করোনার এই মহামারীকালেও গতিশীল হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। উদ্যোক্তাদের প্রচেষ্টা, শ্রমজীবী মানুষের পরিশ্রম ও সরকারের সহযোগিতা এই তিন উদ্যোগ এক হওয়ায় অর্থনীতির চাকা স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও জোরে ঘুরছে। এক্ষেত্রে সাহস যোগাচ্ছে গার্মেন্টস শ্রমিকদের কষ্টের বিনিময়ে অর্জিত রফতানি আয় এবং প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় নিয়ে আশাবাদী পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলেন, ‘রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় যেভাবে বাড়তে শুরু করেছে, এভাবে চলতে থাকলে অর্থনীতির অন্যান্য খাতগুলোও সচল হয়ে ঘুরে দাঁড়াবে। তবে তার দৃষ্টিতে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে ঠিক রাখতে বড় শক্তি হিসেবে ভ‚মিকা রাখছে গরিব কৃষকদের উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের পণ্য। কারণ, এখনো কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। এখনো বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস কৃষি। কৃষকরা যদি খাদ্য উৎপাদন না করতো, তাহলে বড় বিপদ হতো।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত টানা তিন মাসে রেমিট্যান্সে রেকর্ড প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৬৭১ কোটি ৩১ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ বেশি।
করোনাকালীন সময়ে প্রবাসীদের পাঠানো এই রেমিট্যান্স প্রবাহ অর্থনীতির গতিকে আরো গতিশীল করেছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ড. জায়েদ বখত। তিনি বলেন, ‘প্রবাসীদের এই অবদান সংকট মোকাবিলায় সাহস যোগাচ্ছে।’
একইসঙ্গে রফতানি আয়ও সংকটকালীন সময়ে সাহস যোগাচ্ছে বলে তিনি মনে করেন। তিনি উল্লেখ করেন, উদ্যোক্তাদের প্রচেষ্টা, শ্রমজীবী মানুষের পরিশ্রম ও সরকারের সহযোগিতা এই তিন শক্তি এক হওয়ায় অর্থনীতির চাকা স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও জোরে জোরে ঘুরছে। এত অল্প দিনে সংকটে পড়া অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোকে বাঙালির ঐতিহ্যগত কারণ বলে মনে করেন তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত সেপ্টেম্বর মাসে ২১৫ কোটি ১০ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স। এর আগে গত জুলাই মাসে ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিল প্রবাসীরা, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে, গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে এবছরের সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স বেড়েছে ৪৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। বিভিন্ন দেশ থেকে এক কোটির বেশি বাংলাদেশির পাঠানো এই রেসিট্যান্সের অবদান জিডিপিতে ১২ শতাংশের মতো।
এদিকে করোনার মধ্যেও ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বিভিন্ন পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ প্রায় ১০ বিলিয়ন (এক হাজার কোটি) ডলার আয় করেছে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে আরো বেশি ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসে ৩৯১ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছিল। সেপ্টেম্বরে এর পরিমাণ ৩০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। তিন মাসে মোট ৯৮৯ কোটি ডলারের বেশি পণ্য রফতানি হয়েছে।
বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ও এফবিসিসিআইর সহ-সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘করোনার কারণে স্থগিত হওয়া পণ্যগুলো এখন রফতানি হচ্ছে। একইসঙ্গে নতুন পণ্যও রফতানি হচ্ছে। এর ফলে এ সময় রফতানি কম হওয়ার মৌসুম হলেও রফতানি বাড়ছে।’
রফতানি আয় এভাবে বেড়ে যাওয়ায় অর্থনীতির অন্যান্য খাতও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যও বলছে, চলতি (২০২০-২১) অর্থবছরের শুরুতে ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে প্রবৃদ্ধি। সর্বশেষ গত আগস্টে রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধি গত দুই বছরের একই সময়ের তুলনায় বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের (২০১৯ সালের) আগস্টে রাজস্ব আয়ের কোনো প্রবৃদ্ধিই ছিল না। উল্টো আগের বছরের (২০১৮ সালের) তুলনায় প্রবৃদ্ধি কমেছিল ৫ শতাংশ। আর ২০১৮ সালের আগস্টে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল মাত্র ২ দশমিক ৯৮ শতাংশ।