শীত সামনে রেখে করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ধাক্কা সামলানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে মাঠ প্রশাসন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে দেশের জেলা-উপজেলার প্রশাসনকে করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা সামলাতে সম্ভাব্য কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, এসংক্রান্ত পরামর্শ চেয়ে চিঠি দিয়েছে। জেলা প্রশাসকরা (ডিসি) প্রথম ধাপের করোনা পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে যেন পরিকল্পনা সাজান, সে কথাও মন্ত্রিপরিষদের নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৬৪ জেলার ডিসিরা সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে পরিকল্পনা তৈরি করছেন।
ডিসিদের পরিকল্পনা জমা হবে সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে। কমিশনাররা সেগুলো সমন্বয় করে পাঠাবেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে। ২০ অক্টোবরের মধ্যে এসব পরিকল্পনা ঢাকায় পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের প্রস্তুতি গুছিয়ে এনেছেন অনেক জেলার ডিসি। সারা দেশের পাঁচজন ডিসির সঙ্গে কথা হয়েছে কালের কণ্ঠ’র এই প্রতিবেদকের। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে কর্মপরিকল্পনার বিষয়ে উদ্যোগের কথা জানা গেছে। সেই সঙ্গে কিছু ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নেওয়ারও চিন্তা করছেন কোনো কোনো জেলার ডিসি।
একাধিক ডিসি জানান, ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ করার চিন্তা চলছে। অর্থাৎ যারা মাস্ক পরিহিত থাকবে না, তারা সরকারি দপ্তরগুলোতে সেবা পাবে না। এ ছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও যাতে এই নিয়ম চালু করে, সেই উদ্যোগও নেবে জেলা প্রশাসন। এ জন্য স্থানীয় ব্যবসায়ী সমিতি, রাজনৈতিক নেতা, সামাজিকভাবে অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব, মসজিদের ইমাম, অন্যান্য ধর্মের স্থানীয় শীর্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে স্থানীয় প্রশাসন। এর বাইরে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে শহরের জনাকীর্ণ মোড়ে মোড়ে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখার পরিকল্পনাও করছেন ডিসিরা। করোনা সংক্রমণের প্রথম দিকে এমন উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখন এসব উদ্যোগ ঝিমিয়ে পড়েছে। তাই শীত সামনে রেখে এসব বিষয়ে নতুন উদ্যোগ নেওয়া হবে। প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অন্তত ১০টি করে শয্যা করোনা রোগীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। অর্থাৎ জেলা-উপজেলা পর্যায়ে করোনা রোগী ও সাধারণ রোগী একই হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকবে। যেসব জেলায় করোনা পরীক্ষার জন্য পিসিআর ল্যাব নেই, সেসব জেলায় ল্যাব প্রতিষ্ঠা করে দ্রুত ও বেশি বেশি পরীক্ষা করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রতিটি জেলায় এক-দেড় শ জন আইসোলেশনে থাকতে পারে—এমন আইসোলেশন সেন্টার স্থাপন করা হবে। আক্রান্ত যারা বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেবে, তাদের হোম কোয়ারেন্টিনের নিয়মগুলো ঠিকমতো পালন করতে সহযোগিতা করবে স্থানীয় প্রশাসন।
ময়মনসিংহ বিভাগের একজন ডিসি কালের কণ্ঠকে বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে নিয়ম মানতে উদ্যোগ নেওয়া হবে। তবে খুব সাধারণ অপরাধ বা ভুলের কারণে জরিমানা না করে সচেতনতামূলক কাজে বেশি জোর দেবেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। যারা মাস্ক পরার নিয়ম মানে না, তাদের মাস্ক পরতে বাধ্য করা। যাদের মুখে তাত্ক্ষণিক মাস্ক থাকবে না, তাদের মাস্ক দিয়ে সহযোগিতা করা। অর্থাৎ জরিমানা না করে করোনার বিপদ সম্পর্কে সচেতন করে মানুষকে নিয়ম মানতে উদ্বুদ্ধ করার বিষয়ে জোর দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে রাজশাহী বিভাগের একজন ডিসি কালের কণ্ঠকে বলেন, করোনার প্রথম দিকে যশোরের মণিরামপুরে এসি ল্যান্ড একজন বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিককে কান ধরানোয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। এবার এসব বিষয় যাতে কোনোভাবেই না হয়, সেই সতর্কতা সব উপজেলায় দেওয়া হচ্ছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ডিসিদের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, আসন্ন শীতে দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ আরো বাড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। নভেম্বরের দিকে করোনা পরিস্থিতি আবারও খারাপ হওয়ার আশঙ্কায় গত ২১ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিপরিষদের সভায় প্রধানমন্ত্রী বিদ্যমান অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সবাইকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশনা দিয়েছেন। এই অবস্থায় কভিড-১৯-এর দ্বিতীয় পর্যায়ের সংক্রমণ মোকাবেলার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও করণীয় নির্ধারণ করার লক্ষ্যে গত ২২ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিপরিষদসচিবের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদের চিঠিতে দ্বিতীয় পর্যায়ের সংক্রমণ মোকাবেলায় করণীয় নির্ধারণের জন্য মাঠপর্যায়ের বিদ্যমান অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ডিসিদের পরিকল্পনা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ডিসিরা জেলার আইন-শৃঙ্খলা, স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি, খাদ্য, দুর্যোগ, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ অন্যান্য বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে উদ্যোগ নেবেন। উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি (সিটি করপোরেশন, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা) এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে ডিসিরা ভার্চুয়াল সভা বা সরাসরি বৈঠক করে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করবেন। কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নে স্বাস্থ্য, কৃষি, প্রাণিসম্পদ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, খাদ্য সরবরাহ, দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও এলাকাভিত্তিক প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিভাগীয় কমিশনাররা তাঁদের বিভাগের জেলাগুলো থেকে পাওয়া কর্মপরিকল্পনা সমন্বয় করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠাবেন।
খুলনার বিভাগীয় কমিশনার ড. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার গতকাল শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী মাঠ প্রশাসনে কাজ চলছে। তবে ২০ অক্টোবরের মধ্যে পরিকল্পনা জমা দেওয়া কষ্ট হয়ে যাবে। হয়তো আরেকটু সময় বেশি লাগতে পারে।’
উল্লেখ্য, গত মার্চে দেশে করোনা সংক্রমণের খবর দেওয়া হয় সরকারের তরফ থেকে। এর ১০ দিন পর ১৮ মার্চ প্রথম করোনায় মৃত্যুর তথ্য জানানো হয়। এরপর সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে, যা চলে টানা ৬৬ দিন। গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত দেশে করোনায় মারা গেছে পাঁচ হাজার ৬৪৬ জন। মোট আক্রান্তের সংখ্যা তিন লাখ ৮৭ হাজার ২৯৫; যদিও তিন লাখের বেশি মানুষ করোনামুক্ত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে করোনা সংক্রমণ কিছুটা কমে এলেও শীতে আবার বাড়তে পারে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সতর্ক করেছেন।