দেড় হাজার কোটি ডলারের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ নিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছে শ্রীলংকার অতিজাতীয়তাবাদী সরকার। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ঋণ গ্রহণের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে চীনকেই বেছে নিয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপদেশটি। বৈদেশিক বাণিজ্যে ঋণখেলাপ ঠেকাতে বর্তমানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বেইলআউটের পরিবর্তে বেইজিংয়ের কাছ থেকে ধার নেয়াকেই শ্রেয় মনে করছে দেশটি। খবর নিক্কেই এশিয়া।
বৈদেশিক বাণিজ্যের ঋণ পরিশোধ করতে অতিসত্বর বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন লংকান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের সরকারের। এজন্য চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের কাছ থেকে ১২০ কোটি ডলারের একটি সিন্ডিকেটেড ঋণও নিচ্ছে কলম্বো। ঋণচুক্তির অংশ হিসেবে চলতি বছরের শুরুর দিকে শ্রীলংকাকে প্রায় ৫০ কোটি ডলার দিয়েছিল বেইজিং।
শ্রীলংকার অর্থ ও পুঁজিবাজার এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের সংস্কারবিষয়ক মন্ত্রী অজিত নিভারদ কাবরাল বলেন, আমরা চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছি। বর্তমানে অবশিষ্ট ৭০ কোটি ডলার নিয়ে আলোচনা চলছে।
লংকান সরকার বলছে, এ অর্থের প্রয়োজন হবে চলতি বছরের শেষ দিকে। অজিত নিভারদ কাবরাল বলেন, শ্রীলংকার সামনে দ্বিপক্ষীয় অংশীদারদের কাছ থেকে অর্থগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। এ সুযোগ বাস্তবে রূপ নেবে বলে আমরা আশাবাদী।
শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এ গভর্নর বলেন, যদি আমরা আইএমএফের দিকে হাত বাড়াই বা সংস্থাটি আমাদের দিকে হাত বাড়ায়, তাহলে আমি মনে করি সেটা হবে বিপদের ইঙ্গিতবাহী। আমাদের ঋণ পরিস্থিতিকে যে নিয়ন্ত্রণে আনা প্রয়োজন সেটা আমরা জানি। কিন্তু সেটা কি আমাদের আইএমএফের কাছ থেকে শুনতে হবে? না।
আইএমএফের সঙ্গে কলম্বোর অতীত ইতিহাস কিছুটা জটিল। ঋণের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে সংস্থাটির বদলে চীনকে বেছে নেয়ার পেছনে এ অতীত কিছুটা প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। ৫৫ বছরের মধ্যে ১৬ বার ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক সংস্থাটির বেইলআউটের প্রয়োজন পড়েছে শ্রীলংকার। এর মধ্য দিয়ে শ্রীলংকা হয়ে উঠেছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চসংখ্যক আইএমএফ বেইলআউট গ্রহণকারী দেশ। বিশ্বের ঋণজর্জরিত দেশগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত শ্রীলংকার চেয়ে বেশিসংখ্যক বেইলআউট প্রয়োজন পড়েছে শুধু পাকিস্তানের, ২০ বার।
এখন পর্যন্ত শ্রীলংকায় আইএমএফের ১৬টি বেইলআউট প্রোগ্রামের মধ্যে সফলভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে মোটে নয়টি। সর্বশেষ ২০১৬ সালে মধ্যডানপন্থী কোয়ালিশন সরকারের সময়ে বেইলআউটের জন্য আইএমএফের দ্বারস্থ হয়েছিল কলম্বো। ওই সময় সম্প্রসারিত ঋণ সুবিধা হিসেবে সংস্থাটির কাছে ১৫০ কোটি ডলারের তহবিল চেয়েছিল দেশটি। পরে ওই বছরের নভেম্বরের নির্বাচনে জয়লাভ করে মাহিন্দর রাজাপাকসের প্রশাসন ক্ষমতাভার তুলে নেয়ার পর কার্যক্রমটির আকস্মিক ইতি ঘটে।
কলম্বোভিত্তিক থিংকট্যাংক ভেরাইট রিসার্চের নির্বাহী পরিচালক নিশান ডি মেল জানান, আইএমএফের সঙ্গে শ্রীলংকার সম্পর্ক অনেকটা দ্বিমুখী। এখানে ধরেই নেয়া হয়, আরেক ব্রেটন উড প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংকের মতো আইএমএফও সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিকতার ফাঁদ পাতায় ব্যস্ত। তিনি বলেন, শ্রীলংকার রাজনৈতিক ঘরানার একাংশ আইএমএফকে সন্দেহের চোখে দেখে। এখানে মনে করা হয়, সংস্থাটির কাছে গেলে তার ফলাফল হবে নেতিবাচক।
শ্রীলংকায় রাজাপাকসের সরকার ক্ষমতায় এসেছে মূলত উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনার উত্থানকে কাজে লাগিয়ে। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কয়েকশ কোটি ডলারের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পাশাপাশি বার্ষিক ১১০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ চলতি হিসাব ঘাটতি পূরণের বিষয়টি রাজাপাকসে সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে।
২০১৮ সালে চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের কাছ থেকে এক দফা সিন্ডিকেটেড ঋণ নেয় শ্রীলংকা। কলম্বোভিত্তিক ব্যাংকিং খাতসংশ্লিষ্ট এক সূত্রের বরাত দিয়ে নিক্কেই জানাচ্ছে, ওই বছরের আরেকটি চীনা ব্যাংক দেশটির ১০০ কোটি ডলার মূল্যের সরকারি বন্ড কিনে নেয়ার প্রস্তাব দেয়। যদিও তত্কালীন সরকার ‘বৈচিত্র্যের সুরক্ষা নিশ্চিতের’ কথা বলে ওই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। এর মাধ্যমে পুরোপুরি চীনা বাধ্যবাধকতার অধীনে চলে আসার বিষয়টিও এড়িয়েছিল কলম্বো।
চলতি মাসে দেশটির জাতীয় ঋণ পরিস্থিতির দুর্দশার চিত্র আরেকবার প্রকট হয়ে ওঠে। আন্তর্জাতিক সরকারি বন্ডের মেয়াদ পূরণ হয়ে পড়ায় সেই দেনা শোধের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে হাত দিতে বাধ্য হয় কলম্বো। এর ফলে শ্রীলংকার মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে এসেছে ৬৪০ কোটি ডলারে। বর্তমানে আরো বড় পরিমাণে ঋণ শোধের চাপে পড়তে যাচ্ছে দেশটি। আগামী তিন বছর ধরে দেশটিকে বার্ষিক ৪৫০ থেকে ৫০০ কোটি পরিমাণে ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
শ্রীলংকার মোট ৮ হাজার ৮০০ কোটি ডলার ব্যাপ্তির সার্বিক অর্থনীতির চিত্র বর্তমানে বেশ হতাশাব্যঞ্জক অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। গত বছর দেশটির সরকারি ঋণের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে মোট জিডিপির ৮৩ শতাংশে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ এ ঋণের পরিমাণ মোট জিডিপির আকারকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে দেশটির বার্ষিক গড় বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার কোটি ডলারে। চলতি বছর মহামারীর কারণে বাণিজ্যে ভাটা না পড়লে এ অংকটি আরো বড় হওয়ার আশঙ্কা ছিল।
জুনের হিসাব অনুযায়ী, শ্রীলংকার মোট বিদেশী ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ৮০ কোটি ডলার। এর মধ্যে শুধু চীনেরই অবদান ১০ শতাংশ। এ চীনা ঋণের অধিকাংশই নেয়া হয়েছে গত এক দশকে, ব্যাপকমাত্রায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন চালাতে গিয়ে। এছাড়া শ্রীলংকার কাছে জাপানের পাওনার পরিমাণও প্রায় ৪৪০ কোটি ডলার। চীনের আগে জাপানই ছিল শ্রীলংকার অবকাঠামো খাতের বৃহত্তম ঋণদাতা দেশ।
এর বাইরেও প্রচুর ঋণ নেয়ার চেষ্টা চালিয়েছিল শ্রীলংকা, কিন্তু ঋণমানে পিছিয়ে থাকার কারণে দেশটির এসব প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে। মুডি’স ইনভেস্টরস সার্ভিস সম্প্রতি দেশটির ঋণমান দুই ধাপ অবনমন করে বি২ থেকে সিএএ১-এ নামিয়ে এনেছে। ফলে দেশটির জারি করা বন্ডের মানও নেমে এসেছে জাঙ্ক স্ট্যাটাসে। কভিড-১৯ মহামারীর প্রাদুর্ভাবের আগে দেশটির অর্থনীতির ব্যাপ্তি বাড়ছিল মোটে দশমিক ৫ শতাংশ হারে। এপ্রিলে ফিচ রেটিংস দেশটির অর্থনীতি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশের পাশাপাশি ঋণমান নামিয়ে এনেছিল বি১-এ।