ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর বলেছেন, ‘আমি চ্যালেঞ্জ করে বলছি, আমার বিরুদ্ধে দুটি অভিযোগ। প্রধানত, তাঁকে (মামলার বাদী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী) আমি পতিতা বলে হুমকি দিয়েছি। যদি প্রমাণ করতে পারে, স্বেচ্ছায় ফাঁসি নেব। দ্বিতীয়ত, যদি প্রমাণ করতে পারে, তাঁর সঙ্গে আমার নীলক্ষেতে দেখা হয়েছিল বা মীমাংসার জন্য তাঁর সঙ্গে নীলক্ষেতে বসেছিলাম। এই দুটো অভিযোগের একটাও যদি প্রমাণ করতে পারে, স্বেচ্ছায় ফাঁসি নেব। লাইভে এসে বললাম।’
গতকাল সোমবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুক লাইভে এসে নুর এসব কথা বলেন। লাইভে ডাকসুর সাবেক ভিপি দুটি মামলার অভিযোগ খণ্ডন, মামলার বাদী ও তাঁর অনশন নিয়েও কথা বলেন। এক ঘণ্টা ২২ মিনিটের লাইভে নুর ওই ছাত্রীকে ‘দুশ্চরিত্র’ বলেও উল্লেখ করেন। তাঁর এই মন্তব্য নিয়ে এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে।
গত ২০ সেপ্টেম্বর প্রথমে ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে, পরের দিন ২১ সেপ্টেম্বর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে নুর ও তাঁর সহকর্মীদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের চতুর্থ বর্ষের এক ছাত্রী। তিনি গত বৃহস্পতিবার থেকে টিএসটির সামনে সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অনশন করছেন। অনশন চলাকালে গতকাল সোমবার নুরের দুই সহকর্মী- বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক নাজমুল হাসান সোহাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র অধিকার পরিষদের সহসভাপতি নাজমুল হুদাকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে নেয় পুলিশ।
তবে নুরসহ মামলার অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে অনশনে অনড় রয়েছেন মামলার বাদী। এ রকম একটি পরিপ্রেক্ষিতেই ডাকসুর সাবেক এই ভিপি গতকাল ফেসবুক লাইভে আসেন।
এ সময় মামলার অন্যতম আসামি ও ছাত্র অধিকার পরিষদের সাবেক নেতা হাসান আল মামুন ও নাজমুল হাসান সোহাগের বিষয়ে নুরুল হক নূর বলেন, ‘আমরা বারবার বলছি, আবারও বলছি, হাসান আল মামুন ও নাজমুল হাসান সোহাগের দায়ভার আমরা নেব না। কারণ হাসান আল মামুন ও নাজমুল হাসান সোহাগের বিষয়ে আমরা বিস্তারিত জানি না। হাসান আল মামুন বলেছেন, তাঁরা একই বিভাগের ছাত্র, তাঁর সঙ্গে তাঁর (ছাত্রীর) পরিচয় ছিল। কিন্তু ধর্ষণ বা শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে কি না- এ বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। আমাদের কাছে কিছুই বলেননি। যেহেতু তাঁর সাথে পরিচয় ছিল, সেখানে কিছু হতে পারে, সেটা একেবারেই উড়িয়ে দেব না। আবার হাসান আল মামুন মেয়েটিকে চিনতেন বলেও স্বীকার করেছেন।’
‘আর মেয়েটির ভাইও বলেছিল, নাজমুল হাসান সোহাগ তাদের বাসায় যাওয়া-আসা করত। তাদের সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তাও পাকাপোক্ত হয়েছিল। তবে আমাদের সহযোদ্ধা ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের আশ্বস্ত করতে পারি যে, ডাকসুর ভিপি নুর, সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম, আব্দুল্লাহ হিল বাকি ও নাজমুল হুদা- এই চারজনের ঘটনার সঙ্গে কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।’
‘এত নাটক করছে, যেই দুশ্চরিত্র’
ফেসবুক লাইভে ওই ছাত্রীকে ‘দুশ্চরিত্র’ মন্তব্য করে নুর বলেন, ‘নাজমুল হাসান সোহাগের সঙ্গে যে একটা ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে আপনারা দেখেছেন, লঞ্চের কেবিনে হাসিখুশিভাবে। যে লঞ্চের কেবিনে মেয়েটি ধর্ষণের অভিযোগটি এনেছিল, সেই লঞ্চের কেবিনে। একেবারেই হাস্যরসাত্মক, ছিঃ! আমরা ধিক্কার জানাই যে, এত নাটক করছে, যেই দুশ্চরিত্র। যে ধর্ষণের নাটক করছে। স্বেচ্ছায় একজন ছেলের সঙ্গে বিছানায় গিয়ে, লঞ্চে হাসিখুশিভাবে।’
এ সময় নুর আরো বলেন, ‘লঞ্চে পাশাপাশি কেবিন। লঞ্চের কেবিনে ধর্ষণ করা সম্ভব? একটা চিল্লানি দিলে তো আশপাশের মানুষ জড়ো হয়ে যায়। তারপর ধর্ষণ করে তারা নিচে নামে নাই? সেখানে মানুষের কাছে বলতে পারত না? ভাই সোহাগ আমাকে ধর্ষণ করেছে, তাকে ধরেন।’
মামলার অভিযোগের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ডাকসুর সাবেক ভিপি বলেন, ‘ধর্ষণ করেছে জানুয়ারি মাসে। এত দিন মামলা করতে পারে নাই? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে একটা লিখিত অভিযোগ দিতে পারে নাই? প্রক্টরের কাছে একটা লিখিত অভিযোগ দিতে পারে নাই? থানায় একটা মামলা করতে পারে নাই? এগুলো অনেক বিষয় আছে।’
‘ছাত্রলীগ তাকে দিয়ে এগুলো করাচ্ছে’
গতকাল সোমবার সকালে অনশনকারী ওই ছাত্রী বলছিলেন, অনশনের সময় তিনি অসুস্থ হয়েছিলেন এবং হাসপাতালে গিয়েছিলেনও। কিন্তু হাসপাতালে না থেকে তিনি ফের অনশনস্থলে ফিরে আসেন। তিনি আরো বলেন, ‘চিকিৎসক আমাকে স্যালাইন দিচ্ছেন। কিছু ওষুধ দিয়েছেন, সেগুলো খাচ্ছি। এ ছাড়া আর কিছু খাওয়ার রুচি হচ্ছে না। প্রথমত মানসিকভাবে বিপর্যস্ত আছি।’
তবে নুরের অভিযোগ ছাত্রলীগ ওই ছাত্রীকে দিয়ে এসব করাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর কোনো দেশে এমন অনশন দেখেছেন? ফ্যান চলে, স্যালাইন চলে, নাস্তার প্যাকেট, খাবার এবং সেখানে ছাত্রলীগ নেত্রীরা। ছাত্রলীগ ছাড়া কেউ নেই তার পাশে। ছাত্রলীগ তাকে দিয়ে এগুলো করাচ্ছে। কাজেই তাঁর কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারি। কোনো প্রমাণ ছাড়া আমার চরিত্রহনন করার চেষ্টা করছে, আমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে কালিমা লেপনের চেষ্টা করা হচ্ছে। সেই দিক থেকে আমি যা বলেছি তা যথাযথ, অবান্তর কিছু নয়।’
ছাত্রীর মামলার এজাহারে যা আছে
গত ২০ সেপ্টম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্রী ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) লালবাগ থানায় ধর্ষণ ও ধর্ষণে সহযোগিতার অভিযোগে নুরুল হক নুরসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পরের দিন ২১ সেপ্টম্বর পরস্পর যোগসাজশে অপহরণ করে ধর্ষণ, ধর্ষণে সহায়তা এবং হেয়প্রতিপন্ন করে ডিজিটাল মাধ্যমে অপপ্রচার করার অভিযোগ একই ব্যক্তিদের আসামি করে ডিএমপির কোতোয়ালি থানায় আরেকটি মামলা করেন ওই ছাত্রী।
লালবাগ থানায় করা মামলার আসামিরা হলেন বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন (২৮), যুগ্ম আহ্বায়ক নাজমুল হাসান সোহাগ (২৮), ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর (২৫), ছাত্র অধিকার পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম (২৮), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র অধিকার পরিষদের সহসভাপতি নাজমুল হুদা (২৫) ও আব্দুল্লাহিল বাকি (২৩)। কোতোয়ালি থানায় করা মামলায় নাজমুল হাসান সোহাগকে ১ নম্বর ও হাসান আল মামুনকে ২ নম্বর আসামি করা হয়। দুটি মামলায় নুরকে ৩ নম্বর আসামি করা হয়।
মামলার এজাহারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্রী উল্লেখ করেন, ‘আসামি হাসান আল মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সপ্তম ব্যাচের ছাত্র। তিনি আমার ডিপার্টমেন্টের বড় ভাই এবং বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের সুবাদে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই মামুনের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি হয় এবং পরে তা প্রেমের সম্পর্কে গড়ায়। এর ধারাবাহিকতায় আসামির সঙ্গে আমার বিভিন্ন সময়ে মেসেঞ্জার, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে কথোপকথন হয়। সেখানে আসামি আমাকে শারীরিক সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় আসামি এ বছরের ৩ জানুয়ারি দুপুর ২টার দিকে তার বাসা নবাবগঞ্জ বড় মসজিদ এলাকায় যেতে বলে এবং আমাকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তার বাসায় ধর্ষণ করে।’
এজাহারে আরো বলা হয়েছে, ‘ঘটনার পর গত ৪ জানুয়ারি আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। ১২ জানুয়ারি আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মামুনের বন্ধু সোহাগের মাধ্যমে ভর্তি করানো হয়। হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায় আমি ক্যাম্পাস রিপোর্টারদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলে মামুন ও সোহাগ বাধা দেয়। এর আগে মামুনকে বিয়ের জন্য চাপ দিলে সে রাজি হয়, কিন্তু আমি অসুস্থ হওয়ার পর সে নানা টালবাহানা শুরু করে।’
উপায়ান্তর না দেখে গত ২০ জুন বিষয়টি ভিপি নুরকে মৌখিকভাবে জানাই উল্লেখ করে এজাহারে আরো বলা হয়, ‘নুর বলেন, মামুন আমার সহযোদ্ধা। তাঁর সঙ্গে বসে একটা সুব্যবস্থা করে দেব। এরপর ২৪ জুন মীমাংসার আশ্বাস দিয়ে তিনি আমার সঙ্গে নীলক্ষেতে দেখা করতে আসেন। কিন্তু মীমাংসার বিষয়টি এড়িয়ে আমাকে এ বিষয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেন। আমি যদি বাড়াবাড়ি করি, তাহলে তাঁর ভক্তদের দিয়ে ফেসবুকে আমার নামে উল্টাপাল্টা পোস্ট করাবে এবং আমাকে পতিতা বলে প্রচার করবে বলে হুমকি দেয়। তাদের ছাত্র অধিকার পরিষদের ১১ লাখ সদস্যের গ্রুপে এ প্রচারণার হুমকি দেওয়া হয়। নুর আরো বলেন, তার একটি লাইভে আমার সব সম্মান চলে যাবে। ইতোমধ্যে মামলার চার নম্বর আসামি সাইফুল ইসলাম আমার নামে কুৎসা রটিয়েছে এবং ৫ ও ৬ নম্বর আসামিকে লাগিয়ে দেয় কুৎসা রটাতে। তারা মেসেঞ্জার চ্যাট গ্রুপে আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করাসহ সম্মিলিতভাবে চক্রান্ত করে।’
এজাহারে বাদী আরো বলেন, ‘ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতা পর্যায়ের কয়েকজন বিষয়টির সুষ্ঠু সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করতে চাইলেও আসামিরা তাদের ষড়যন্ত্রকারী বলে আখ্যা দেয়। এরপর আমি শারীরিক-মানসিকভাবে অসুস্থ থাকায় এবং আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে বলার কারণে মামলা করতে বিলম্ব হয়েছে।’