- প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে তিন মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত উদ্যোগ
- আগামী মৌসুম থেকেই নতুন উদ্যোগ বাস্তবায়ন আমদানি বন্ধ হলে সাশ্রয় হবে ২ হাজার কোটি টাকা গ্রীষ্মকালীন জাত উদ্ভাবন করা হবে
এম শাহজাহান ॥ পর পর দুই বছর পেঁয়াজ সঙ্কটে নড়ে চড়ে বসেছে সরকার। আগামী দু’বছরের মধ্যে পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে বিশেষ কর্মকৌশল প্রণয়ন করা হয়েছে। আর আমদানি নয় বরং এখন থেকে উৎপাদন বাড়িয়ে প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটিয়ে রফতানির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে তিন মন্ত্রণালয় গ্রহণ করেছে সমন্বিত উদ্যোগ। এই কর্মসূচীর মূল্য লক্ষ্য চাহিদা মতো পেঁয়াজ উৎপাদন। তিন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে রয়েছে বাণিজ্য, কৃষি এবং অর্থ মন্ত্রণালয়। বাণিজ্য মন্ত্রনালয় সূত্র জানায়, পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নির্দেশে একটি কর্মকৌশল প্রণয়ন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। পরে তা কৃষি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কর্মকৌশল বাস্তবায়নে অর্থের প্রয়োজন হবে। এজন্য এর সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়কেও যুক্ত করা হয়। তিন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বসে একটি সমন্বিত কর্মকৌশল নির্ধারণ করেন। শীঘ্রই তা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হবে। নতুন এই কর্মকৌশলে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়াতে যেসব কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, বীজের সরবরাহ বাড়ানো, চাষাবাদে ভূমির পরিমাণ বৃদ্ধি করা, সংরক্ষণে হিমাগার নির্মাণ, কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে সঠিকভাবে বাজারজাতকরণ ও গ্রীষ্মকালীন উৎপাদনে গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করা। পেঁয়াজ উৎপাদনে সমৃদ্ধ চার জেলাকে নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বীজ, সার, কীটনাশক কেনায় বিশেষ ভর্তুকি পাবেন কৃষকরা। এছাড়া ব্র্যান্ডিং করতে পেঁয়াজ ঋণ নামে একটি কর্মসূচী চালু করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই কর্মসূচীতে স্থানীয় কৃষি ব্যাংক থেকে কৃষকদের সহজ শর্তে স্বল্প সুদে ঋণ দেবে সরকার।
কর্মকৌশল প্রণয়নে সংশ্লিষ্টরা জানান, আগামী মৌসুম থেকেই যাতে এটি বাস্তবায়ন হতে পারে সে লক্ষ্যে কাজ শুরু করা হয়েছে। কর্মকৌশল নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব। ইতোমধ্যে গরুর খামার বাড়িয়ে গরু উৎপাদনে সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ। এখন আর ভারত থেকে গরু আমদানি করতে হয় না। একইভাবে সুযোগ-সুবিধা ও কৃষকের ন্যায্যদাম নিশ্চিত করে পেঁয়াজ উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। শুধু সরকারীভাবে নীতিগত সহায়তা বাড়াতে হবে। পেঁয়াজ আমদানিতে প্রতিবছর ব্যয় করতে হচ্ছে বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। অথচ আমদানি ব্যয়ের অর্ধেক টাকা দেশে উৎপাদন বৃদ্ধিতে খরচ করলে পেঁয়াজের সঙ্কট মিটিয়ে আরও রফতানি করা যাবে।
বাণিজ্য সচিব ড. মোঃ জাফর উদ্দীন জনকণ্ঠকে বলেন, আগামী দু’বছরের মধ্যে পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার লক্ষ্যে কাজ শুরু করা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে একটি কর্মকৌশল প্রণয়ন করা হয়েছে। মূল মিনিস্ট্রি হিসেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কাজ করলেও এতে কৃষি ও অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পৃক্ত রয়েছে। তিনি বলেন, পেঁয়াজ কৃষিপণ্য, ওই হিসেবে এটির উৎপাদন বাড়াতে মূল কাজটি করবে কৃষি মন্ত্রণালয়। প্রতিবছর নিত্যপণ্যের বাজারে এটি যেভাবে আলোচিত সমালোচিত হয় তাতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু করণীয় রয়েছে। আর এ কারণেই পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়িয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার কর্মকৌশল তৈরি করার উদ্যোগ নেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তিনি আরও বলেন, পেঁয়াজের উৎপাদন, ঘাটতি এবং বাজারজাতকরণে কি সমস্যা রয়েছে তা চিহ্নিত করা হয়েছে। এখন সমাধানের পালা। আগামী মৌসুম থেকে আশা করছি পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়বে।
প্রসঙ্গত, ভারত রফতানি বন্ধ ঘোষণার পর থেকেই অস্থির হয়ে উঠে পেঁয়াজের বাজার। বর্তমান বাজারে প্রতিকেজি দেশী পেঁয়াজ ৯০-১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর আমদানি করা পেঁয়াজ তেমন নেই বললেই চলে। পেঁয়াজে ভর করছে গত বছরের আতঙ্ক। গত বছর এই সময় দেশে প্রতিকেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয় ৩০০ টাকায়। এবারও বাজার পরিস্থিতি সামাল দিতে ভারতের বিকল্প বাজার হিসেবে তুরস্ক ও মিসর, নেদারল্যান্ডসসহ বিশ্বের ১১ দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। কিন্তু এরপরও বাজার স্বাভাবিক হয়নি। আর এ কারণে পেঁয়াজ সঙ্কটের একটি স্থায়ী সমাধানের কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, বাংলাদেশে পেঁয়াজের মোট চাহিদার প্রায় ৫৭ শতাংশ দেশে উৎপাদিত হয়। বাকিটা বিদেশ থেকে, প্রধানত ভারত থেকে আমদানি করতে হয়। এ কারণে পেঁয়াজের ব্যাপারে ভারত কোন সিদ্ধান্ত নিলে তার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের বাজারে। এছাড়া মিয়ানমার, মিসর, তুরস্ক, চীন থেকেও বাংলাদেশে অল্প কিছু পেঁয়াজ আমদানি হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, সারাবছরে পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে ৩০ লাখ টনের মতো। চলতি ২০২০ সালের সালের মার্চ মাসে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ২৫ লাখ ৫৭ হাজার টন। তবে এই উৎপাদন থেকে গড়ে ২৫-৩০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে দেশে মোট পেঁয়াজের উৎপাদন দাঁড়ায় ১৮ থেকে ১৯ লাখ টনে। অথচ দেশের বাকি চাহিদা পূরণ করতে প্রায় ১১ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। আনা সহজ ও পরিবহন খরচ কম হওয়ায় বাংলাদেশ ভারতের পেঁয়াজের উপর নির্ভরশীল। সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশের চাহিদার পুরোটা পূরণ করতে হলে দেশে অন্তত ৩৫ লাখ টন পেঁয়াজের উৎপাদন করতে হবে। তাহলে যেটুকু নষ্ট হবে, তা বাদ দিয়ে বাকি পেঁয়াজ দিয়ে দেশের পুরো চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে মসলা জাতীয় ফসলের গবেষণা জোরদারকরণ প্রকল্পের পরিচালক ড. শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি আলোচনায় জানান, পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব। কৃষকদেরও আগ্রহ আছে। কিন্তু কিছু সমস্যা আছে। পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হলে এই সমস্যাগুলোর সমাধান আগে করতে হবে। তিনি জানান, সময়মতো বীজের সরবরাহ বাড়ানো, উৎপাদনে ভূমির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং পেঁয়াজ সংরক্ষণের মতো উদ্যোগ নিতে হবে।
প্রয়োজনীয় বীজ সরবরাহ করা হবে ॥ পেঁয়াজ চাষে সবচেয়ে বড় সমস্যা সময়মতো বীজ না পাওয়া। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় বীজ সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হবে। দেশে প্রতিবছর মোট ১১০০ টন পেঁয়াজ বীজের দরকার হয়। সরকারীভাবে পাঁচ-ছয় টন, বেসরকারীভাবে ৫০-৬০ টন পেঁয়াজ বীজ উৎপাদিত হয়। বাকিটা কৃষকরা উৎপাদন করেন। পেঁয়াজ উৎপাদন বাড়াতে হলে এই বীজের উৎপাদন এবং সংরক্ষণও বাড়াতে হবে। এক কেজি পেঁয়াজের বীজে দুই বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করা হয়। একেক বিঘায় গড়ে ৪০ মণ দেশী পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। গত বছর এক কেজি পেঁয়াজের বীজের দাম আড়াই হাজার টাকা, অর্থাৎ এক মণ পেঁয়াজের দাম এক লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এই বছর দুই লাখ টাকা দিয়েও এক মণ পেঁয়াজের বীজ পাওয়া যাচ্ছে না। এর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে সামনের বছরের উৎপাদনে। বাণিজ্য সচিব বলেন, কর্মকৌশলে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হয়েছে বীজের সরবরাহে। আশা করছি, সময়মতো কৃষকের হাতে পেঁয়াজের বীজ দেয়া যাবে।
চাষাবাদে ভূমির ব্যবহার বাড়ানো হবে ॥ দেশের ফরিদরপুর, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ ও পাবনা জেলায় পেঁয়াজ সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয়। আর এ কারণে এই চার জেলাকে নিয়ে বিশেষ উদ্যোগ থাকবে। এর পাশাপাশি চরাঞ্চল ও উত্তরবঙ্গের রংপুরে পেঁয়াজ চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হবে। দেশে ২ লাখ ৩৭ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের চাষ হচ্ছে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. রুম্মান আরা সম্প্রতি বলেন, পেঁয়াজের দামটা যাতে সহনীয় থাকে, সেজন্য দেশে একটা নীতিমালা থাকা দরকার, যাতে কৃষক এই ফসল উৎপাদন করে হতাশ হয়ে না পড়েন। এছাড়া বাংলাদেশে শুধুমাত্র পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য কোন কোল্ড স্টোরেজ নেই। কিন্তু সারাবছরের চাহিদা মেটানোর মতে পেঁয়াজ উৎপাদিত করতে হলে সেটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। বর্তমানে কৃষকরা নিজেদের বাড়িতে দেশীয় পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করে থাকেন। কিন্তু তাতে পেঁয়াজ নষ্ট হওয়ার হারটা বেশি হয়। পেঁয়াজের জন্য ১২ থেকে ২০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের তাপমাত্রা দরকার। আর্দ্রতা থাকতে হবে ৩৫ থেকে ৪৫ এর মধ্যে। ফরিদপুর, পাবনা, রাজবাড়ীর মতো যেসব স্থানে পেঁয়াজের আবাদ বেশি হয়, সেখানে এ রকম অনেকগুলো কোল্ড স্টোরেজ থাকলে কৃষকরা পেঁয়াজটা সংরক্ষণ করে রাখতে পারতেন। ফলে তারা বেশি করে উৎপাদন করতেন।
এছাড়া বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মসলা গবেষণা কেন্দ্র বর্তমানে পেঁয়াজের ছয়টি জাত অবমুক্ত করেছে। তার মধ্যে তিনটি জাত গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের জাত। সেগুলোর ভেতর বারি-৫ এর ওপর গবেষণাকারীরা সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছেন। মার্চ মাসে রোপণ করে জুন-জুলাই মাসে অথবা আগস্ট মাসে রোপণ করে নবেম্বর-ডিসেম্বর মাসে এসব পেঁয়াজের ফসল পাওয়া যায়। ড. রুম্মান আরা আরও বলেছেন, এসব গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষাবাদ করলে সেটা চাহিদা বড় একটি অংশ যোগান দিতে পারে। কারণ এসব ফসল যখন উঠবে, তখন পেঁয়াজের দামও বেশি থাকে। ফলে কৃষকও লাভবান হবেন। আবার সারাবছর ধরেই দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন, যোগান অব্যাহত থাকবে।
এদিকে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। যারা পোল্ট্রি, কৃষি ফার্ম, ফলমূল ও মসলা জাতীয় খাদ্যপণ্য উৎপাদন করবেন তারা এই তহবিল থেকে সহজ শর্তে মাত্র চার শতাংশ সুদে ঋণ সুবিধা পাবেন। এ ছাড়াও নয় শতাংশ সুদের জায়গায় মাত্র চার শতাংশ সুদে কৃষকদের ঋণ বিতরণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বিশেষ ঋণ প্রণোদনা দেবে। বিশেষ প্রণোদনা ছাড়াও বাজেটে কৃষকের স্বার্থে সারসহ সেচ কাজে বিদ্যুত বিলের রিবেট বাবদ কৃষি খাতে ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ভর্তুকি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বাজেটে সারের জন্য ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ভর্তুকি, বীজের জন্য ১৫০ কোটি টাকা এবং কৃষকের জন্য আরও ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সেই সঙ্গে পেঁয়াজ, রসুন ও আদার মতো মসলা উৎপাদকদের জন্য চার শতাংশ সুদে ঋণ সুবিধা চালু রয়েছে।
‘পেঁয়াজ ঋণ’ নামে কর্মসূচী ॥ দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে ‘পেঁয়াজ ঋণ’ নামে একটি কর্মসূচী চালু করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এই কর্মসূচীর আওতায় স্থানীয় কৃষি ব্যাংক থেকে চাহিদা মতো ঋণ গ্রহণ করতে পারবেন পেঁয়াজ চাষীরা। সহনীয় সুদের এই ঋণের টাকায় পেঁয়াজ চাষী প্রয়োজনীয় সার, বীজ ও কীটনাশক সংগ্রহ করবেন। পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়াতে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা হবে, যাতে কোন কৃষক না ঠকেন। আগামী মৌসুম থেকেই যাতে দেশীয় পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ে সে লক্ষ্যে দ্রুত এই কর্মসূচীটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
জানা গেছে, পেঁয়াজ ঋণ কর্মসূচীটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একটি প্রস্তাবনা ও গাইড লাইন তৈরি করছে। প্রস্তাবনাটি বাস্তবায়নে কৃষি মন্ত্রণালয় ও অথর্ মন্ত্রণালয়কে বিশেষভাবে অনুরোধ করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর আগে বাণিজ্য, কৃষি ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগে একটি সমন্বয় বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ওই বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক ও সংশ্লিষ্ট তিন সচিব উপস্থিত থাকবেন। চলতি অক্টোবর মাসে পেঁয়াজ ঋণ নিয়ে প্রস্তাবনাটি বাংলাদেশে ব্যাংকে প্রেরণ করা হবে। পরবর্তীতে এ সংক্রান্ত একটি সার্কুলার আসবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব ড. মোঃ জাফর উদ্দীন আরও বলেন, বৃহত্তর স্বার্থে পেঁয়াজের আমদানি নির্ভরতা কমানো প্রয়োজন। পেঁয়াজের কেন ঘাটতি হয় কোথায় কোথায় সমস্যা রয়েছে তা বেশভালে স্পষ্ট হয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন কৃষকদের উৎসাহিত করা। তিনি বলেন, পাবনা ও বৃহত্তর ফরিদপুরসহ দেশের মোট ৮ জেলায় পেঁয়াজের চাষ হয়ে থাকে। এরমধ্যে বৃহত্তর রংপুর জেলার পেঁয়াজ চাষীদের উদ্বুদ্ধ করা গেলে ভাল ফল আসবে। দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। যে পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি হয়, তা উৎপাদন বাড়িয়ে চাহিদা মেটানা হবে। এজন্য কৃষকদের ভাল দাম নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, কৃষকদের সহজশর্তে শুধু পেঁয়াজের উপর ঋণ দেয়ার একটি কর্মসূচী আনা হচ্ছে। এ ব্যাপারে একটি পূর্ণাঙ্গ গাইড লাইন ও প্রস্তাবনা করা হচ্ছে। আগামী মৌসুম শুরুর আগে সরকারী উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করা হবে।
জানা গেছে, দেশে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৭ থেকে ৮ হাজার টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। ওই হিসেবে বছরে প্রায় ২৪-২৫ লাখ টন পেঁয়াজের প্রয়োজন হয়। কিন্তু দেশীয় উৎপাদনের ৩০ শতাংশ নষ্ট হয়। ফলে ১০ থেকে ১১ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি হয় বড় উৎস প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত থেকে। এ বছর ভারতে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার কারণে দেশটি রফতানি কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে একলাফে দ্বিগুণ হয়ে যায় পেঁয়াজের দাম। এ কারণে পেঁয়াজের দাম দ্রুত কমাতে জরুরী ভিত্তিতে তুরস্ক থেকে ১ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এছাড়া জি টু জি বৈঠকের পর মিয়ানমার থেকে ফের পেঁয়াজ আমদানি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে এই পেঁয়াজ জাহাজে করে দেশে আনবেন বেসরকারী খাতের আমদানিকারকরা। ইতোমধ্যে মিয়ানমারের পেঁয়াজ এসে গেছে। করোনার কারণে দীর্ঘদিন মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজসহ অন্যান্য পণ্য আমদানি বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাসের কমার্শিয়াল কাউন্সিলর ও দেশটির শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বড় পাঁচ উদ্যোক্তা বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
বছরে ২ হাজার কোটি টাকার পেঁয়াজ আমদানি ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পেঁয়াজ আমদানিতে ব্যয় হয় ১ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে পেঁয়াজ আমদানির পরিমাণ আরও বাড়বে। কারণ প্রতিবছর দেশে চাহিদা বাড়ছে। এ কারণে বাড়ছে আমদানিও। শুল্ক স্টেশনের তথ্য অনুযায়ী, গেল অর্থবছরে পেঁয়াজ আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৯৩৭ কোটি টাকা। আমদানি ব্যয়ের মতো খুচরা পর্যায়েও ক্রেতাকে খরচ করতে হয়েছে আরও বেশি। গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে গত মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারত থেকে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ ছিল। এ সময় দেশে প্রতিকেজি সর্বোচ্চ ২৫০ টাকায় পেঁয়াজ বিক্রি হয়। ক্রেতার পকেট কাটা গেলেও সঙ্কটের সময়জুড়ে দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজ বেঁচে ভাল দাম পেয়েছেন কৃষক। ফলনও বেড়েছে। ভারতের বিকল্প আমদানির নতুন নতুন বাজারও তৈরি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিআইডিএসে’র সিনিয়র গবেষক ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, সঙ্কট থেকে শিক্ষণীয় অনেক কিছুই আছে। দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের ভাল সরবরাহ থাকে মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত। বছরের বাকি সময় আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা বেশি। এবারের মতো যাতে আর সঙ্কট তৈরি না হয়, তাই এ সময় (আগস্টেও শেষ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত) ভারতে পেঁয়াজ উৎপাদনে সমস্যা হচ্ছে কি না, তা খেয়াল রাখা উচিত। আবার বিকল্প বাজার থেকে আমদানি এবং পেঁয়াজ সংরক্ষণের আধুনিক ব্যবস্থায় নজর দেয়া উচিত। তাহলে সঙ্কট হলেও খুব বেশি দামে পেঁয়াজ খেতে হবে না।