একটি ওয়েবিনারে এক ভদ্রমহিলা খুবই নির্বিকার গলায় বললেন, ‘ধর্ষিতার জন্য আইনটি বদল করা হোক। ধর্ষকের নয়, ধর্ষিতার জন্য ফাঁসির দণ্ড ঠিক করা হোক। এ সমাজে বেঁচে থেকেও সে তো মৃতপ্রায়। সমাজে তার সত্যি অর্থে বাঁচার আর কোনো সুযোগ থাকে না। তাই তাকে মরার সুযোগ দিয়ে বেঁচে যাওয়ার পথ করে দেয়া হোক।’অসহায়ত্বের এর থেকে নীরব কান্না আর কী হতে পারে। এই ওয়েবিনারটি যখন দেখি, সে সময়ে ‘সারাক্ষণ’-এর লিড নিউজ- ভিপি নুর, ধর্ষকসহ তার ছয় সহযোগীকে গ্রেপ্তারের দাবিতে নির্যাতিতা অনশনে বসে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য চত্বরে। যিনি শ্লীলতাহানির শিকার হয়ে ৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় অনশনে বসেছেন, তার চোখে পানি আছে কি না, তা কেউ জানে না। যারা তার কাছে আছেন, তারাও হয়তো দেখেননি। তবে বাস্তবে ওয়েবিনারের ওই ভদ্রমহিলার কথা ধরে বলা যায়, তারও চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। তিনিও জেনেছেন, ‘আমি বেঁচে থেকেও আজ মৃত। তারপরও আমি রাষ্ট্রের কাছে, সমাজের কাছে এই অন্যায়ের বিচার চাই।’
তার এই অনশন প্রত্যেক বিবেকবান মানুষের মুখের খাবারকে বিস্বাদ করে দেয়। সবাই এক নীরব অনশনে চলে যেতে বাধ্য হয়। কারণ, যিনি অনশনে বসে আছেন, তিনি কারো মেয়ের মতো, কারো বোনের মতো, কারো ভালোবাসার মানুষের মতো। অথচ তিনি আজ শুধু সব হারিয়ে অসহায় এক নারী। আর তাকে অসহায় করেছে তারই বন্ধুরা। বন্ধুরা তাকে এই অসহায়, মৃতপ্রায় জীবনে নিয়ে গেছে। আর সেই বন্ধুবেশী দুর্বৃত্তদের আশ্রয় দিচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিপি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ভিপি এত জঘন্য কাজ কখনোই করেননি। বরং বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সবাই উজ্জ্বল ছিলেন। পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক জীবনে হয়তো অনেকের পদস্খলন হয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ও ভিপি পদকে কখনোই কেউ এই দুর্বৃত্ত পালনের অবস্থানে নিয়ে যাননি।
হ্যাঁ, অতীতের সব ভিপিই অনেক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তারা অনেক স্বৈরশাসককে গদি থেকে টেনে নামানোর মূল ভূমিকা পালন করেছেন। অথচ ভীরুর মতো, কাপুরুষের মতো শুধু নয়, নষ্ট চরিত্রের মানুষের মতো তারা কেউ কোনো দিন ভাবেননি নারী নির্যাতকদের পক্ষে তারা থাকবেন। শুধু এখানেই শেষ নয়, নির্যাতিতা যিনি অনশন করছেন, তিনি এর আগে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন, ভিপি নুরের কাছে বিচার চাইলে তিনি তাকে বলেছেন বিচার চাওয়া থেকে সরে আসতে। তা নাহলে তিনি তাকে পতিতা হিসেবে চিহ্নিত করবেন। তার অনেক ফলোয়ার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। নুরের এ কথার পরে মানুষের বিবেকের কাছে স্বাভাবিকই প্রশ্ন আসে, অসহায় বিচারপ্রার্থী নারীকে যে ক্ষমতাধর এ কথা বলতে পারেন, তাকে প্রকাশ করা যায় কোন শব্দে- পাষণ্ড না পিশাচ!
আর এর পরে রাষ্ট্রের কাছে, প্রশাসনের কাছে একটিই প্রশ্ন আসে, নুরের ক্ষমতার কাছে তারা কেন অসহায়! কেন ২০ দিনের বেশি হয়ে যাচ্ছে, তারপরও নির্যাতিতার অভিযোগ তদন্ত করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না? রাষ্ট্র বা প্রশাসনের এতটা দুর্বলতা সঠিক নয়। রাষ্ট্র ও প্রশাসন এত দুর্বল হলে মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে। ওই নির্যাতিতাও তাই বাধ্য হয়েছেন অসহায়ের শেষ অস্ত্র অনশনের পথে যেতে। যেখানে আজ ধর্ষণ বন্ধ করতে ধর্ষককে জামিন দিতে হলে ধর্ষিতার মতামত লাগবে বলে রায় দিচ্ছেন কোনো কোনো দেশের হাইকোর্ট। আর নুরের ক্ষমতার কারণে আজ কিনা ধর্ষকদের গ্রেপ্তারের দাবিতে অনশন করতে হচ্ছে নির্যাতিতাকে! এ দেশের পচে যাওয়া একশ্রেণির রাজনীতিক ও তাদের অনুসারীরা হয়তো নুর ও তার সহযোগীদের আইনের আওতায় নিলে সেটাকে ভিন্ন রং দেবেন। কিন্তু রাষ্ট্র ও প্রশাসন কি সেই সমালোচনার ভয় করবে, না একজন অসহায় নারীর পাশে দাঁড়াবে? বাস্তবে এই অনশন যদি দীর্ঘ হয়, এই দুর্বৃত্তরা যদি বিচারের আওতায় না যায়, তাহলে সমাজের বিবেকবান মানুষের কাঁধে তখন দায়িত্ব নিতে হবে। আর যদি উচ্চ আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ দায় নেন, সেটা হবে অনেক শুভ পদক্ষেপ। তাহলে সবাই আদালতের প্রতি আবারও মাথা নত করবে শ্রদ্ধায়। তবে দায়িত্ব যে-ই পালন করুক না কেন, দ্রুত করতে হবে। চোখের সামনে এভাবে নির্যাতিতা যখন অনশন করেন, তখন কতটুকু অবশিষ্ট থাকে আর আমাদের!