাপ থাকলেও রাতে পাল্টে যায় ক্যাম্পের দৃশ্যপট। চাঁদা, মাদক-বানিজ্য, চোরাচালানসহ বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত এসব সশস্ত্র দল নিজেদের শক্তি জানান দিতে হরহামেশা নির্যাতন করে সাধারণ রোহিঙ্গাদের।
এক বাসিন্দা বলেন, রাতে এখানে আল-ইয়াকিন গ্রুপ এসে আমাদের রেজিস্ট্রাড ক্যাম্পে গুলি মারে।দিনে রাতে আমাদের মারতে থাকে। আমাদের নারী-পুরুষদের পিটিয়ে কি অবস্থা করে রেখেছে।
আরো এক বাসিন্দা বলেন, রাতে আমরা ঘুমাতে পারিনা। আমাদের অযথা মারধর করে। পালিয়ে এদিকে-ওদিক চলে যেতে হয়, রাস্তাঘাটে-ঝোপে লুকিয়ে থাকি। আমরা ১৯৯২ সালে এসেছি। আমার জন্ম এখানে। নিরাপত্তাবাহিনী মাঠে না থাকলে আমাদের কোন নিরাপত্তাই নাই।
নানা অপরাধে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর সদস্যদের বিরুদ্ধে গেল চার বছরে করা প্রায় সাড়ে সাতশ মামলার মধ্যে ৬০টির বেশি খুনের মামলা ও ৬৫টি অস্ত্র মামলা। বিশাল এলাকায় বিপুল জনবসতি, ভৌগলিক দুর্গমতা ও ভাষা জটিলতায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বিভিন্ন উইংকে। তবে পুলিশ বলছে ক্যাম্পে কারো আধিপত্য সহ্য করা হবে না।
২০১৭ সালে মামলার সংখ্যা ছিলো ৭৬টি এবং আসামী ১৫৯ জন। একই ভাবে ২০১৮ সালে মামলার সংখ্যা ২০৮টি এবং আসামী ৪১৪ জন। ২০১৯ সালে মামলা বেড়েছে ২৬৩টি এবং আসামী হচ্ছে ৬৪৯ জন। ২০২০ (প্রথম ১০ মাস) ১৮৪ মামলা এবং আসামী ৪৪৯ জন।
সন্ত্রাসী গোষ্ঠি উখিয়ার কুতুপালং গ্রুপ: মুন্না গ্রুপ, আনাস গ্রুপ, মাহাদ গ্রুপ, সালাম বা সালমান শাহ গ্রুপ, হাফেজ আহমদ গ্রুপ।
টেকনাফ এ গ্রুপ: হাকিম ডাকাত, নুরে আলম বাহিনী, জকির ডাকাতের গ্রুপ।
দুই শিবিরে সক্রিয়: আরসা, আল ইয়াকিন, আরাকান রোহিঙ্গা আর্মি, আতাউল্লাহর বাহিনী, আরওসও, আরআর এস ও।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, নিজেদের আধিপত্য এবং শক্ত অবস্থানই মাদক ও মানবপাচারের আন্তর্জাতিক চক্রগুলোর কাছে এসব সশস্ত্র দলের গুরুত্ব বাড়ায়। সেজন্য মরিয়া এসব বিবাদমান পক্ষ। তাই এদের প্রতিরোধে ক্যাম্পের ভেতর গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো দরকার বলে মতামত তাঁদের।
রোহিঙ্গাদের এসব হানাহানি চরম নিরাপত্তাহীনতায় ফেলেছে টেকনাফ-উখিয়ার প্রায় তিন লাখ স্থানীয়দেরকেও। গত ৩ বছরে পুলিশসহ আইনরক্ষা বাহিনীর সাথে গোলাগুলিতে মারা গেছেন শতাধিক রোহিঙ্গা।