বিশেষ প্রতিনিধি ॥ মাস্ক না পরলে সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে কোন সেবা মিলবে না এমন নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রিসভা। পাশাপাশি মন্ত্রিসভা ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জারি করা অধ্যাদেশ আইনে পরিণত করার অনুমোদন দিয়েছে। এ জন্য ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধিত) আইন, ২০০০’-এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ভার্চুয়াল মন্ত্রিসভা বৈঠকে এই নির্দেশনা ও অনুমোদন দেয়া হয়। গণভবন প্রান্ত থেকে প্রধানমন্ত্রী এবং সচিবালয়ের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে মন্ত্রীরা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বৈঠকে যোগ দেন। বৈঠক শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
শীতে করোনা বাড়তে পারে, সে জন্য প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছিল- এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, সে বিষয়ে ইতোমধ্যে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। চারদিকে আমাদের যত প্রতিষ্ঠান আছে তাদেরকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এর এক নম্বর শর্ত হলো মাক্স না পরলে কোথাও কোন সেবা পাবেন না। এছাড়া সব প্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার বা শপিংমল বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক ও ধর্মীয় সম্মেলনে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। আমরা এটা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছি।
তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আমরা বিভাগীয় কমিশনারদের ইতোমধ্যে নির্দেশ দিয়েছি। সব সরকারী-বেসরকারী অফিসের বাইরে বড় একটা পোস্টারের মতো থাকবে- মাস্ক ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারবে না, মাস্ক ছাড়া ব্যবহারও করতে পারবে না। ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে প্রচার করার জন্য বলা হয়েছে- দিনে দুইবার নামাজের পর প্রচার করার জন্য যে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। আলেম-ওলামাদের সঙ্গেও কথা বলেছি। তারাও প্রচার শুরু করেছেন।
বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কিভাবে মাস্ক পরা নিশ্চিত করা হবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, তদন্ত করা হবে। তাহলে মাস্ক ছাড়া কেউ এলে তাকে সেবা দেয়া হবে না- এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ঢুকতেই দেয়া হবে না, আমরা বলে দিয়েছি। শুধু সরকারী নয়, বেসরকারী প্রতিষ্ঠানেও। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিকের সঙ্গেও কথা বলেছি, তারাও তাদের প্রতিষ্ঠানে এটা চালু করছেন।
করোনার সময় অন্য রোগীদের সেবা পেতে সমস্যা হয়েছে, আবার দ্বিতীয় দফা করোনা আসছে- এ বিষয়ে খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, এখন আল্লাহর রহমতে আগের মতো সমস্যাটা হবে না। আতঙ্কটা কমে গেছে। শুরুতে তো বোঝা যাচ্ছিল না জিনিসটা কী? ডাক্তার-স্টাফরাও এখন আর অত ভয় পাচ্ছে না। আমি দু-একটি হাসপাতালে গিয়ে দেখেছি।
হাসপাতালগুলোতে এ বিষয়ে কোন নির্দেশনা আছে কিনা- এ বিষয়ে তিনি বলেন, নির্দেশনা আছে, কোভিড-১৯ ও নন-কোভিড দুটিকে আলাদা করে চিকিৎসা করা। ঢাকা মেডিক্যালেই দেখেন কোভিড-১৯ আলাদা হয়ে গেছে, এটা আলাদা হয়ে গেছে। কোন অসুবিধা হচ্ছে না। গণপরিবহনে মানুষ মাস্ক পরছে না- এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এ বিষয়টা আমরা দেখব। বৈঠকে এটা আলোচনা হয়েছে। সড়ক সচিব, নৌপরিবহন সচিব ও রেল সচিবের সঙ্গে আমরা কাল বসব। বসে ওটা একটা কর্মপরিকল্পনা করা যাবে। কোভিড-১৯ মোকাবেলায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক গৃহীত কার্যক্রম সম্পর্কে মন্ত্রিসভাকে অবহিত করা হয় বৈঠকে। এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, বাংলাদেশে এখন ৯৩টি কেন্দ্রে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করা হচ্ছে, এর মধ্যে ৫০টি বেসরকারী। প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে দুই হাজার চিকিৎসক এবং চার হাজার নার্স নিয়োগ দেয়ায় কোভিড-১৯ হ্যান্ডেল করার ক্ষেত্রে খুবই বড় অবলম্বন হিসেবে কাজ করেছে। এর বাইরেও স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে দুই হাজার ৬৫৪ টেকনিশিয়ান ও সহকারীকে নিয়োগ দিয়েছে।
তিনি বলেন, এছাড়া পাঁচ হাজার ১০০ চিকিৎসক এবং এক হাজার ৭০০ নার্সকে আইইডিসিআরের মাধ্যমে করোনাভাইরাসের ‘ম্যানেজমেন্ট ও ইনফেকশন প্রিভেনশন কন্ট্রোল’ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। যার ফলে তারা মাঠ পর্যায়ে করোনা মোকাবেলায় সক্ষম হয়েছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি জাতীয় কমিটি পুরো কাজ মনিটর করেছে। প্রধানমন্ত্রীর দিক-নির্দেশনার আলোকে ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রোটকল অনুসারে এ যাবত গৃহীত কার্যক্রমের পাশাপাশি সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবেলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সার্বিক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।
ভ্যাকসিন ট্রায়ালে অর্থ চাইবে চীন ॥ কোভিড-১৯ প্রতিরোধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ভ্যাকসিন সংগ্রহে উদ্যোগ নিয়েছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, কোথা থেকে ভ্যাকসিন পেতে পারি, সে বিষয়ে সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগ জারি আছে, আশা করি প্রথম দিকেই আমাদের ভ্যাকসিন পাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশে চীনের ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ওটা নিয়ে কাজ করছে। সরকারী-বেসরকারী সব পর্যায়েই প্রস্তুতি নেয়ার জন্য বলেছে। চীনের ভ্যাকসিন বাংলাদেশে ট্রায়ালের অনুমোদন দিয়ে রেখেছি, বিষয়টি আটকে নেই। সেটা নিয়ে আলোচনা করছে তারা, বাংলাদেশের কাছে সম্ভবত কিছু অর্থ চাইবে তারা। অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন পাওয়া নিয়ে এক প্রশ্নে আনোয়ারুল বলেন, সেটা ভালভাবেই এগোচ্ছে।
বৈঠকে পদ্মা সেতু নিয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘পদ্মায় যেহেতু ৩৪ নম্বর স্প্যান বসে গেছে সে জন্য পদ্মার আর যে সাতটি স্প্যান সবই প্রায় রেডি। ৪১ নম্বর স্প্যানের নাটবল্টু লাগানো হচ্ছে। আশা করি আগামী দুই-আড়াই মাসের মধ্যে হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। ডিসেম্বরের মধ্যে সব স্প্যান বসানোর প্ল্যান না হলে হয়ত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি হয়ে যাবে। কারণ ওদের ওই ক্রেনটি ছেড়ে দিতে হবে। কারণ এই ক্রেন পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। ওরাও অন্য জায়গায় কাজ করছে। সেখানে না পাঠালে দেরি হবে। এখন সবকিছু ঠিক আছে।
ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, আইনে পরিণত হচ্ছে অধ্যাদেশ ॥ ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জারি করা অধ্যাদেশ আইনে পরিণত হচ্ছে। এ জন্য ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধিত) আইন, ২০০০’-এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।
গত ১২ অক্টোবর মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পরের দিন (১৩ অক্টোবর) রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০০০’ জারি করেন।
দেশজুড়ে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনবিরোধী আন্দোলন এবং ধর্ষণকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার দাবির মধ্যে সরকার এই পদক্ষেপ নেয়। সংসদ অধিবেশন না থাকায় তখন আইন সংশোধনের পর তা অধ্যাদেশ আকারে জারি হয়। আগামী ৮ নবেম্বর থেকে একাদশ জাতীয় সংসদের দশম অধিবেশন শুরু হচ্ছে। তাই অধ্যাদেশটি আইনে পরিণত করার উদ্যোগ নেয়া হলো।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, অধ্যাদেশটি রবিবার আইনের খসড়া হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। লেজিসলেটিভ বিভাগের চূড়ান্ত ভেটিং করে দেয়া হয়েছে। সংসদ অধিবেশন না থাকা অবস্থায় যদি কোন অর্ডিন্যান্স হয় তাহলে পরবর্তী সংসদ অধিবেশনের প্রথম দিনই সেটি উপস্থাপন করতে হয়।
তিনি বলেন, অধ্যাদেশ হিসেবে যেটা আনা হয়েছিল সেটাই রবিবার আইনের খসড়া হিসেবে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) উপধারায় বলা হয়, ‘যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তা হলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন’।
সংশোধিত আইন অনুযায়ী ৯(১) উপধারায় ‘যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। আইনের ৯(৪)(ক) উপধারায় ছিল- ‘যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করিয়া মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন’। এখানেও সংশোধন করে ‘যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’-এর পরিবর্তে ‘মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ করা হয়েছে।
৯(৫) উপধারায় ছিল- ‘যদি পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন কোনো নারী ধর্ষিতা হন, তাহা হইলে যাহাদের হেফাজতে থাকাকালীন উক্তরূপ ধর্ষণ সংঘটিত হইয়াছে, সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণ ধর্ষিতা নারীর হেফাজতের জন্য সরাসরিভাবে দায়ী ছিলেন, তিনি বা তাহারা প্রত্যেকে, ভিন্নরূপ প্রমাণিত না হইলে, হেফাজতের ব্যর্থতার জন্য, অনধিক দশ বৎসর কিন্তু অন্যূন পাঁচ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যূন দশ হাজার টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন।’ এখানে ‘দায়ী’ শব্দ পরিবর্তন করে ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত’ করা হয়েছে।
অধ্যাদেশ অনুযায়ী, ধর্ষণ ছাড়া সাধারণ জখমের ক্ষেত্রে অপরাধ আপোসযোগ্য হবে। এছাড়া আগের আইনে ১৯৭৪ সালের শিশু আইনের রেফারেন্স ছিল। এখন সেখানে হবে ‘শিশু আইন, ২০১৩’।