দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাংবাদিকদের কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলেছেন, সাংবাদিকতাটা যেন নিরপেক্ষ, বাস্তবমুখী, দেশ ও জাতির প্রতি কর্তব্যবোধ থেকে হয়। নীতিহীন সাংবাদিকতা যেন না হয়। নীতিহীন সাংবাদিকতা দেশের কল্যাণ আনতে পারে না। গতকাল সকালে রাজধানীতে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করে এ আহ্বান জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি এ অনুষ্ঠানে যুক্ত হন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সংবাদপত্র সমাজের দর্পণ। তাই এর সঙ্গে যারা যুক্ত তারা যেন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হন। তাদের ভিতরে যেন মানবতাবোধ থাকে। তারা যেন মানুষের কল্যাণে কাজ করেন। তিনি বলেন, দেশে একটা সময় ছিল যতই দুর্নীতি বা অন্যায় হোক সেগুলো ধামাচাপা দেওয়া হতো। সমস্যাগুলো কার্পেটের নিচে লুকিয়ে রাখা হতো। আমরা তা করছি না। কোথাও কোনো অন্যায় হলে আমরা দলের কথা চিন্তা করি না। আমরা চিন্তা করি যেখানে অন্যায় হবে সেখানে ব্যবস্থা নিতে হবে। সাংবাদিকদের উদ্দেশে সরকার প্রধান বলেন, সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা, বিবেক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। সেগুলো ভোগ করতে গেলে অপরের প্রতি, রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ববোধ থাকতে হবে। সমালোচনা সবাই করুক তাতে আপত্তি নেই। এর মাধ্যমে অনেক কিছু জানা যায়। তিনি সাংবাদিকতার নীতিমালা মেনে চলতে সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানান। শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘নীতিহীন রাজনীতি দেশ ও জাতিকে কিছু দিতে পারে না। তেমনি নীতিহীন সাংবাদিকতা দেশের কোনো কল্যাণ করতে পারে না। বরং অনেক ক্ষেত্রে সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।’ পিতার আরেকটি উদ্ধৃতি তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। সেটি হলো- ‘গণতন্ত্রের একটা নীতিমালা আছে, সাংবাদিকতার একটা নীতিমালা আছে। এ দুটো মনে রাখলে আমরা অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারব।’ তিনি বলেন, এটাই হচ্ছে সব থেকে মূল্যবান কথা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, নীতিহীনতা কোনো দেশের কল্যাণ আনতে পারে না বরং ক্ষতি করে। হয়তো কিছু মানুষ অর্থ সম্পদের মালিক হতে পারে কিন্তু অর্থ-সম্পদ সবসময় কাজে লাগে না। করোনাভাইরাস হওয়ার কারণে এটা আজকে প্রমাণিত যে কোটি কোটি টাকা থাকলেও অনেক সময় কাজে লাগে না। করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী মানুষকে এই একটা শিক্ষা দিয়ে গেছে। শুধু অর্থ সম্পদ বা নিজের স্বার্থপরতা কখনো কাউকে রক্ষা করতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে এগিয়ে নিতে তার সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের ওপর আলোকপাত করেন। তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশ করে বলেন, বাংলাদেশটাকে আমরা যেন গড়ে তুলতে চাই এবং সেভাবেই এগিয়ে যেতে চাই। সেইক্ষেত্রে আপনাদের কাছে বলব- আপনারা নিশ্চয়ই দায়িত্বশীলতা নিয়ে, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করে আপনারা কাজ করবেন। কারণ এই রিপোর্টগুলো অনেক সহযোগিতা করে। এ সময় কোথাও দুর্নীতি হলে তার সঙ্গে দল বা সরকারের কেউ জড়িত কিনা সেই চিন্তা না করে সরকার সবার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয় বলে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, একটা সময় দেশে যতই দুর্নীতি হোক, অন্যায়-অনিয়ম হোক, সেটা ‘ধামাচাপা’ দেওয়া হতো। কিন্তু আমরা তা করছি না। যেখানে যেই রিপোর্ট হচ্ছে, বা যা আমরা খবর পাচ্ছি, বা যতটুকু কোথাও কোনো দুর্নীতি বা কোনো ধরনের অন্যায় হলে আমরা কিন্তু কখনো এই চিন্তা করি না যে এটা করলে এর সঙ্গে আমার দল জড়িত কিনা বা অমুক জড়িত কিনা বা পার্টির বদনাম হবে কিনা, সরকারের বদনাম হবে কিনা। আমি চিন্তা করি যেখানে অন্যায় হয়েছে তার বিরুদ্ধে আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে। হ্যাঁ, এটা নিতে গিয়ে অনেক সময় দোষটা আমাদের ওপরই এসে পড়ে। আওয়ামী লীগ সরকারই বোধহয় দুর্নীতি করছে। ঘটনা তা নয়। জাতির পিতাকে হত্যার পর যারা অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেছিল, তারাই এ দেশে ‘দুর্নীতির বীজ বপন করে গেছে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, প্রথমে জিয়াউর রহমান, এরপরে এরশাদ, এরপরে খালেদা জিয়া। তারা দুর্নীতিটাকে প্রশ্রয় দেওয়া শুধু না, নিজেরা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিল এবং দুর্নীতিকে লালন পালনই করে গেছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেখানে দুর্নীতি পাচ্ছি, সে আমার যতবড় দলের হোক, কর্মী হোক, যেই হোক, নেতা হোক, আমরা কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিচ্ছি। হ্যাঁ, তাতে আমাদের বিরোধী যারা, তাদের লেখার সুযোগ হচ্ছে, বা বলার সুযোগ হচ্ছে যে আওয়ামী লীগ দুর্নীতি করছে। কিন্তু এই কথাটা কেউ চিন্তা করছে না যে আওয়ামী লীগ দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে না; সে যেই হোক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। গণমাধ্যমের রিপোর্ট পড়ে বিভিন্ন সময় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়ে সরকার প্রধান বলেন, বিভিন্ন পত্রিকায় অনেক সময় অনেক ঘটনা আসে, সঙ্গে সঙ্গে আমরা সেই রিপোর্ট দেখে অনেক অসহায় মানুষের পাশে যেমন দাঁড়াই। আবার অনেক অন্যায় ঘটনা ঘটলে তার প্রতিকারও করতে পারি। অনেক দোষীকেও আমরা শাস্তি দিতে পারি এবং দিয়ে থাকি। অনেক ঝুঁকি নিয়ে আপনারা অনেক সময় রিপোর্ট করেন। সে জন্য আপনাদেরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। পাশাপাশি এইটুকু অনুরোধ করব- আপনারা যেমন ধন্যবাদ যোগ্য কাজও করেন কিন্তু আবার এমন রিপোর্ট করেন না, যেটা মানুষের মাঝে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় বা মানুষ বিপথে যায়। সেদিকে আপনাদের বিশেষভাবে দৃষ্টি দেওয়ার জন্য আমি অনুরোধ জানাচ্ছি। সমালোচনায় কোনো আপত্তি নেই, উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, সমালোচনার মধ্য দিয়েই অনেক কিছু জানা যায়। আপনারা রিপোর্ট করেন এবং যে যেভাবে, যা খুশি আপনারা কিন্তু রিপোর্ট করতে পারেন। সেখানে আমরা কোনো বাধা দেইনি। স্বাধীনতার পর জাতির পিতাও কিন্তু আপনাদের সেই সুযোগটা দিয়েছিলেন।
সবাইকে দায়িত্ববোধ নিয়ে চলার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, দায়িত্ববোধটা হচ্ছে সব থেকে বড় কথা। ইতিমধ্যে আমাদের জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা-২০১৭ প্রণয়ন করা হয়েছে, জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা-২০১৪ বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করেছি। গণমাধ্যমকর্মীদেরও চাকরি সুরক্ষায় গণমাধ্যমকর্মী চাকরি শর্তাবলি আইন, যেটা আগে কখনো ছিল না। তাছাড়া সম্প্রচার খাতে স্বাধীন সম্প্রচার কমিশন গঠনের লক্ষ্যে সম্প্রচার আইন প্রণয়নেরও কাজ চলছে। এই কমিশনটা গঠন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সম্প্রচার আইনও আমরা করে দেব। যাতে বাস্তবমুখী কাজ হয়। অহেতুক সমালোচনা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা ও হলুদ সাংবাদিকতা যেন না থাকে। আর অনলাইনেও অন্তত সমাজভিত্তিক, মানবিক কল্যাণ, মানুষের উন্নয়নের দিকে যেন কাজে দৃষ্টি থাকে, সেই ধরনের সাংবাদিকতাই যেন হয়। সাংবাদিকদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা রিপোর্ট করেন এবং আপনারা জানেন, আপনারা দেখেছেন; যে যেভাবে যা খুশি আপনারা কিন্তু রিপোর্ট করতে পারেন। সেখানে আমরা কোনো বাধা দেইনি। ঠিক স্বাধীনতার পর জাতির পিতাও কিন্তু আপনাদের সেই সুযোগটা দিয়েছিলেন।
আমিও সাংবাদিক পরিবারের মেয়ে : নিজেকে সাংবাদিক পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধুও সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি যখন কলকাতায় পড়াশোনা করতেন তখন তিনি সাপ্তাহিক মিল্লাত পত্রিকার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এরপর ইত্তেহাদ নামে একটি পত্রিকার সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলার প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। পাকিস্তান হওয়ার পর সবাই বাংলাদেশে চলে আসে তখন ইত্তেফাক বের করা হয় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অর্থে। তোফাজ্জেল হোসেন মানিক মিয়া এটার দায়িত্বে ছিলেন। সেখানেও বঙ্গবন্ধু ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। আওয়ামী লীগের জন্য তিনি আর একটি পত্রিকা বের করেছিলেন ‘নতুন দিন’ নামে। পরবর্তীতে তিনি সাপ্তাহিক বাংলার বাণী বের করেন। এভাবে তিনি সাংবাদিকতার সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক ছিল। সেদিক থেকে আমি দাবি করতে পারি, আমিও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সন্তান হিসেবে সাংবাদিক পরিবারেরই একজন সদস্য। কাজেই সেভাবেই আমি আপনাদের দেখি।
প্রধানমন্ত্রী ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির রজতজয়ন্তী উদযাপনের কর্মসূচির সফলতা কামনা করেন এবং সব সদস্যদের প্রতি আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে সবাইকে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে চলার আহ্বান জানান। এ অনুষ্ঠানে গণভবন প্রান্তে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন তার মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম। আর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে মূল অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্য দেন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাবেক সভাপতি এবং রজতজয়ন্তী উদযাপন কমিটির চেয়ারম্যান শাহজাহান সরদার। বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, প্রেস ক্লাবের সভাপতি সাইফুল আলম, সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন, ডিআরইউর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা ফিরোজ, সাবেক সভাপতি শাহেদ চৌধুরী, বর্তমান সভাপতি রফিকুল ইসলাম আজাদ, সহসভাপতি নজরুল কবীর, সাধারণ সম্পাদক রিয়াজ চৌধুরী। সাংগঠনিক সম্পাদক হাবীবুর রহমান অনুষ্ঠানে শোক প্রস্তাব পাঠ করেন।